সংগ্রামের সরণি বেয়ে.....

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

পৃথিবীর বুকে যেদিন প্রথম সৃষ্টির বীজ অঙ্কুরিত হ’ল, জেগে উঠল নবজীবনের প্রথম পল্লব---সমগ্র প্রকৃতি সেদিন ছন্দায়িত হয়েছিল নতুনের স্পন্দনে৷ নবাঙ্কুরের সম্ভাষণে আকাশের নীলিম পর্দায় ফুটে উঠেছিল বিশ্ববিধাতার নবসৃষ্টির আনন্দাপ্লুত মুখচ্ছবি৷ নবীন প্রভাতে নবারুণের রশ্মিচ্ছটায় ছিল বিনম্র প্রণিপাত,মলয় প্রবাহে যুক্ত হ’ল আরও স্নিগ্দতা, মেঘমালায় স্পন্দিত পুলকের হিল্লোল, জলধির তরঙ্গমালায় এক অনাস্বাদিত উন্মাদনা, রাতের আকাশে নীহারিকাপুঞ্জে কোটি তারকার সালোক উল্লাস৷ বিশ্বজোড়া এই আনন্দের মাঝেও ছিল দুরন্ত জীবন সংগ্রাম, জীবসত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রাখার ঐকান্তিক প্রয়াস৷

বিবর্ত্তনের হাত ধরে, রূপান্তরের পথ ঘুরে কালস্রোতে ভাসতে ভাসতে বিধাতার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ আজ একবিংশ শতাব্দীতে উপনীত৷ হাসি-আনন্দ-কান্না, সুখ-দুঃখ- ব্যথা-বেদনা সবই সেই জঙ্গম জীবন সংগ্রামের এক-একটি মূর্ত্ত রূপ৷ এগুলোকে নিয়েই আমরা মানুষ, চলেছি এক অনন্ত পথ-পরিক্রমায়৷ অতীতের অভিজ্ঞতা, বর্তমানের বাস্তবতা, ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ণ আর বিশ্বপিতার আশীর্বাদ মানুষের জীবনীশক্তি, সংগ্রামের রসদ ও এগিয়ে চলার মশাল, জীবনের ধ্রুবতারা---সৃষ্টির প্রথম বিন্দু থেকে ক্রমশঃ সৃষ্টি সিন্ধুতে উত্তরণ৷

জীবন সত্ত্বার মূল তত্ত্বই হ’ল সংগ্রাম---বিকল্পহীন বিরামবিহীন নিরন্তর সংগ্রাম৷ জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে, স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় প্রতিটি জীবকেই সংগ্রামের অংশীদার হতেই হবে৷ এই সংগ্রাম কখানো একক, কখনো সম্মিলিত, কখনো অহিংস আবার কখনো রক্তাক্ত৷ এর প্রতিফলন রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে, গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-নগরে, পাড়ায়-পাড়ায়---সমাজের প্রতিটি স্তরে৷ সংগ্রামের দিকে পিছন ফিরে থাকার কোনও অবকাশ নেই৷ তাই সময়ের সঙ্গে তাল রেখে, পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে সংগ্রামের মুখোমুখি দাঁড়ানোই জীবনদীপের প্রকৃষ্ট প্রকাশ৷

প্রাগৈতিহাসিক যুগের সেই তমসাচ্ছন্ন অমারাত্রির হাড় -হিম করা প্রাকৃতিক প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন লড়াইয়ের পথ বেয়ে পরবর্ত্তী পর্যায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদ যখন সৃষ্টি হয়েছিল সেদিনও সংগ্রামকে হাতিয়ার করেই বেঁচে ছিলেন আদিম মানুষের দল৷ বর্তমানে জনপদগুলি অনেকটাই উন্নত ও বর্ধনশীল৷ সমষ্টিগত শক্তিও তাই আজ বেশী৷ তবে প্রতিবন্ধকতা আগেও ছিল, আজও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে---নিত্যনোতুন কলেবরে৷ সম্মিলিত প্রয়াস, অদম্য ইচ্ছাশক্তি, অটুট ঐক্য ও যৌথ সংগ্রামের দ্বারাই সমস্ত উপলখণ্ডকে পদাঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে চলার গতিকে অক্ষুণ্ণ্ রেখে, জীবনযুদ্ধে বিজয়-কেতন ঊধের্ব তুলে মানুষের কণ্ঠে বারবার ধবনিত হবে---আমরা বিশ্বপিতার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি---অমৃতস্য পুত্রাঃ৷ আমরা এই ধূলার ধরণীতে গড়ে তুলব সত্য ও সুন্দরের চিরন্তন অধিষ্ঠান৷ তরুলতা, পশুপাখি, সবাইকে নিয়ে নব্যমানবতাবাদের আদর্শে রচনা করব ‘সর্বজনহিতায় সর্বজনসুখায়’ সুসংবদ্ধ শোষণহীন মানব সমাজ৷

নববর্ষের সুন্দর সকালে এই হোক আমাদের আন্তরিক প্রার্থনা ও অঙ্গীকার৷