প্রাউটই একমাত্র বিকল্প

লেখক
অরুণাভ সরকার

ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট

মানব সভ্যতা আজ এক চরম সংকট মুহূর্ত্তে এসে উপনীত হয়েছে৷ বিশেষ করে সামাজিক–র্থনৈতিক ক্ষেত্রে আজ বিরাজ করছে এক চরম অনিশ্চততা ও নৈরাশ্য৷ অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান ও শিক্ষা–এ সব মানুষের নূ্যনতম চাহিদা৷ কিন্তু কী করে এই নূ্যনতম চাহিদা পূরণ করে মানুষ বেঁচে থাকবে–এইটাই অধিকাংশ দরিদ্র মানুষের কাছে সব চেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে৷ যদিও শুধু বেঁচে থাকাটাই মানুষের কাছে বড় কথা নয়, তার মানসিক ও আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের মধ্য দিয়েই মানুষ তার জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায়, কিন্তু সবচেয়ে গোড়ার কথা যে নূ্যনতম চাহিদা পূরণ তারই যখন ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না, তখন মানুষ অন্য চিন্তা আর কী করে করবে৷

পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে বর্ত্তমানে চলেছে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা৷ ভারতেও তাই৷ এই ধনতন্ত্রে মুষ্টিমেয় ধনকুবেরের অধিকারে রয়েছে সমাজের অধিকাংশ ধনসম্পদ৷ আর কোটি কোটি মানুষ মোটা ভাত মোটা কাপড়ের সংস্থান করতে পারছে না৷ অপুষ্টিতে, রোগে, বিনা চিকিৎসায় লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনান্ত ঘটছে৷ বর্ষায় শীতে মাথা গোঁজবার সামান্য আশ্রয়টুকুই নেই বহু মানুষের৷ কত মেধাবী ছাত্র যে অর্থাভাবে পড়াশুনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই কর্মসংস্থানের অভাবে লক্ষ লক্ষ বেকার তরুণ–যুবক–যুবতী জীবনে ঘনায়মান অমানিশা৷ অভাবের তাড়নায় পিতা–মাতা তাদের সন্তানকে হত্যা করে নিজেরা আত্মহত্যা করছে–এমন সংবাদ বর্ত্তমানে প্রায়ই খবরের কাগজ খুললে চোখে পড়ে৷

রাষ্ট্রসংঘ কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, সারা পৃথিবীতে ৫০ কোটি মানুষ রাতে ক্ষুধা নিয়ে ঘুমোতে যায় ও সকালে ক্ষুধা নিয়ে জাগে৷ আর এর মধ্যে ৩২ কোটি ভারতীয়৷ ভারত সরকারেরই প্রকাশিত তথ্যানুসারে এদেশে ৩৯.৩৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমারেখার নিম্নে থেকে শোচনীয়ভাবে জীবন যাপন করছে৷ ৪৮ শতাংশ নিরক্ষর৷ এসবের প্রধান কারণই হল দারিদ্র্য৷

প্রাউটের আবির্ভাবের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে রুশো–ভলতেয়ার প্রভৃতি দার্শনিকের সঙ্গে গলা মিলিয়ে অর্থনীতিবিদ্ এ্যাডাম্ স্মিথ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাষ্টির অবাধ স্বাধীনতার •‘Laissez Faire’— দাবি তুলেছিলেন, তিনি বলেছিলেন, ব্যাষ্টি মানুষকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা প্রদান করলে সমগ্র সমাজেরই কল্যাণ হবে৷ এই মতবাদকে বলা হয় ব্যষ্টিস্বাতন্ত্র্যবাদ৷ আর এ থেকেই জন্ম নিয়েছিল ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদ৷ এই ধনতন্ত্রের পথ ধরে অর্থশালী বণিকগোষ্ঠী গড়ে তুলল বিশাল বিশাল কলকারখানা৷ আর এগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে অসমর্থ হয়ে একে একে গ্রামীণ কুটির শিল্প বন্ধ হতে থাকল৷ কামার, কুমোর, তাঁতী দলে দলে কর্মহীন হয়ে পড়ল৷ দলে দলে মানুষ ছুটে চলল বড় বড় কলকারখানায় কাজ পাবার আশায়৷ তাদের সামান্য কিছু অংশের মাত্র কর্মসংস্থান হ’ল এই যন্ত্র–শিল্পগুলিতে৷ বেকার সমস্যা চরমভাবে বাড়তে লাগল৷ এই সব যন্ত্রশিল্পের মালিকেরা যতদূর সম্ভব কম মজুরী দিয়ে যত বেশী সম্ভব মুনাফা অর্জন করতে লাগল৷ এইভাবে চলল চরম শ্রমিক শোষণ৷ এই সমস্যা সমাধানকল্পে কম্যুনিজ্মের প্রবক্তা কার্ল মার্কস্ বললেন,–না, ব্যষ্টি–স্বাধীনতা নয়, সমষ্টির স্বার্থে ব্যষ্টি–স্বাধীনতাকে বলি দিতে হবে৷ আর এইভাবে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷ তিনি বললেন, ব্যষ্টিগত সম্পত্তিই সমস্ত সামাজিক শোষণের মূল উৎস৷ অতএব ব্যষ্টিগত সম্পত্তির উচ্ছেদ ঘটিয়ে সমাজে সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে৷ কালমার্কসের তত্ত্বই সংক্ষেপে মার্ক্সবাদ বা কম্যুনিজম্ নামে পরিচিত৷

১৯১৭ সালে লেনিন রাশিয়ায় রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে কম্যুনিষ্ট সরকার গড়লেন৷ তারপর রুশ প্রভাবে একে একে পূর্ব ইউরোপের পোল্যাণ্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, যুগোশ্লাবিয়া, পূর্ব জার্মানি, রোমানিয়া প্রভৃতি দেশে কম্যুনিষ্ট শাসন কায়েম হ’ল৷ এদিকে এশিয়ার বুকে চীন, ভিয়েৎনাম প্রভৃতি দেশেও কম্যুনিষ্টরা ক্ষমতা দখল করল৷ এই সব দেশে কম্যুনিষ্ট শাসন কায়েম হল, কিন্তু শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে উঠল না৷ ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় কম্যুনিষ্ট শাসন প্রতিষ্ঠার পর ৭৪ বছরের মাথায় সেখানকার জনগণ কম্যুনিষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল৷ তারা অনুভব করল কম্যুনিজমের শ্লোগান স্রেফ ধাপ্পা মাত্র৷ তাই কম্যুনিজমকে তারা প্রত্যাখান করল৷ কম্যুনিষ্ট সরকারকে জনগণ ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলল৷ পূর্ব ইউরোপের সমস্ত কম্যুনিষ্ট দেশগুলিতেই একই ঘটনা ঘটে গেল৷ এই সমস্ত দেশেই কম্যুনিষ্ট শাসকবর্গের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গণ–ভ্যুত্থান ঘটেছে৷ ফলে গোটা পূর্ব ইউরোপ জুড়ে তীব্র গণরোষের ফলে পোল্যাণ্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, পূর্ব জার্মানি, রোমানিয়া, আলবেনিয়া সর্বত্রই কম্যুনিষ্ট সরকারের পতন ঘটেছে৷ বাস্তবে সর্বত্রই কম্যুনিষ্ট শাসকদের অত্যাচার, শোষণ, দুর্নীতি ও সাধারণ মানুষের চরম অর্থনৈতিক দূরবস্থা ওই সমস্ত দেশের জনমনে কম্যুনিজ্মের প্রতি চরম ঘৃণার উদ্রেক করেছে৷

এখন এশিয়ার যে দু’একটি দেশে কম্যুনিষ্ট শাসকেরা ক্ষমতায় টিকে রয়েছে, সর্বত্রই তারা মার্কসবাদের মূল তত্ত্বকে বাদ দিয়ে কোনরকমে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রেখেছে মাত্র৷ চীনের কম্যুনিষ্ট শাসনের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব যুব বিদ্রোহ ও তাদের দমন করার জন্যে সমাবেশ স্থল তিয়েন–আন্–মেন স্কোয়ারে হাজার হাজার যুবককে ট্যাঙ্কের তলায় যেভাবে পিষে মেরে রক্তের বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়েছিল–তাতে কম্যুনিজ্মের বিরুদ্ধে বিশ্বের সমস্ত মানবতাবাদী ও মুক্তিকামী মানুষের মন চরমভাবে বিষিয়ে উঠেছে৷ ধনতন্ত্র ও মার্কসবাদ উভয়ই যখন শোষণমুক্ত মানবসমাজ গড়তে ব্যর্থ, তখন নিপীড়িত মানবতার মুক্তির উপায় কী?

বিশ্বের সামাজিক–র্থনৈতিক ক্ষেত্রে এইভাবে যখন এক ভয়াবহ শূন্যতা দেখা দিয়েছে, মানবতার এই চরম সংকট মুহূর্ত্তে আমরা পাচ্ছি এক নোতুন যুগান্তকারী সামাজিক–র্থনৈতিক তত্ত্ব–যাতে রয়েছে আজকের সমাজের ভয়াবহ দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যা সহ সমস্ত সমস্যারই সমাধানের যথার্থ পথ৷ মহান্ দার্শনিক ঋষি শ্রী প্রভাত রঞ্জন সরকার প্রবর্ত্তিত এই নোতুন তত্ত্বের নাম ‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’– •Progressive utilisation Theory,  সংক্ষেপে যা ‘প্রাউট’ Pro-u-t—) নামেই পরিচিত৷

প্রাউটের মূলগত বৈশিষ্ট্য

প্রাউটের প্রধান বৈশিষ্ট্য হ’ল, এখানে ব্যষ্টি–স্বাধীনতা ও সমষ্টি স্বার্থের মধ্যে এক সুষম সমন্বয় সাধন করা হয়েছে৷

মানুষের জীবনের প্রধানতঃ দুটো দিক, একটা বস্তুগত দিক, আর একটা আত্মগত দিক৷ বস্তুগত দিক বলতে মানুষের বস্তুগত প্রয়োজন যেমন, অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান প্রভৃতি চাহিদা ও চাহিদা পূরণের দিককে বোঝায়৷ প্রাউটের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হ’ল, সমাজের প্রতিটি মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণের গ্যারাণ্ঢী প্রদান৷

আর আত্মগত দিক হ’ল, তার মানসিক দিক, নৈতিকতার দিক, আত্মিক পরিপূর্ণতা অর্জনের দিক৷ এরই ওপর নির্ভর করে তার নৈতিক, মানবিক ও আত্মিক মূল্যবোধ–যা মানুষের মনকে হীনতা, স্বার্থপরতা, লোভ ও শোষণের গণ্ডী থেকে মুক্ত করে তাকে মনুষ্যত্বের পূর্ণ মহিমায় মহিমান্বিত করে৷

এ্যাডাম স্মিথের ব্যষ্টি–স্বাতন্ত্রবাদ তথা ধনতন্ত্র বা কার্লমার্কসের সমষ্টিতন্ত্র তথা কম্যুনিজম–এই দুই দর্শনের মূলগত ত্রুটিগুলি হ’ল, প্রথমতঃ এই উভয় ক্ষেত্রেই কেন্দ্রিত অর্থনীতি Centralised economy) –কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে৷ ধনতন্ত্রে অর্থনৈতিক শক্তি কেন্দ্রীভূত হচ্ছে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের হাতে, আর মার্ক্স্বাদে অর্থনৈতিক শক্তি কেন্দ্রীভূত হচ্ছে মুষ্টিমেয় পার্টিনেতাদের হাতে৷ অর্থনৈতিক পরিকল্পনায়, নীতি নির্ধারণে, পরিচালনায় জনসাধারণের স্থান নেই৷ তার ফলে জনসাধারণের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটল না৷ দ্বিতীয়তঃ, উভয় তত্ত্ব মানুষের আত্মগত দিকটিকে অবহেলা করে কেবল বস্তুগত দিকটার ওপর তাদের দর্শনের সৌধ রচনা করেছে৷ তার ফলশ্রুতিতে দেখা দিয়েছে সেবাব্রতী, ত্যাগব্রতী নেতৃত্বের সংকট৷ জনসাধারণের নৈতিক অবক্ষয়ও চরম ভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে–যা অজস্র নব নব সমস্যার জন্ম দিয়েছে৷ আদর্শ সমাজরচনার সমস্ত প্রয়াস হয়েছে ব্যর্থ৷

প্রাউট দর্শনে মানুষের এই বস্তুগত ও আত্মগত দুই দিকটাকেই সমভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷ এই কারণেই ব্যষ্টিস্বাধীনতা ও সমষ্টি স্বার্থের মধ্যে সুষম সমন্বয় সাধন করা প্রাউটের পক্ষে সম্ভব হয়েছে, যা ধনতন্ত্র ও মার্কস্বাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি৷

প্রাউট দর্শন বিস্তারিত ভাবে চর্চা করলে প্রাউটের এই মৌলিক বৈশিষ্ট্য সহ অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলি যেমন সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে, তেমনি কেন প্রাউট সমাজের সর্বপ্রকার সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ–তা সহজেই বোধগম্য হবে৷