শিবরাত্রির কথা

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

বারাণসীতে এক ব্যাধ ছিল৷ বনে পশু শিকার করাই ছিল তার জীবিকা৷ একদিন একটা হরিণ শিকার করতে তাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল৷ হরিণের পেছনে ধাওয়া করতে করতে সে বনের অনেক গভীরে ঢুকে পড়েছিল৷ ফলে বন থেকে ফিরতে সেদিন তার সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হয়ে গিয়েছিল৷ সেই বনে ছিল বাঘের উপদ্রব৷ বাঘের ভয়ে ব্যাধ তখন একটি উঁচু বেল গাছের ওপর আশ্রয় নিল৷ রাতটা শেষ হলেই সে বাড়ি ফিরে যাবে৷

সেদিন ব্যাধ অনেক পশু শিকার করেছিল৷ তাই সে বড় ক্লান্ত ছিল৷ রাত গভীর হতেই গাছের ওপর সে ঘুমিয়ে পড়লো৷ সেই গাছের নীচে ছিল শিবলিঙ্গ৷ রাত্তিরে ব্যধ যখন ঘুমোচ্ছিল তখন তার গা থেকে এক ফোঁটা ঘাম শিবলিঙ্গে পড়লো৷ সেদিনটা ছিল শিবরাত্রির দিন৷ আর ব্যধও ছিল সারাদিন উপবাসী৷ মহাদেব ব্যাধের একফোঁটা ঘামেই সন্তুষ্ট হন৷ অজান্তেই ব্যাধ শিবের বরে হয়ে গেল মহাপুণ্যবান৷ তাই যথা সময়ে ব্যাধের মৃত্যুর পর যখন যমদূত এসে তাকে নরকে নিয়ে যেতে চাইল, তখন শিবদূত এসে তাকে বাধা ছিল৷ শিবদূত ব্যধকে নিয়ে গেল শিবলোকে অর্থাৎ কৈলাসে৷

এই আদিম মিথোলজি তথা লোকপুরাণের কাহিনীই শিবরাত্রির ব্রতকথায় রূপান্তরিত হয়েছে৷ এই সব ব্রতকথাকে বলা হয় অলিখিত সাহিত্য৷ এককালে মুখে মুখেই এইসব অলিখিত সাহিত্য আমাদের মা-বোনেদের মুখে মুখে প্রচারিত হয়েছে৷ ভিন্ন ভিন্ন মুখে একই কাহিনীর রূপান্তর ঘটাও তাই অস্বাভাবিক কিছু নয়৷

যেমন, এই কাহিনীতেই অনেকে বলেন, বেল গাছে যখন ব্যাধ ঘুমিয়েছিল তার নড়াচড়াতে কিছু বেলপাতা খসে গাছের নীচে শিবরূপী পাথরের ওপর পড়েছিল৷ আর পড়েছিল কয়েক ফোঁটা শিশির৷ শিব ভাবলেন, ব্যাধ বুঝি বেলপাতা আর জল ঢেলে পুজো করছে৷ তাই শিব সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দিলেন৷

ফাল্গুনী কৃষ্ণা চতুর্দশীতে শিশিরের চাইতে ক্লান্ত ব্যাধের ঘাম ঝরাটাই বেশি বাস্তবসম্মত নয় কি?

দেবকুলে সবচেয়ে জনপ্রিয় দেবতা হলেন শিব৷ বৈষ্ণবধর্ম প্রভাবিত কিছু অঞ্চল বাদ দিলে বাংলার প্রায় সর্বত্রই শিবের রাজত্ব৷ শিব নানা সময়ে নানারূপে পূজিত হন৷ ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে কুমারী মেয়েরা শিবরাত্রি পালন করে৷ ‘‘ক্ষ্যাপার চৌদ্দ ক্ষ্যাপীর আট৷ এ নিয়েই কাল কাট৷’’ ক্ষ্যাপা হচ্ছে শিব, চৌদ্দ অর্থাৎ ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী (শিবরাত্রি)৷ মেয়েরা সেদিন উপোস করে শিবের মাথায় দুধ বা জল ঢালে৷ ওইদিন মেয়েদের রাত জাগতে হয়৷ শিবরাত্রির উদ্যোক্তা মূলত কুমারী মেয়েরা হলেও পুরুষ, বিধবা ও সধবারাও শিবরাত্রি পালন করেন৷

কুমারী মেয়েদের শিবরাত্রি পালনের অন্যতম উদ্দেশ্য শিবের মতো বরপাওয়া৷ এটাই প্রচলিত ধারণা৷ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের কথায় বলি---‘বিবাহ’ শব্দটির শাব্দিক অর্থ দাঁড়াচ্ছে, বিশেষ এক ধরণের দায়িত্ব নিয়ে নোতুনভাবে জীবনধারাকে প্রবাহিত করা৷...শিব এই দায়িত্ব নিয়েই বিবাহ করেছিলেন৷ তাই আমরা নির্দ্ধিধায় বলতে পারি এই বিশ্বের প্রথম বিবাহ শিবই করেছিলেন৷ (নারীর মর্যাদা)... এই বিশ্বে শিবই ছিলেন প্রথম বিবাহিত পুরুষ৷ তাঁর আগে কোন বিবাহিত পুরুষ ছিল না৷ তাই কোন পুরুষই পারিবারিক দায়িত্ব বলতে যা বোঝায় তা বড় একটা নিত না৷ হয়তো বা পশুদের মতই খুব অল্পসল্প দায়িত্ব নিত৷’’ (নমঃ শিবায় শান্তায়-শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি)৷ তাই আনন্দমূর্ত্তিজী একথাও বলেছেন শিবই প্রথম বিবাহের মধ্যে দিয়ে নারী জাতিকে সংসারে সমাজে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন৷ তাই প্রত্যেক নারীরই উচিত শিবের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা৷