স্বাধীনতার চুয়াত্তরে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

স্বাধীনতার চুয়াত্তর বছরে উপনীত হয়েও দেশের অধিকাংশ মানুষ জীবন ধারণের  নূ্যনতম প্রয়োজন খাদ্য,বস্ত্র,চিকিৎসা, বাসস্থান, সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত৷ ভারতীয় সংবিধান ভারতবর্ষের সমস্ত বর্গের, শ্রেণীর, জাতি বর্ণের,ভাষাভাষী মানুষের প্রতি কর্তব্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার গুরুদায়িত্ব দেশের নির্বাচিত সরকারগুলোর উপর ন্যস্ত করেছিল, তা পালন করতে তারা সমর্থ হয় নি৷ সেই সদিচ্ছাও তাদের নিশ্চয়ই ছিল না--- থাকলে ৭৩টা বছর তার জন্যে খুব কম সময় নয়৷ সংবিধানের নামে শপথ নিয়ে সেই অঙ্গীকার রক্ষা না করা বা কর্তব্যের অবহেলা করা সংবিধানকে অসম্মান করারই নামান্তর মাত্র৷ ব্রিটিশ শাসকদলের অত্যাচার, উৎপীড়নে যন্ত্রণাক্লিষ্ট দেশের মানুষের দুর্দশা দূর করার লক্ষ্যে সমগ্র অখণ্ড ভারতের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য বীর বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দুঃসহ কষ্টবরণ, আত্মবলিদান কতিপয় ক্ষমতালোভী অপরিণামদর্শী নেতৃত্বের অবিমৃষ্যকারিতার কারণে বিফলে গিয়েছে৷ ওইসব নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতার নামে দেশভাগের বিনিময়ের প্রকৃত অর্থে ক্ষমতা হস্তান্তরের সওদা করেছিল৷ এর পরিণাম হয়েছিল ভয়ঙ্কর ভ্রাতৃঘাতী, রক্তের হোলিখেলার বীভৎসতা পূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী---যার কুফল অখণ্ড ভারতবর্ষের খণ্ডিত অংশগুলি আজও ভোগ  করে চলেছে৷ তথাকথিত রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের পর ভারত বা India নামক খণ্ডিত অংশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের পরিবর্তে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীদের শাসনব্যবস্থা কায়েম হলো৷ দেশের অর্থনীতির চাবিকাঠি রইল আগের দুর্নীতিবাজ মুনাফালোভী পুঁজিবাদীদের হাতেই আর সাধারণ মানুষের অবস্থা যে তিমিরে ছিল সেখান থেকে আরও অন্ধতমসার গভীরে নিমজ্জিত হতে থাকলো৷ দেশের অধিকাংশ সম্পদ সঞ্চিত হলো পুঁজিপতিদের গুদামে, ব্যাঙ্কের লকারে আর সাধারণ মানুষ শোষণের যাতাকলে পিষ্ট হতে হতে ধবংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেল৷ পেটে ক্ষিদের জ্বালা, বেকারত্বের গ্লানি, অশিক্ষা কুশিক্ষার প্রাদুর্ভাব, বাসস্থান ও রোগ দুর্র্ভেগে সুচিকিৎসার অপ্রতুলতা দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে৷ নোটবন্দীসহ বিভিন্ন ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে বিধবস্ত৷ বর্তমানে ভারতে বেকারত্বের হার চল্লিশ বছরে সর্র্বেচ্চ৷ কর্মসংস্থানের চেয়ে কর্মচ্যুতি ও কর্মসংকোচনের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা মহামারী উদ্ভূত লকডাউন, কলকারখানা অফিস, রেলপথে সর্বসাধারণের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হওয়ার ফলে বেকারত্ব ও পরিযায়ী শ্রমিক সমস্যা৷ দেশের জি.ডি.পি  বা সামগ্রিক সম্পদ প্রায় চবিবশ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে৷ এই সময় উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ পরিকল্পনা ও সাধারণ মানুষের হাতে যথেষ্ট ব্যয়যোগ্য অর্থ যোগান দেওয়ার চেষ্টা না করে দেশের কর্তারা ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি আর মন্দির নির্মাণ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন৷ ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রমোদী ‘‘আত্মনির্ভর ভারত’’ গড়ার ডাক দিয়েছেন৷ স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়ার সময়েও আত্মনির্ভর ভারতের উল্লেখ করেছেন৷ দেশকে আত্মনির্ভর করতে হলে দেশের মানুষের অন্নবস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, রুজি রোজগারের ব্যবস্থা করতে আন্তরিকভাবে প্রয়াসী হতে হবে গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে সকলের হাতে অর্থের যোগান বাড়াতে হবে পুজিপতিদের গুদামের ও ব্যাঙ্কের অব্যবহৃত সম্পদকে মানুষের কল্যাণে চলমান করতে হবে৷ ভারতের মতো বিশাল গ্রামভিত্তিক দেশে দেশীয় কৃষিজ, বনজ, খনিজ, জলজ ও মানব সম্পদকে কাজে লাগিয়ে গ্রামীণ কুটির শিল্পের বিকাশ, ক্ষুদ্র শিল্পগুলোর পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে একশত শতাংশ স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান সুনিশ্চিত করতে হবে৷ শুধুমাত্র আদানি, আম্বানি, টাটা, বিড়লা, গোয়েঙ্কা ইত্যাদি মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতিদের বা শিল্পপতিদের হাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ গচ্ছিত রেখে দেশ ও দেশবাসীকে পুঁজিবাদী শোষণের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করে ‘‘আত্মনির্ভর ভারত’’ নির্র্মণ কখনোই সম্ভব নয়, বরং দেশটা ক্রমশঃ বেনিয়াদের কাছে বিক্রি হয়ে যাবে ও যাচ্ছে৷ সমাজনীতি ও অর্থনীতির বিশেষজ্ঞগণ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় সেরকম আশঙ্কাই প্রকাশ করেছেন৷

বিশাল দেশ এই ভারতবর্ষে বিভিন্ন ভাষা, ঐতিহ্য-সংসৃকতি, সামাজিক আচার ব্যবহার, জাতিসত্তার বৈশিষ্ট্যযুক্ত মানবগোষ্ঠী বসবাস করেন৷ এই দেশ অনেকগুলি অঙ্গরাজ্যের সমষ্টি হওয়ার  ফলে স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন দলের সরকার শাসন ক্ষমতায় থেকেছে৷ আবার কেন্দ্রেও বিভিন্ন সময় সরকারে আসীন হয়ে বিভিন্ন দল শাসন ক্ষমতা ভোগ করেছে৷ এক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয়, বিশ্বাস ও আস্থার বাতাবরণ থাকা একান্ত প্রয়োজন৷ কিন্তু বাস্তবে তা না হওয়ার কারণে সমগ্র দেশের মানুষ কাছে উন্নয়নের সুফল সমানভাবে ঠিকমতো পৌঁছায় নি৷ শুধু তাই নয়, বহুক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতা প্রদর্শন করতে গিয়ে সংবিধান অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্যগুলির প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা না দিয়ে প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক স্থাপনে তৎপর হয়েছে৷ বর্তমানে এরই সুযোগ নিয়ে পুঁজিবাদী বেনিয়ার দল সাধারণ মানুষের উপর সীমাহীন শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে আর দেশের প্রধানমন্ত্রী মিথ্যা প্রতিশ্রুতির  ঝুরি ও বাগাড়ম্বরপূর্ণ ‘‘মন কী বাত’’ শুনিয়ে বাস্তব পরিস্থিতি ভোলাতে চাইছেন৷ প্রকৃতপক্ষে তিনি কখনোই সাধারণ মানুষের ‘‘মন কী বাত’’ শোনার চেষ্টাও করেন নি৷

ফলে মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন আর বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়ে গেছে৷

এমতাবস্থায় শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতাই যথেষ্ট নয়, দেশের মানুষের চাই  অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেশীশক্তির আস্ফালনসর্বস্ব ধাপ্পাবাজির তথাকথিত গণতন্ত্রের পরিবর্তে চাই অর্থনৈতিক গণতন্ত্র আর মানুষের সার্বিক শোষণমুক্তির জন্যে আবশ্যক একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শন যার দিকনির্দেশনায় রচিত হবে শোষণমুক্ত মানব সমাজ৷ সেই সমাজে  থাকবে নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্তির তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার সুনিশ্চিততা আর একশত শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা৷ প্রসঙ্গত ঃ উল্লেখযোগ্য যে, এইসব প্রয়োজনীয় শর্তগুলির সার্থক রূপায়ণকল্পে মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তন করেছেন ‘‘প্রাউট’’ বা প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব (PROUT--Progressive Utilization Theory)৷ ‘‘প্রাউট’’ এর নীতি অনুযায়ী--- ‘‘হরর্মে পিতা, গৌরীমাতা, স্বদেশ ভুবনত্রয়ম্’’ অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের  সমস্ত সম্পদের  মালিক পরমপিতা পরমব্রহ্ম সেই সম্পদকে জীব, জড়, উদ্ভিদের সকলের জন্যে সাজিয়ে রেখেছেন পরমা প্রকৃতি গৌরীমাতা আর ত্রিভুবনের সকলে মিলে মিশে সেই সম্পদ ভোগ করবে৷ পার্থিব সম্পদ বিপুল হলেও অসীম নয় ও বিশ্বের সমগ্র সৃষ্টিই পরমপিতার সন্তান সন্ততি৷ তাই এই জাগতিক সম্পদকে নব্যমানবতাবাদের আদর্শে প্রয়োজনাভিত্তিক ভোগ করার অধিকার রয়েছে, কিন্তু অতিরিক্ত সঞ্চয়  করে অপরকে বঞ্চিত করার বা শোষণ করার অধিকার কারোরই নেই৷ উন্নত মেধাসম্পন্ন মানুষের বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান-মণীষা, বিজ্ঞান প্রযুক্তির সাহায্যে বিশ্বের সকল সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করতে হবে ও যুক্তি সংগত বন্টন করতে হবে৷ এই বাস্তবতাকে হৃদয়ঙ্গম করতে হলে আধ্যাত্মিক জীবনচর্র্যর অনুশীলন অবশ্যই করতে হবে যার উদ্দেশ্যে হলো--- ‘‘আত্ম মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ৷ কারণ, এটাই  ভারতবর্ষের চিরন্তন ঐতিহ্য, ভারতাত্মার মর্মবাণী৷

‘‘প্রাউট’’ এর দিকনির্দেশনা অনুসারে সমগ্র ভূখণ্ডকে (রাজ্য,রাষ্ট্র, পৃথিবী) স্থানীয় উপাদান সমূহের উপলভ্যতার ভিত্তিতে বিভিন্ন ‘‘স্বয়ংসম্পূর্ণ, সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল’’গড়ে তুলতে হবে৷ প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ‘‘ব্লক ভিত্তিক পরিকল্পনা’’ গ্রহণ করে মূলতঃ সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে স্থানীয়  সকল মানুষের একশত শতাংশ কর্মসংস্থান  সুনিশ্চিত করতে হবে৷ পরবর্তী একাধিক ব্লক বা অর্থনৈতিক অঞ্চল মিলিয়ে বৃহত্তর স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘটন করা যাবে৷ এইভাবে পরিশেষে আরও  বৃহত্তর ক্ষেত্রে রাজ্য, রাষ্ট্র, পৃথিবী ধাপে ধাপে ‘‘স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল’’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে৷ এই অঞ্চলগুলোর মধ্যে অতিক্ষুদ্র উদ্যোগগুলি ব্যষ্টিগত ক্ষেত্রে ও অতি বৃহৎ উদ্যোগগুলি স্থানীয় সরকারের অধীনে ‘‘না-লাভ, না-ক্ষতি’’ নীতিতে পরিচালিত হবে৷ আর বাকী সমস্ত উদ্যোগ (কৃষি, শিল্প, বানিজ্য) সমবায় ব্যবস্থায় মাধ্যমে পরিচালিত হবে৷  সমাজে মধ্যস্বত্বভোগী দালাল বা ফড়েদের কোন স্থান থাকবে না৷ এই  ব্যবস্থায় উৎপাদক ও উপভোক্তার  মধ্যেকার শোষণের  চিরকালীন অবসান হবে৷ স্থানীয় মানুষের একশত শতাংশ কর্মসংস্থানের  দ্বারা দেশের অর্থনীতিতে সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত হবে৷ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুনির্দিষ্ট কল্যাণকামী ব্যবহারের দ্বারা সকলের জীবন ধারণের মানের ক্রমোন্নয়ন সম্ভব হবে ও চাকরির সন্ধানে মানুষের স্থানান্তরনের প্রয়োজন হবে না৷ পরিযায়ী শ্রমিক সমস্যাও দূর হবে৷ গ্রাম ও শহরের মধ্যে সুসামঞ্জস্য বিধান সম্ভব হবে৷ ফলে গ্রাম থেকে শহর, দেশের সকল অংশই সামগ্রিকভাবে আত্মনির্ভর হয়ে উঠবে৷ সর্বত্র অর্থনৈতিক গণতন্ত্র  সার্থকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে ও শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে উঠবে৷ তাই পৃথিবীর প্রতিটি সচেতন, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে ‘‘প্রাউট’’ দর্শনের পরিকল্পনা অনুযায়ী শোষণ মুক্ত সমাজ রচনার উদ্দেশ্যে অনতিবিলম্বে এগিয়ে আসতেই হবে যেন আগামী প্রজন্মকে এক সুন্দর ‘‘নোতুন পৃথিবী’’প্রদান সম্ভব হয় যেখানে তারা নিঃশঙ্ক চিত্তে আনন্দের সঙ্গে বসবাস করার সুনিশ্চিততা পাবে৷