রাজনীতি চলুক জনস্বার্থে

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

পূর্ব প্রকাশিতের পর,

একটা সময় কালচক্রেই এগিয়ে এল যখন মানুষের মনীষা তথা মননশীলতায় এসে ধাক্কা লেগেছিল যে অফি বলে, পেশী বলে অথবা মসী বলে--- অর্থাৎ ক্ষাত্রশক্তির তরবারির আঘাতে তথা আজকের  যুগে রাইফেল-পিস্তল গোলা-বারুদ পুড়িয়ে ধন-জনের বিপুল ঘটিয়ে অথবা স্রেফ গুণ্ডা-মস্তানের কিংবা এযুগে দলীয় ক্যাডারদের দাপট আর দৌরাত্ম্য দিয়ে অথবা বিদজ্জনদের ও চালাক-চতুর নেতাগোছের কথার  মারপ্যাচে এ যুগের  মাইকবাজি, চটকদার কথার ফুলঝুরি দিয়ে, মুখে বড় বড় ভাষণ বা শ্লোগান শুনিয়ে, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনসাধারণকে ঠকিয়ে---এসবের কোনটা দিয়েই কখনও সাধারণ মানুষদের ভাগ্যবদল যেহেতু ঘটছে না, তখন আর কী  উপায়ই বা খুঁজে বের করা যায়, তা ভেবেই স্থির করা  প্রয়োজন৷ ইতিহাসই আমাদের জানান দিচ্ছে যে, অতীতের পৃথিবীতে ভারতবর্ষেই লিচ্ছবী বংশীয় লোকেরা স্বতস্ফূর্তভাবে তাদের পছন্দমত লোককে মনোনীত করেছিলেন  তাদের শাসকরূপে৷ ইতিহাস তারও পরে আরেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রেখেছে যে বাঙলায় রাজা শশাঙ্কের তিরোধানের পর, কিছুকাল যাবৎ সমাজে মাৎস্যন্যায় বিরাজ করছিল তখন হিন্দুরাজাদের  মধ্যে কেউই ছিলেন না রাজ্যশাসনের হাল সামলাবার মতো৷ তখনও বাঙলার জনগণই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সম্মিলিতভাবে তারা তাদের রাজারূপে নির্বাচনে করেছিলেন গোপালকে৷ বস্তুতঃ, এই যে লিচ্ছবি বংশের নতা- নির্বাচন শাসকরূপে ও জনগণ কর্তৃক গোপালকে  সিংহাসনে বসাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ--- এদু’টো দৃষ্টান্তই হচ্ছে প্রকৃত গণতন্ত্রের নিখুঁত উদাহরণ৷

তাই, এ নিরিখেই বলতে হচ্ছে যে, বিগত ১৯৫২ সাল থেকে আমাদের ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক বোট-প্রথার যে প্রহসন চলছে, আর এর পরিণতিতে এযাবৎ যত সব দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে, এরপরও কি বুদ্ধিমান, বিচারশীলতা ও কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের  পক্ষেই যুক্তিসঙ্গত হবে সজ্ঞানে মন্তব্য প্রকাশ করার যে---হ্যাঁ, আমাদের দেশে গণতন্ত্র যথার্থই সার্থক প্রতিপন্ন হয়েছে? আমি জানি যে, আমার অনুরূপ এ মন্তব্য প্রকাশের  ফলে অনেকেই নাক কোঁচকাবেন বা চোখও রগড়াবেন কিংবা দাঁতও খিঁচাবেন রাগে কটমট করতে করতে, হয়তো বা হাতও বাঁকিয়ে মুষ্টিকে দৃঢ় করতে যাবেন ঘুষি মারার মহড়া দেখিয়ে রাজনীতিকদের কেউ কেউ আইনী পরামর্শও নিতে চাইবেন এই মন্তব্য কারীকে ‘দেশদ্রোহী’ বলে ফাঁসানো যায় কিনা তার জন্যে৷ তাহলে শুনুন, এ প্রসঙ্গে একটা মাত্রই যুক্তি দাঁড় করাচ্ছি অসংখ্য যুক্তিরাশি থাকা সত্ত্বেও৷ কালো টাকা উদ্ধার করবেন বলে যে দেশের নোটবন্দী করা হয়েছিল সেই কালো টাকা উদ্ধারের কতদূর কী হল? সেই তারাই যখন ভারতের কর্ণধার সেজে বিদেশে সফরে গিয়ে সরকারী কোষের ব্যয় দেখান আর বহু কোটি টাকা দামের গাড়ী চড়ে ঘুরেন, তাদের চোখেই তাপ্পি লাগিয়ে রেখে দেশের  পুঁজিপতিদের দিয়ে ব্যাংকে ফাঁকা করে টাকা তুলে নিয়ে বেপাত্তা হয়ে বহাল তবিয়তে গা ঢাকা দিয়ে দিব্যি স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনযাপন করার সুযোগ পেয়ে যান আর বিনিময়ে দেশের ভোগ্যপণ্যের মূল্যস্তর জনসাধারণের গড় ক্রয়ক্ষমতার কয়েকগুণ উধের্ব চড়ে যায়---গরীব জনতার জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠলেও তাদের শোণানো হয় যে--- ডিজিটাল ইণ্ডিয়ায় নাকি লোকহিত, রাষ্ট্রহিত, উদ্যোগহিত ইত্যাদি চলছে আর-এরপরও সেইসব ধূর্ত স্বভাবের কর্তা-ব্যষ্টিরাই জনসমক্ষে মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাইক যোগে  ফাকুম ফাকুম শুণিয়ে যেতে পারেন নির্বিবাদে, অথচ পেটের খিদে আর বুকের জ্বালার কথা একটা  নাগরিকও খুলে বলতে চান না,  সেই দেশটায় গণতন্ত্রের লেশমাত্র রয়েছে, কোনযুক্তিতে কোন আদর্শ পিতামাতার সৎপুত্র বা কন্যা মন্তব্য করতে পারবেন বলে কী করে বিশ্বাস রাখা সঙ্গত হবে?

তবে হ্যাঁ, কারো কারোর মতে পলিটিশিয়ানরা  নাকি  স্বভাব চতুরই হন বা তাদের সেরকম হতেই হয়৷ তাই যদি সঠিক হয়, তাহলে প্রশ্ণ থেকেই যাচ্ছে, সেইসব স্বভাব-চতুর পলিটিশিয়ানদের দ্বারা বিগত  চুয়াত্তর বছরে যদি প্রবহমান গণতন্ত্রের দ্বারা ধনীদের সমৃদ্ধি হয়ে থাকে দশগুণ আর বিনিময়ে দরিদ্রের ভরাডুবি হয়ে থাকে কমপক্ষেও বিশগুণ, তাহলে এবাম্বিধ গণতন্ত্রকে যদিও বা  তথাকথিত গণতন্ত্রের ধবজাধারীরা গণতন্ত্রের বদলে, ‘ধনতন্ত্র’ বলে স্বীকারোক্তি করতে লজ্জাবোধ করলেও নিঃসন্দেহে তো ‘ধনীতন্ত্র’ বলতে পারেন৷ তাহলেও তো সত্যের অপলাপ হয় না আর গণতন্ত্রেরও মুখে কলংক লেপনের  প্রশ্ণটা আসে না৷ কিন্তু ওই দেশপ্রেমিকদের ছদ্মবেশীধারী দেশমাত্র তথা মানবতার শত্রুরা কিছুতেই তো সেই  কথায় কর্ণপাত করতে চান না৷  কেননা, শাস্ত্রই বলেছে---‘উপদেশো হি মূর্খনাং প্রকোপায় ন শান্তয়ে’৷ মূর্খ আর মদমত্ত দাম্ভিকে নাকি সমান সমান৷ তাই-ই হবে হয়তো!

এবারে ধর্মপ্রাণ এই ভারতবর্ষ সম্পর্কেও ছোট্ট একটা মনোব্যাথার কথার  উল্লেখ রেখে  নিবন্ধটি শেষ করতে  চাইছি৷ এদেশে দেব-দেবী, দেবালয়, মঠ-মন্দির-মসজিদ-গীর্র্জ-বিহার ও তীর্থ স্থানাদির অন্ত কোনদিনই ছিল না আর এখনও নেই৷ দ্বিতীয়তঃ লোহিত, শ্বেত, গৈরিক বহুবর্ণের বসনধারী, কৌপীন ও কটিবস্ত্র পরিহিত ত্রিশূলধারী, জটাধারী, রুদ্রাক্ষমালা, তুলসীমালা, তস্‌বিরমালা,হাতে কবচ,কেউ বা দিগম্বর---ইত্যাদি হরেক রকমের সাধু-সন্তদের, ভীড় সর্বদাই লেগে রয়েছে সারা দেশব্যাপী৷ কোন কোন সাধু-সংস্থার কর্মীরা আবার বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের ন্যায় বৈপ্লবিক চিন্তাধারা ও ফেরী করতে ছাড়েন না৷ কিন্তু, প্রশ্ণ হলঃ---এত সবের পরেও দেশটার কতটুকু কী হল, সত্যিকারের মানুষের বন্ধু কারা রয়েছেন?