রাম-মন্দির নির্মাণে নিধি-সংগ্রহ

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

আমাদের শাস্ত্র বলছে ঃ--- ‘‘মনঃ এব মনুষ্যাণ মুক্তির কারণ৷ মন-প্রধান জীব বলেই মানুষ-প্রজাতি জীবের নাম হয়েছে---মানুষ বা মনুষ্য বা মানব৷ আবার বলা হয়েছে ‘‘পাশবদ্ধো ভবেৎ জীৰঃ পাশমুক্তো ভবেৎ শিবঃ৷’’ অর্থাৎ যতক্ষণ প্রকৃতির তথা সত্ত্বঃ রজঃ তমঃ এই গুণত্রয়, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ কালের এই ত্রিস্তরের ও স্থানাদির  পরিভূর মধ্যে যে প্রাণবন্ত সত্ত্বার আবির্ভাব রয়েছে সে সকলই ‘জীব’ রূপে আখ্যায়িত হবার যোগ্য৷ লতা-গুল্ম- কীট-পতঙ্গাদি --- উদ্ভিদেরাও চেতনাসত্ত্বা তবে লতা গুল্ম-উদ্ভিদের আরেকটি পরিচিত স্থাবর বলে,যেক্ষেত্রে কীটপতঙ্গাদি থেকে সমস্ত জগৎসহ মানুষকেও বলা হচ্ছে জঙ্গম তথা ‘‘জীব’’ বলে৷ মূলতঃ বস্তুজগৎ, সমগ্র জীব জগৎ ও উদ্ভিদ জগৎ নিয়েই বিদ্যমান রয়েছে আমাদের সৃষ্টিজগৎ আর বিশাল এই সৃষ্টিজগতের একমাত্র স্রষ্টা---পরমস্রষ্টা তথা সুপ্রীম ফাদার হচ্ছেন পরমেশ্বর/পরমব্রহ্ম/পরমপুরুষ স্বয়ং৷ উল্লেখ্য যে, পরমেশ্বর বলতে বোঝায় যিনি সকল ঈশ্বরদের  ঈশ্বর---দেবতাদের ও দেবতা বা আদিদেব মহেশ্বর বা মহাদেব৷ বৈদিক ব্রহ্ম-শব্দের মানে হচ্ছে বিরাট৷ তাই পরমব্রহ্ম বলতে বোঝায় যিনি এত বিরাটকে তার কূল-কিনারা নেই, সীমা-পরিসীমা নেই---যাঁর কোন আদি-অন্ত বা সৃষ্টি বিনাশও নেই৷ তিনি এতটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে তাকে মানসশক্তি তথা মন দ্বারাও মাপা যায় না--- তিনি মনেরও রাজা বলে মনকে অলক্ষ্যে পরিচালনা করে থাকেন তাঁরই ভূমা-মন বা কস্‌মিক মাইণ্ডের দ্বারা৷ তিনি অচিন্ত্যনীয় সত্তা অর্থাৎ চৈতন্যরূপ ঘনসত্ত্বা বা সুপ্রীম কন্‌শাসনেস৷ তাই  তাঁর আরেক পরিচিতি ‘পরমপুরুষ’ বলে৷ বস্তুতঃ ‘‘পুরুষ’’ কথাটির মানে সংস্কৃতে বোঝায় কনশাসনেস বা চৈতন্য সত্ত্বা৷ এই চৈতন্যসত্ত্বারই মানসধাতু--- সঞ্জাত এই অসীম অনন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তথা ইয়ূনিবার্স৷ এই সুবিশাল ইয়ূনিবার্স তাঁরই সঙ্কল্পজাত ভূমা-মনের দ্বারা বিধৃত৷

পরমপুরুষের অসংখ্য নাম, রূপ৷ কারণ তিনি ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্‌’ সত্ত্বা হয়েও বহুধা পল্লবিত৷ অসংখ্যভাবে বিরাজিত তিনি প্রকৃতির আবদ্ধ নন বলেই গুণান্বিত নন, রূপান্বিত নন বরং তিনিই প্রকৃতিরও একমাত্র নিয়ন্ত্রক৷ তিনি  কালাধীশ বলেই সময়েরও পরিমাপের বাইরে৷ সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই তাঁর মনের ভেতরে রয়েছে বলে তিনি নির্দিষ্ট কোন জায়গায় আবদ্ধ হতে বা থাকতে পারেন না৷

তাইতো শাস্ত্রে বলেছে--- সর্বং খলু ইদং (খল্বিদং) ব্রহ্ম৷ অথচ তিনি এতটাই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণু-আকারে বিদ্যমান যে, ইলেকট্রন-বাইট্রাম (অণুজীবৎ, মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার ওরফে আধ্যাত্মিক গুরু শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী কর্তৃক  আবিষৃকত মাইক্রোবাইটাম দিয়ে একটি পরমাণু কণা রচিত সেই মাইক্রোবাইটারাও ভূমা-মনেরই সঞ্জাতমাত্র৷ সুতরাং তাঁর ক্ষুদ্রত্বের মাত্রাও মনুষ্যকৃত পরিমাপমাত্রার বাইরে৷ আর এই ক্ষুদ্রত্ব-বৃহতত্ত্ব নিবন্ধন তিনি ওতযোগে প্রতিটি সৃষ্টি -সত্তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন আবার প্রোতযোগে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকেও ধারণ করে রয়েছেন৷ এক কথা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটাই তাঁর শরীর বলতে হচ্ছে৷ তাই, সেই সত্ত্বাকে কোন ক্ষুদ্র গন্ডীতে আবদ্ধ করে রাখা বা এরূপ চেষ্টা করাটা মানুষের শুধু অজ্ঞতা, কুসংস্কার,ভাবজড়তা বা ডগমা কূপমণ্ডুকতাই নয়--- মানব-বুদ্ধির বিফলতা ও মানব -মস্তিষ্কের দুর্বলতা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না৷  মনে রাখতে হবে যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু্‌ই চৈতন্যের রূপায়িত বিকাশমাত্র৷

পরম পুরুষের এক নাম শিব৷ শিব কথার মানে চিরকল্যাণকর---মঙ্গলময় ও করুণাময়৷ এজন্যেই বলা হয়ে থাকে---সত্যম (যিনি অব্যয় অক্ষয় অজড় শাশ্বত অস্তিত্ববাকে) শিবম্‌ (যিনি চিরকল্যাণকর ও আশুতোষ) সুন্দরম্‌ (যিনি সমগ্র সৌন্দর্যে) আকর বিশেষ--- নিষ্কলূষ নির্মলসত্তা)৷

পরমপুরুষেরই আরেক নাম হচ্ছে কৃষ্ণ৷ সংস্কৃত ভাষায়  ‘কৃষ্ণ’ শব্দেরও তিনটে মানে রয়েছে৷ যথাঃ---(১) কৃষ---ধাতু থেকে ‘কৃষ্ণ’ হচ্ছে যিনি সর্বদা সমগ্র সৃষ্টি সত্তাকেই তাঁর পানে আকর্ষণ করে চলেছেন৷ (২) ‘কৃষ্ণ’ শব্দের দ্বিতীয় মানে হচ্ছে পরম চৈতন্যসত্ত্বা বা সুপ্রীম কনশাসনেস---যিনি সমগ্র সৃষ্টিরই মূলে রয়েছেন৷ (৩) কৃষ্ণ--শব্দের আরেক মানে হচ্ছে---‘কৃষিভূঃ’৷ কৃষি-কথাটির মানে ‘তুমি রয়েছ’ আর ‘ভূঃ’ কথাটিতে বোঝায় ‘আমি রয়েছি৷’ অর্থাৎ ‘কৃষিভূর’ কথার পূর্ণ মানে হচ্ছে---‘তুমি আছ তাই  আমিও রয়েছি আর তুমি না থাকলে আমিও অস্তিত্বহীন৷ কথাটি কথাটি অতীব গূড়ার্থপূর্ণ৷ এছাড়া, মনে রাখতে হবে যে শিবের যেমন দার্শনিক (ফিলজফিক্যাল), জীব-বৈজ্ঞানিক (বাইওলজিক্যাল) ও ঐতিহাসিক (হিষ্টোরিক্যাল)--- তিনটে দিক রয়েছে তদ্রূপ শ্রীকৃষ্ণেরও তিনটে দিকই রয়েছে৷ আরও রয়েছে শ্রীকৃষ্ণের দুই ভূমিকা যুগ প্রয়োজনে যা’ তিনি করে গেছেন ঃ --- (১) ব্রজের কৃষ্ণ আর (২) পার্থসারথী কৃষ্ণ--- এর ভূমিকা৷ (ক্রমশঃ)