রাজনীতির কর্কট ব্যাধি

লেখক
একর্ষি

ভারতীয় রাজনীতি জটিল কর্কটব্যাধিতে আক্রান্ত৷ তবে এর ভাব-গতিক বোঝার আগে ‘রাজনীতি’ কথাটির ‘পদ পরিচয়’ নেওয়া যাক৷ পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতেরা যা ই বলুননা কেন ভারতীয় জীবনদর্শন তথা  প্রাণধর্ম এবং আদর্শ মানবসমাজ ও তার দর্শন অনুসারে রাজনীতি হ’ল নীতির রাজা’৷ অর্থাৎ রাজনীতি হ’ল মানব সমাজের বা রাষ্ট্রের সেই শ্রেষ্ঠ নীতি বা অতুলনীয় দিক নির্দেশনা যা বাস্তবতায় বিশ্বস্ত, ব্যবহারিক, বৈজ্ঞানিক মনন-পোষিত ও মানুষের সার্বিক কল্যাণে (ভৌতিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক) প্রয়োগভৌমিক৷ ‘রাজনীতি’ শব্দটি একটি সমাজবদ্ধ পদ৷ নীতির রাজা  রাজনীতি৷ বাংলা ব্যাকরণে তৎপুরুষ সমাসে ‘শ্রেষ্ঠ’ অর্থে ‘রাজা’ পদটি ব্যাসবাক্যের শেষেরে দিকে বসে৷ অর্থাৎ পূর্বনিপাত ও পরনিপাত হয়--- মানে হ’ল সমাসে সমস্ত পদে পরের পদ পূর্বে বসে, আর পূর্বের পদ পরে বসে৷ ‘রাজনীতি’ কথাটির আভিধানিক অর্থ ও বুৎপত্তিগত অর্থ একই৷ তাহলে তো যারা রাজনীতি করবেন অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ নীতিকে বাস্তবে রূপ দেবেন---নেতা থেকে কর্মী সদস্য সমর্থক সকলকেই তো ব্যষ্টি জীবনে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতেই হবে! অর্থাৎ সুস্থ-সক্ষম-সপ্রতিভ শরীর, বৌদ্ধিকতায় ঋদ্ধ ও আধ্যাত্মিকতায় সমুন্নত হওয়াটা বাঞ্ছনীয় নয় কী? নিজে অঙ্ক শিখলে-জানলে তবেই না অন্যকে অঙ্ক শেখানো যাবে! কথাগুলো হাতে থাক৷ এবার দেখা যাক ভারতীয় রাজনীতির হালহকিকত৷

শুরুতেই স্মরণ করা যাক--- ভারতবর্ষের সংবিধান স্বীকৃত রাজনৈতিক  দিশা হ’ল গণতন্ত্র৷ বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র৷ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হ’ল ভারতবর্ষ৷ বলা হয় গণতান্ত্রিক সরকার ‘‘জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের শাসন৷ নয় নয় পরে ৭৫ বৎসর কাটতে চলল, অথচ নিন্দুকেরা, বিজ্ঞজনেরা বলছেন বর্তমানে ভারতবর্ষে গণতন্ত্রের ওই ধারণাটা পালটে দাঁড়িয়েছে--- বোকাতন্ত্র-ধোঁকাতন্ত্র৷ --- ‘‘বোকার দ্বারা, বোকার জন্য, বোকার শাসন৷’’ কিন্তু কেন এই বিড়ম্বনা-বিপত্তি-ব্যঙ্গবিদ্রুপ!

এখন ময়নাতদন্ত করা যাক৷

(১) সবার আগে বলতে হয়--- যেখানে কোনপ্রকার শোষণ নেই একমাত্র সেখানেই গণতন্ত্র ফলপ্রসূ হ’তে পারে৷ বর্তমান ভারতবর্ষে কি সেই অবস্থা আছে? নেই৷ আসলে মানুষকে এসব দিতে গেলে বা গণতন্ত্র কে ফলপ্রসু করতে কতগুলো শর্তপূরণের নিশ্চিততা ও আবশ্যকতা দরকার৷ যেমন

(ক) প্রতিটি মানুষের জীবনেই কতকগুলো নূ্যনতম প্রয়োজনীয়তা (খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা)--- আছে, আর আছে ওই সঙ্গে  অন্যান্য ক্ষেত্রেও সর্বাধিক সুখ-সুবিধা অধিকারের-বাসনা ও সেগুলো পূরণ করার গ্যারান্টি থাকা দরকার৷ আরও মনে রাখা দরকার--- দেশ-কাল-পাত্রের প্রভেদ অনুযায়ী নিম্নতম প্রয়োজনীয়তার হেরফের হবে, নিম্নতম প্রয়োজনীয়তা ও সর্বাধিক  সুখ-সুবিধা দিন দিন বেড়েই চলবে৷ আমাদের দেশে কি তা আছে? নেই!

(খ) দেশে গণতন্ত্র সফল হ’তে গেলে দেশের মোট জনসংখ্যার কমপক্ষে শতকরা একান্ন শতাংশ মানুষকে সৎ নীতিবাদী হ’তে হবে৷ বর্তমান ভারতবর্ষের অবস্থা কেমন না ঠগ বাছতে গাঁ উজার৷

(গ) দেশের মোট জনসংখ্যার কমপক্ষে শতকরা একান্ন শতাংশ নাগরিককে শিক্ষিত হতে হবে, তাদের জনশিক্ষা থাকতে হবে৷ নিরক্ষরতার হার কত? এ তো তুছ ব্যাপার! বহু তথাকথিত ডিগ্রীধারী শিক্ষিত জনের মধ্যে কত জন প্রকৃত শিক্ষিত তা গবেষকরাই বলতে পারেন৷

(ঘ) কমপক্ষে মোট জনসংখ্যার শতকরা একান্ন শতাংশ মানুষকে, অর্থাৎ অর্ধেকের বেশী মানুষকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ হ’তে হবে৷ সাধারণ মানুষ ও তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের কথা ছেড়েই দেয়া গেল, ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চে যাদের প্রত্যক্ষ-সক্রীয় পদচারণা সেই রাজনীতিকদের মধ্যে (নেতা থেকে কর্মী ও সমর্থক) কতজন ওই চেতনা-সমৃদ্ধ তা ভারতের  ইলেকশন কমিশন কে জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে৷ ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে উপর্যুক্ত শর্তগুলোর কথা বিচার-বিশ্লেষণ করলে, ও শুরু থেকে এ পর্যন্ত লোকসভা  ও রাজ্যে রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে বুঝতে বাকী থাকে না যে ভারতবর্ষের জনগণকে গণতন্ত্রের উপযোগী করে তৈরী না করেই তাদের ওপর গণতন্ত্র চাপিয়ে দেয়া হয়েছে৷ ফলতঃ ভারতীয় গণতন্ত্র বোকাতন্ত্র-ধোঁকাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে৷ এজন্য বোধহয়, কথিত আছে৷ পশ্চিমের কোন সাংবাদিক আজাদহিন্দ ফৌজের সর্বাধিকনায়ক নেতাজীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে স্বাধীনতার পর তিনি দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করবেন কিনা৷ উত্তরে নেতাজী নাকি বলেছিলেন যে আগে তিনি সামরিক শাসনের অধীনে অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষাদি নিশ্চিতিত করে দেশের মানুষের জাতীয় চরিত্র গঠন করবেন তারপর দেশকে গণতন্ত্র উপহার দেবেন৷ বস্তুতঃ গণতন্ত্রের একটি মূল্যবান, আলোকিত ও  পবিত্র আভোগ হল দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থের প্রতি সাধারণ নাগরিক ও রাজনৈতিক দল  ও নেতাদের দায়বদ্ধতা৷ প্রসঙ্গক্রমে নবম লোকসভার শেষ অধিবেশনের শেষ দিন---‘‘কিছুক্ষণ পরেই লোকসভা ভেঙে দেয়া হবে৷ আমাদের মহামান্য জনপ্রতিনিধিরা কী করেছিলেন? সাংসদরা সর্বসম্মতভাবে তাঁদের পেনশনের হার বাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করেছিলেন৷ কিন্তু সংবিধানের ১১৭/১ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ছাড়া আর্থিক দায় সংক্রান্ত কোন প্রস্তাব পেশ করা যায় না৷ লোকসভা যে ভেঙে দেয়া হবে সেটা যেমন তাঁরা ধর্তব্য মনে করেন নি, তেমনি পেনশন বাড়ানোর চেষ্টাটা যে সংবিধান বিরোধী তাও গ্রাহ্য করেননি৷

কী নির্লজ্জ সঙ্কীর্ণচিত্ততা ও স্বার্থপরতা! আসলে ভারতে গণতন্ত্র নয়, ভারতে রাজনীতি মানে ক্ষমতার রাজনীতি৷ ভারতে খুব কম নেতাই আজ তিনি যে দলে আছেন আর যে দলের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতায় যাবার পথ করে নিতে পারেন তার কথা ছাড়া দেশের কথা ভাবেন৷---ভারতের জনৈক প্রাক্তন বিচারপতি৷ (ক্রমশঃ)