রাজনীতি চলুক জনস্বার্থে

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

অতীতকালে রাজ-রাজড়া ও নবাব-বাদশাহ সুলতানদের শাসনামলে রাজনীতির সংজ্ঞা-নির্ধারণে ‘রাজ্ঞঃ নীতি রাজনীতি’  বলা হত কি না আমার জানা নেই৷ তবে যতদূর বইপত্র পড়ে কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখ থেকে যতদূর শুণেছি, তা  থেকেই বলতে পারি যে সুদূর অতীতকালে শূদ্র-যুগের শেষপ্রান্তে  এসে  সমাজে কিছুসংখ্যক মানুষ সমাজের দায়িত্ব পালনে নিজেরাই  এগিয়ে এসে দায়িত্বের গুরুভার কাধে নিয়ে সমাজরক্ষা ও পালকরূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন৷ আর সাধারণ গণমানুষ তখন জীবনের  নিরাপত্তা লাভের কথা ভেবেই অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে সমাজ রক্ষার  কাজে ব্রতীদের সমর্থন জানিয়েছিলেন৷ আর, এভাবেই শূদ্রযুগকে বিদায় জানিয়ে সমাজব্যবস্থায় ক্ষত্রিয়যুগের সূচনা ঘটেছিল৷ তখন সর্দার তথা মুরুবিব ভূমিকায় ব্যাষ্টিকেই ‘রাজা’ আখ্যায় মানুষ মান্যতা জানাল৷ তারপর সমাজে আবির্ভাব ঘটল কিছু বুদ্ধিজীবী গোছের লোকদের৷ তারা ভেবেছিলেন, সাধারণ মানুষদের প্রতিপালন ও রক্ষার কাজে যারা রয়েছে তারাই বহাল থাকুন তবে আমরা তাদের বুদ্ধির পরমর্শ যোগান দিয়ে যাব৷ এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর লোকরাই হয়েছিলেন সেইযুগে পাদ্রী-পুরোহিত-মোল্লা৷ তাদেরই বলা হয়েছে বিপ্রশ্রেণী বা ইনটেলেকচুয়্যাল ক্লাস৷ ক্রমশঃ এযুগেরও অবমান ঘটবার আগে-ভাগেই আরেকটা শ্রেণীর মানুষদের উত্থান  দেখা দিয়েছিল সমাজে, যারা শূদ্রদের মত গায়ে গতরে খেটে  খাওয়াটা অস্বীকার করলেন ক্ষত্রিয়দের মত শাসনকার্য ও সুরক্ষার দায়িত্ব পালনকেও অপছন্দ করলেন এমনকি শাসককুলকে প্রয়োজনীয় বুদ্ধির  যোগান দিয়ে যেতে উৎসাহ পেলেন না৷ বরং তারা চেয়েছিলেন যে এমন কিছু উপায় বের করতে হবে, যার সহায়তায় উক্ত শূদ্র, ক্ষত্রিয় আর বিপ্র---এ তিন শ্রেণীর মানুষকে সহজে বশে আনা যায় ও বশীভূত অনুগত করেই রাখা চলে৷ আর, এই শ্রেণীর লোকেরা তাই চেয়েছিলেন পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ উপার্জন করে যেতে, যাতে করে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে যথেচ্ছভাবেই টাকা-পয়সা কিংবা ভূ-সম্প্রত্তি, ভোগ্যসামগ্রী ইত্যাদির যোগান চালানো সম্ভব হয়ে উঠে অন্যান্য তিনশ্রেণীর মানুষদের ক্ষুধার্ত  ও পীড়িত মুখগুলোর সামনে ‘হরির লুঠের বাতাসা’-র মত করেই টাকা পয়সার বান্ডিল এনে খোলা দেওয়া যায়৷ বস্তুতঃ, এই শোষক্ত শ্রেণীর মানুষরাই যেহেতু বিষয় আশ্রয় নিয়েই বেশী ব্যস্ত থাকতেন সে কারণে তাদের নামই পড়ে গেল বৈশ্য-শ্রেণী বলে৷ আর, তাই মানসিকতার বিচারে যুগ যুগ ধরে এদের প্রাধান্যই সমাজে মান্যতা বলে কদর পেয়ে চলেছে৷ এমনকি, আজকের এই একবিংশ শতকেও সমাজের সর্বত্র ধনপতি কুবেরদের ভূমির বড় অধিকারী ভূ-স্বামী জমিদার-জায়গীরদারদের আর বিদ্যাবত্তায় প্রাগসর ও চতুরালি-চালুর্যপূর্ণ বাক সর্বস্ব ভোগ-বিলাসী আর পূর্বোক্তদের সর্ববস্থায় ফায়-ফরমান-খাটা ও পেশীবলে বলীয়মান লোকদেরই কদর তুলনামূলকভাবে বেশী৷ কিন্তু, এদের সবার ঊধের্ব বর্তমানে দিব্যি অবস্থানে রয়েছেন বৈশ্যশ্রেণীভুক্তরা---বর্তমানে যাদের সামাজিক পরিস্থিতি মিলেনীয়ার, বিলেনীয়ার, ত্রিলেনীয়ার আর বহুজাতিক গোষ্ঠীর মূলধনের যোগানদাতা করপোরেট সংস্থা সমূহের মালিকানা যাদের মুঠোয় রয়ে গেছে৷ এক কথায়, আজকের সমাজ-ব্যবস্থায় বিত্তবানদেরই একচেটিয়া রমরমা৷ কারণ, ‘কাঞ্চনম্‌ সর্বে গুণা’ আশ্রয়ন্তি’ অথবা ‘টাকা দিয়ে এযুগে সবই কেনা যায়---নারীকেও’৷ আর এটাই হল এযুগের সমাজব্যবস্থার অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য৷ আর, একই কারণে যারা গোটাসমাজব্যবস্থায় প্রদীপের পিলসুজ সদৃশ বলেই ওরা কখনও আলোকিত হবারই সুযোগ পান না৷

উক্ত পিলসুজ-সদৃশ মানুষরাই হলেন---সমাজে অন্নেরও রসদের উৎপাদক ও যোগানদাতারা---কৃষিজীবী ও কৃষিশ্রমিকরা আবহমানকাল ধরেই এরা সমাজের খাদ্য উৎপাদন করে আর যোগান দিয়ে চলে, অথচ এদের দু’বেলা পেটভরা খাবারই জোটে না, মুখরোচক খাবার তো দূরের কথা৷ উক্ত পিলসুজ-সদৃশ আরও রয়েছেন শ্রমজীবী ও গায়ে গতরে খেটে যারা কুলি-মজদুর, মেথর-স্যুইপার প্রমুখরা৷ এরাও দিনরাত আধপেটা খেয়ে, অপুষ্টিতে ভুগে নালা-নর্দমা, পথঘাট-রাস্তা  সাফাই রাখে আর নিজেরাই পয়সা আর সময় দুয়েরই অভাবে অপরিচ্ছন্ন থাকে৷ আর যারা বিত্তশালী বা মহাজনদের কারবারের বোঝায় গাড়ী টানে বা মোট বয়ে নেয় অথবা অভিজাতদের  বিলাস-সামগ্রীর তথা প্রমোদ-আয়াসের সামগ্রীর যোগান দিয়ে জীবিকা চালায়, তাদের মত লোকদের অধিকাংশেরই হয় মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই, কিংবা লজ্জা নিবারণের  আবরণটুকু সঠিকমত গায়ে জোটে না৷ আর স্বভাবতঃই এযুগের মহার্ঘ ওষুধের যোগান ও  জটিল রোগ সারাতে যে বিশেষজ্ঞ ধন্বন্তরীতে মোটারকমের বিজিট দিয়ে আর আধুনিক ব্যয়সাপেক্ষ রোগ-নির্ণায়ক পরীক্ষাদির ব্যবস্থারও প্রয়োজন পড়ে, যেসব কোনটারই পয়সার পকেট তাদের থাকে না বলেই এদের অতি সস্তায় অনায়াসে পরলোকের টিকিট কেটে চলে যেতে হয় অতিসুন্দর এ পৃথিবীর সমস্ত মায়া কাটিয়ে৷ এটাই মানবসমাজের  যুগ যুগ ধরে বাস্তবচিত্র৷ (ক্রমশঃ)