শাসনের নামে স্বৈরাচারিতা কেন?

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

বাঙলার কৃতী সন্তান, বর্তমানের এই ত্রিপুরা-নৃপতি কর্তৃক প্রদত্ত  ‘ভারত - ভাস্কর’ বলে সম্মানিত উপাধিতে ভূষিত, সমগ্র এশিয়া মহাদেশে বাঙলা কাব্য-সাহিত্যে প্রথম বিশ্বজয়ী ‘‘নোবেল’’ পুরস্কারে বন্দিত ও নন্দিত বিশ্ববরেণ্য ‘‘বিশ্বকবি’’ নামে সুবিদিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরচিত ‘‘ভারততীর্থ’’ কবিতাটির প্রথম পঙ্‌তিতেই কবিগুরুর লেখনীতে শাদা (শ্বেত বা শুভ্র অর্থে ‘শাদা’---তাই ‘শ’ হবে) কাগজের বুকে মুক্তাক্ষরে প্রোজ্জ্বলভাবে ফুটে রয়েছে---‘হে মোর চিত্ত, পুণ্যতীর্থে জাগোরে ধীরে/ এই ভারতের মহা মানবের সাগরতীরে’--- কথাগুলো৷ এখানে,‘ভারত’ তথা ভারতবর্ষকে বিশ্বকবি ‘মহামানবের সাগরতীর’ আর ‘পুণ্যতীর্থ’ বলে আখ্যায়িত  করেছেন৷ কী কারণে আর কোনযুক্তিতে--- কবিহৃদয়ের কোন্‌ উচ্ছ্বসিত আবেগের  পরিস্ফূটন ঘটেছে এই শব্দচয়নে তা’ কি আমরা এতদিনেও খানিকটা উপলদ্ধি করে উঠতে সমর্থ হয়েছি? বোধ হয়, এ প্রশ্ণের উত্তর সদর্থক হয়ে উঠবে না৷ উঠবে না বলছি একটাই কারণে যে, যে বুদ্ধিদীপ্ত মননশীলতা, স্বচ্ছ-সুন্দর মানসিকতা, উদারতাপূর্ণ মানবিকতা নিয়ে এসব তাৎপর্যপূর্ণ ও সুগভীর অর্থব্যঞ্জনাময় শব্দ, বাক্য, কথা বা মানবিক অভিপ্রকাশ ঘটে থাকে, সে-সব ভাব্য-দ্যোতনা বুঝে ওঠার জন্যে যে লোভ -রিরাংসা--স্বার্থপরতা ঈর্র্ষকাতরতা---সংকীর্ণতা---বিবর্জিত, আবিলতামুক্ত মন আর আগ্রহের প্রয়োজন তা’ ক্ষুদ্রস্বার্থের মোহে আচ্ছন্ন মন-মানসিকতা ও  লোভাতুর ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন দ্বিপদ-জীব মনুষ্যদেহধারীদের পক্ষে ধারণ করাটা আদৌ সম্ভব নয় বলেই তাঁরা তা’ বুঝে উঠতে পারেন না৷

তর্কচ্ছলেই বলে রাখছি, যদি ওঁরা পারতেনই তাহলে, বিদেশী লুঠেরা, শোষক ও সাম্রাজ্যবাদী, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের কূটচক্রান্তের জালে ফেঁসে গিয়ে আর নিজেদের লোভাচ্ছন্ন আবিলতাপূর্ণ ক্ষুদ্রস্বার্থের মোহে বিচার বুদ্ধি, বিচক্ষণতা, দূরদৃষ্টি আর সবচেয়ে বড়কথা মানবিক চেতনাটুকু জলাঞ্জলি দিয়ে কিছুতেই ‘দেশভাগ’-এর মত আত্ম-হননের পথ বেছে নিতেন না৷ এমন কি, শাসনক্ষমতা পরিচালনার লালসায় জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মদগর্বী সন্তান কৌরবদের ন্যায় কোনমতেই সত্যাসত্য, ধর্মাধর্ম, ন্যায়ও অন্যায়ের বিচারশক্তি হারিয়ে, মস্তিষ্ক-চালনার উর্বরতম মাটি, সুজলা-সুফলা -শস্যশামলাভূমি বাঙলাকে আর পেশীশক্তিতে বলীয়ানদের আবাসভূমি পঞ্জাবকে বিভাজনের মত মহাভূলের ইতিহাস রচনা করতেও পারতেন না৷ সেয়ানা ব্রিটিশ চক্রান্তকারীদের ফাঁদে পা রেখে যে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার (দ্বি্‌জাতি-তত্ত্ব বলতে পারছি না, কেননা সারা দেশ-বিভাজনের মত তৎকালীন নেতৃবৃন্দ যে মাদকদ্রব্য পানের নেশায় বুঁদ হয়েছিলেন, আজকের পরিস্থিতিটার নিরিখে তাঁদেরই উত্তরসূরীরা (যেহেতু যেসব নেতৃবৃন্দের অনেকেই কালগহ্বরে নিমজ্জিত হয়ে গেছেন৷ খানিকটা হলেও বিষাদপূর্ণ পরিণতি উপলদ্ধি করতে পারছেন কি?

তাই বলছিলুম, কবিগুরুর অভিলাষ তাঁরই দেশবাসীদের বিমূঢ়তা ও নষ্টচিন্তার কারণে অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে গেছে৷ তাঁরই চিন্তাপ্রসূত ‘ভূবনমনোমোহিনী’ আর ‘জগজ্জননী’-জননী’ ভারতমাতার কোলে পরবর্তীকালে লালিত পালিতরা চিত্তবিকলতার কারণেই পুণতীর্থে জাগ্রত হয়ে উঠতে পারেন নি বলেই,মহামানবের সাগরে আজ দিগন্তপ্রসারী শ্যাওলারাশি জমে উঠেছে ও অজস্র সংখ্যায় অনিষ্টকারী দুষ্টকীটদের জন্ম হয়েছে আর সাগরতীর জুড়েই যেন দুষ্ট আগাছাদের বিস্তীর্ণ জঙ্গলে ছেয়ে গেছে,যার ভেতরেও জন্ম নিয়েছে ---গোষ্ঠীগত,জাতিগত,সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় গোঁড়ামি মূলক কুসংস্কারপূর্ণ,সংকীর্ণতাচ্ছন্ন হাজারো রকমের হিংসুটে ও দাঁতাল সরীসৃপেরা আর বুনো জন্তু-জানোবরেরা৷ যারফলে আজকের খণ্ডিত ভারতের আনাচে-কানাচে,রাজপথে কানাগলি,শহরে-পল্লীতে, নগরে-বস্তিতে, সামাজিক আধ্যাত্মিক-অর্থনৈতিক প্রশাসনিক সর্বস্তরে  জাঁকিয়ে উঠেছে---দুর্নীতির মাতলামি, রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক দুর্বৃত্তপনাসহ স্বৈরাচারিতা, শাসকদের মুখোশপরা শোষকদের অবাধ ও বেপরোয়া শোষণ জনজীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে৷ যারফলে,বিচারের নামে প্রহসন,দেশশাসনের নামে জল্লাদিপনা, ঈর্ষা - হিংসা-অসহিষ্ণুতা-দম্ভ-লালসা ইত্যাদি চরিতার্থ করতে গিয়ে যদৃচ্ছপনার মারাত্মক বাহাদুরিকে জনজীবন তথা সমাজ-জীবনে চাপিয়ে দিয়ে মানবিকতাকেই নিষ্ঠুর-নির্মমভাবে পৈশাচাকিতার বেদীমূলে বলির হাঁড়িকাঠে চড়ানো হচ্ছে৷

আমার দৃষ্টিতে, স্বাধীনোত্তরকালে, যুগে যুগে,গত সাত-আট দশক জুড়ে, যাঁরাই কেন্দ্রীয়স্তরে বা রাজ্যে রাজ্যে যে দলই  ক্ষমতায় আসুক না কেন, ওঁদের সকলেরই মৌলিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে একটি সাধারণ Commonality) রয়ে গেছে আর সেটি হচ্ছে--- ‘সম-সমাজতত্ত্বের’ অভাবে পুরো---মাত্রায় ‘আত্মসুখতত্ত্ব’ আধ্যাত্মিকতা-বিবর্জিত জড়ভোগসর্বস্বতত্ত্, নীতি বিবর্জিত রাজনীতি অর্থাৎ পলিটিক্‌স করার মদমত্ত নেশা, যাকে বলতে পারি একশব্দে স্বৈরাচার বা স্বেচ্ছাচারিতা, যা ফ্যাসিবাদেরই নামান্তর৷ অর্থাৎ, এক কথায় বলা যেতেও পারে ভারত দেশটা অতীতের সুলতানী আমল, পাঠানযুগ ও মোগলযুগ পেরিয়ে এসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী যুগ অতিক্রম করার পরও শোষক আর দুরাচারীর ‘বলমুক্ত হয়ে উঠতে পারে নি৷ যা কায়েম হয়েছিল---ঊর্দ্ধ সাম্রাজ্যবাদ আর অপরাংশে বহাল হন---হিন্দীসাম্রাজ্যবাদ৷

বর্তমানে এপারে, হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের জমানায় জনজীবন প্রায় তলানিতে পৌঁছাবারই, উপক্রম হয়েছে বলা যেতে পারে৷ কেননা, বিজেপি-শাসনকালে নোটবন্দী, জি.এস.টি হবার সুবাদে আর বড়মাপের পুঁজিপতিও শিল্প-মালিকদের স্বার্থরক্ষার্থে অর্থনৈতিক বাজেট ও পরিকল্পনা রচিত হবার কারণে ও আপামর জনস্বার্থ বিরোধী পরিকল্পনা হাতে নেবারও ফলে দেশটায় প্রায় অর্র্ধংশ লোকসংখ্যার মরনদশা সৃষ্টি হয়েছিল৷ আর, গত বছর কোভিড-১৯ এর আাবির্ভাব লগ্ণ থেকে এযাবৎ সরকারী তরফে কি রাজ্যে ও কি কেন্দ্রে সুদুরপ্রসারী ও বিচক্ষণ, ন্যায়নীতি-সমর্থিত চিন্তাধারা গ্রহণ না করে বোট-প্রাপ্তির লক্ষ্যে ও রাজ্যজয়ের নেশায় মশগুল কেন্দ্রীয় একপেশে হঠকারী নীতি-আইন প্রণয়নের  কারণে আরও প্রায় ৫০ কোটি মানুষের জীবন দুর্বিষহ হতে চলেছে৷ যেমন, কোভিড-১৯ বাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে লাখ লাখ পরিযায়ী শ্রমিকের জীবনে  নেমে এসেছে ঘন-অন্ধকার৷ দেশজোড়া শিক্ষার্থীদের জীবনে দেখা দিয়েছে গভীর হতাশা৷ সরকারী ও বেসরকারী কর্মচারীদের জীবনযাত্রা অসহনীয় করে তুলেছে বর্তমানে ক্রমবর্দ্ধমান লাগামহীন নিত্যপ্রয়োজনীয় ও আবশ্যকীয় দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধি৷