প্রেতলোক বন্ধ

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

প্রাচীনকালে বুদ্ধিজীবীদের ‘কোশস্থ’ বা ‘কায়স্থ’ বলা হত৷ এঁরা জ্ঞানের আক্ষরণের আড়ালে আত্মরক্ষা করার সুযোগ পেতেন৷ অবশ্য কায়স্থদের জন্যে করণ, করণিক, বিদ্যাস্ত্র ও সান্ধি–বিগ্রাহিক শব্দও চলত৷

পৌরাণিক গল্প অনুযায়ী প্রেতলোকের বা নরকের অধীশ্বর ছিলেন যমরাজ (Pluto)৷ তিনি মৃত্যুর দেবতা (God of death)৷ যমরাজ প্রেতলোকের তদারকি, হিসাব–নিকাশ (book-keeping) সবকিছুই বেশ ভালভাবেই করে যাচ্ছিলেন৷ কোথাও সামান্যতম খুঁত ছিল না৷ পাণ থেকে চুণ খসবার জো ছিল না৷ কিন্তু পৃথিবীতে জীবের ক্রমশঃ সংখ্যা বাড়ল, তাই মৃত্যুও বাড়ল৷ তদারকির কার্যে যমরাজকে সাহায্য করতেন তাঁর ভগিনী পানকৌড়িবাহিনী যমুনা৷ আর সুরক্ষা বিভাগের •Security õ± Watch-and-ward Department— মুখ্য আধিকারিক ছিলেন জনৈকা কুক্কুরী৷ তার নাম সরমা (‘সরমা’ শব্দের উত্তর ‘ষ্ণেয়’ প্রত্যয় করে ‘সারমেয়’৷ এর অর্থ কুকুর৷ ধরা হয় সব কুকুরই এই সারমেয়ের বংশধর)৷

দিন এগিয়ে চলল৷ মানুষ আর জীবজন্তুর সংখ্যা দ্রুতগতিতে ক্ষেড়ে চলল৷ যমরাজের পক্ষে এই বিরাট কর্ত্তব্য যথাযথভাবে প্রতিপালন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল৷ তিনি ব্রহ্মার কাছে আর্জি পেশ করলেন তাড়াতাড়ি যেন একটি নির্বাচকমণ্ডলী (Selection Board) তৈরী করে কিছু সংখ্যক যোগ্য কর্মচারীকে তাঁর কোটিতে (Department) পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷ এখানে পদোন্নয়নের সম্ভাবনা উজ্জ্বল৷ চিঠির পর চিঠি......রীমাইণ্ডারের পর রীমাইণ্ডার লিখেও ব্রহ্মার তরফ থেকে উত্তর আর আসে না৷ যমরাজ পদস্থ কর্মচারীদের ও.জি.এস. On Government Service) পাঠালেন ব্রহ্মার দরবারে৷ কিন্তু সেখানে এক এক কেরাণী এক এক ধরনের কথা বলতে লাগলেন৷ তাঁরা বললেন–বর্ত্তমানে সিকিউরিটি ব্যবস্থার এতই কড়াকড়ি যে ব্রহ্মার সঙ্গে আপনাদের সাক্ষাৎ হবে না৷ অফিসাররা ক্ষুণ্ণ হয়ে ফিরে এসে যমরাজকে সব কিছু জানালেন৷

যমরাজ বললেন–কী আমাকে নিয়ে এত হেনস্থা আমি যদি কিছুদিন নরক বন্ধ করে দি......প্রেতলোক বন্ধ করে দি তাহলে বাছাধনরা ঠ্যালা সামলাক্ষে কী করে আমাকে হেনস্থা করার আগে সাতশ’ বার ভেবে দেখা উচিত তার পরিণাম কী হতে পারে, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে

যমরাজ কিছুদিনের জন্যে মৃত্যু–ব্যবস্থা বন্ধ করে দিলেন৷ চারিদিকে গেল গেল রব–জীবজন্তুর ‘‘পদভারে কাঁপিছে মেদিনী’’৷ প্রাণীদের চাপে পড়ে আকাশ বাতাস ভেঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পৃথিবীর ওপর পড়ছে৷ গ্রহ–তারা–উপগ্রহ– ছায়াপথ সবাই মড়মড়িয়ে ভেঙ্গে হুড়মুড়িয়ে পৃথিবীর ওপর এসে পড়ছে৷ সে এক শোচনীয় পরিস্থিতি ওপর থেকে আকাশ ভেঙ্গে পড়লেও মানুষ–জীবজন্তু কেউই মরছে না৷ তারা থেঁতলে গিয়ে আহত হয়েও বেঁচে থাকছে, কারণ মৃত্যু–ব্যবস্থা এখন বন্ধ হয়ে গেছে৷

দেবতারা প্রমাদ গুণলেন৷ তাঁরা প্রকাশ্যেই প্রোটোকলের নিয়ম ভেঙ্গে এ ওকে বলতে শুরু করলেন–এত কষ্ট করে বাসুকি নাগের মন্থনরজ্জু দিয়ে সমুদ্র মন্থন করে অসুরদের ঠকিয়ে ঠাকিয়ে ফাঁকি দিয়ে অমৃত খেয়ে অমর হলুম৷ আর এখন কিনা মানুষ, জীবজন্তু–এমনকি নেংটি ইঁদুর–ছারপোকাও ফোকটে অমরত্ব লুটে নিচ্ছে৷ হায় হায় দেবতাদের দেবতাত্বের গৌরব আর রইল কি তাঁরা সবাই মিলে ব্রহ্মার কাছে ছুটে গেলেন৷

ব্রহ্মা বললেন–‘‘হ্যাঁ সবই দেখছি, সবই শুনছি, কিন্তু করবার কিছুই নেই৷ সীলেকশন বোর্ডের মতে এত কম মাইনে দিয়ে যোগ্য কর্মচারী পাওয়া যায় না৷ এই জন্যে কর্মী পাঠাতে পারছি না৷’’

দেবতারা বললেন–‘‘মহারাজ, যমরাজকে কর্মী দিতেই হবে, নইলে মহা প্রলয় হয়ে যাবে......মহতী বিনষ্টি হয়ে যাবে......সৃষ্টির অস্তিত্বের প্রাথমিক বিন্দুটি ধুয়ে মুছে শেষ হয়ে যাবে৷ নরক–কর্মচারীদের বেতনের হার বাড়িয়ে দিয়ে যমরাজকে সন্তুষ্ট করুন মহারাজ৷’’

ব্রহ্মা বললেন–‘‘অর্থকোটি (Finance Department) ব্যয় মঞ্জুর করবে তো’’

দেবতারা বললেন–‘‘নিশ্চয়ই করবে....আলবাৎ করবে......একশ’বার করবে৷ আমরাই তো রাজ্যসভা, লোকসভার সদস্য৷ আমরা বিনা ভোটেই এটিকে ‘পারিত’ (pass) করে দোব৷’’

ব্রহ্মা আশ্বস্ত হলেন৷ বললেন–‘‘দেখো, শেষকালে আমাকে যেন ডুবিও না৷ তীরে এসে তরী ডুবলে আমার নাকালের একশেষ হবে৷’’

দেবতারা গালে হাত দিয়ে জিব কেটে বললেন–‘‘তেমন কথাটি আদৌ ভাবক্ষেন না মহারাজ৷ আমরা আপনার একান্ত বশংবদ৷ মনে নেই, নির্বাচনের সময় আমরা আপনার সঙ্গে নির্বাচনী–জোট বেঁধেছিলুম৷’’

ব্রহ্মা বললেন–‘‘নিশ্চয় মনে আছে,......আলবৎ মনে আছে......একশ’বার মনে আছে৷’’

ব্রহ্মা তখন যমরাজকে ডেকে পাঠালেন৷ যমরাজ বলে পাঠালেন–তাঁর পক্ষে এখন যাওয়া সম্ভব নয়, কারণ সকাল থেকে তাঁর পিস্শাশুড়ীর বাঁ পায়ের কড়ে আঙ্গুলে ম্যালেরিয়া হয়েছে৷ তাই এখন তাঁর পক্ষে কয়েকদিন বাড়ী ছেড়ে বেরোনো সম্ভব নয়৷ ব্রহ্মা তখন নিজেই ছুটলেন যমালয়ে৷ তিনি গোছানো ভাষায় যমরাজকে বুঝিয়ে বললেন ও তাঁকে আশ্বাস দিলেন৷ যমরাজ বললেন–ভাল মাইনেয় ভাল কর্মচারী না হয় পেলুম কিন্তু ভাল তদারক না পেলে তো আর প্রতিষ্ঠান চলে না, রাজ্যও চলে না৷ আর যমালয়ের মত একটি বিশিষ্ট বনেদী প্রতিষ্ঠান তো চলতেই পারে না৷ ব্রহ্মা তখন তাঁর নিজের দেহের অর্থাৎ কায়ের অভ্যন্তর থেকে অর্থাৎ কায়স্থ একটি দিব্য পুরুষকে বার করে দিলেন৷ ব্রহ্মা যমরাজকে বললেন–যমরাজ, ইনি আমার প্রতিভু, ইনি আমার জ্ঞানকোশে নিহিত ছিলেন৷ তাই এঁর নাম কায়স্থ৷ এঁর এক হাতে থাকবে বজ্র যার সাহায্যে ইনি প্রেতদের ভয় দেখাবেন, আর এক হাতে থাকবে দণ্ড যার সাহায্যে ইনি প্রেতদের শাসন করবেন৷ আর এক হাতে থাকবে মস্যাধার (দোয়াত) ও আর এক হাতে থাকবে লেখনী (কলম)৷ এই দোয়াত–কলমের সাহায্যে ইনি প্রতিটি জীবের জন্যে নিউমারিক্যাল লেজার ও প্রাইস–লেজার রক্ষা করবেন৷ সেই লেজারে কে কবে জীবনে কোথায় কী করেছে তা আদ্যোপান্ত লিপিবদ্ধ থাকবে৷ সেদিকে কেউ একবার তাকালেই একটি জীবনেতিহাসের পূর্ণ আলেখ্য পেয়ে যাবে৷

এই আধিকারিকের নাম চিত্রগুপ্ত অর্থাৎ যাঁর চিত্র মানস জগতে গুপ্ত হয়েই আছে.... যাঁর বৌদ্ধিকতা অপরিসীম৷ এঁর নাম চিত্রগুপ্ত৷ ইনি ব্রাহ্মণের গুণযুক্ত ক্ষত্রিয় অথবা ক্ষত্রিয়ের গুণযুক্ত ব্রাহ্মণ৷ তাই ইনি ব্রহ্ম–ক্ষত্রিয়৷ চিত্রগুপ্ত মহারাজ চার হাতের হলেও কায়স্থদের কাউকেই আমি চার হাতের দেখিনি৷

কায়স্থদের আদিপুরুষ এই চিত্রগুপ্তের ছিল তিন পত্নী ও দ্বাদশ পুত্র৷ তিন পত্নীর নাম–ক্রান্তি, ক্লান্তি, ও রমা৷ পুত্রদের নাম–চারু, সুচারু, চিত্র, চিত্রচারু, অরুণ, অতীন্দ্রিয়, হিমবান, মতিমান, ভানু, বিভানু, বিশ্বভানু, বীর্য্যভানু৷ এঁদের থেকেই আসছে দ্বাদশ শ্রেণীর কায়স্থ–অম্বষ্ঠ (দাশঘোষ), ভট্টনাগর (বসু), সখসেনা (মিত্র), শ্রীবাস্তব (দত্ত), মাথুর (গুহ), গৌড়, সূর্যধ্বজ, বাল্মীকি, কুলশ্রেষ্ঠ, অষ্ঠানা, নিগম, করণ৷ এর বাইরে রয়েছেন আরও সাত প্রকারের কায়স্থ৷ তাঁরা চিত্রগুপ্ত–সঞ্জাত নন৷ এঁরা হলেন উপকায়স্থ (ভাণ্ডারী, পুরকায়স্থ (পুরকায়েৎ), পত্তনপ্রভু কায়স্থ (সূর্যবংশীয় রাজা অশ্বপতির বংশধর), দমনপ্রভু কায়স্থ (চন্দ্রবংশীয় রাজা কামপতির পুত্র), ধ্রুবপ্রভু কায়স্থ (স্বনামখ্যাত ভক্ত ধ্রুবের বংশধর), আদি কায়স্থ (আইকত) ও রায় কায়স্থ (রায়কায়েৎ বা রাইকত)৷

যাই হোক্, গল্প এখানেই শেষ হল৷ তা হলে কায়স্থ কী করে এল তার পৌরাণিক কথাও তোমরা জেনে গেলে৷