সংশ্লেষণই শান্তি, বিশ্লেষণে নয়

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

সত্যের অনুসন্ধানকারী ও ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষমাত্রেই জানেন ও এই দৃঢ়বিশ্বাস নিয়েই জীবনধারণ করেন যে পরম-সৃষ্টিকর্র্ত এক ও অদ্বিতীয়---অর্থাৎ শিব, শ্রীকৃষ্ণ,নারায়ণ, গড, আল্লাহ, যীশু যে নামে তাঁকে ডাকি না কেন সর্বাবস্থায় তিনি এক৷ তিনি অনাদি-অনন্তম্‌ একম-এব অদ্বিতীয়ম্‌ সত্ত্বা৷ তাঁরই হুলাদিনী শক্তি গৌরী,পার্বতী, দুর্র্গ, কালী, লক্ষ্মী, শ্রীরাধা ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত, তবে মূলতই এক ও বিকল্পহীন---অর্থাৎ তিনি শিবের শিবানী, গৌরী বা পার্বতী, শ্রীকৃষ্ণের শ্রীরাধা৷ তাঁরা দুয়ে মিলেই এক--- অর্থাৎ স্বয়ং জি-ও-ডি (গড্‌)-এর জি (জেনারেটর) ও ডি (ডেষ্ট্রয়ার) দ্বৈত-ভূমিকারই  অপর এ সত্তা ও অবিনাভাবী যাঁকে কিছুতেই মূলসত্তা থেকে পৃথক বলে ভাবা যায় না ও তে অপারেটর,যাঁর মানে দাঁড়ায় কার্যকরণী শক্তি অর্থাৎ পরমপুরুষ তথা সুপ্রীম কন্‌শাসনেসের আজ্ঞা বহ ঘরনী তথা দাসানুদাসী প্রকৃতি বা ক্যাপিটেল লেটার এন’-দিয়ে ‘নেচার’৷ তাই, আনন্দ-সূত্রমে বলা হয়েছেঃ--- ‘শিবশক্ত্যাত্মকম্‌ ব্রহ্মং’৷ এখানে ‘শিব’ মানে পুরুষসত্তা ও শক্তি হচ্ছেন প্রকৃতি সত্তা আর শিব ও শক্তি দুয়ে মিলেই ব্রহ্ম---পরমব্রহ্ম, যিনি অনন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা, ধস্তা ও বিধাতা৷ তাই, অপর এক শ্লোকে বলা রয়েছে ঃ--- ‘শক্তিঃ সা শিবস্য শক্তিঃ’৷ এখানে বোঝাচ্ছে শক্তি মানে প্রকৃতি স্বয়ং আর তিনিও শিবেরই ঘরণীমাত্র৷ সুতরাং এ থেকে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, অনন্তসত্তা পরমব্রহ্ম তথা পরমপুরুষ (সুপ্রীম কনসাসনেশ) এককসত্তা৷

বিশ্ব-সৃষ্টির আদিতে সেই পরমপুরুষ তথা পরমস্রষ্টা একাই ছিলেন--- একমাত্র তিনিই সব ও তাঁকে ছাড়া বা তাঁর বাইরে কিচ্ছুটি নেই৷ তিনি কিছুই দেখতে পেতেন না, ছুঁতেও পেতেন না--- কাউকে কিছু বলবার ও শোণাবারও পেতেন না৷ তাই, এই যে অসহনীয় পরিস্থিতি, সেই দিন সেই অবস্থা তাঁকে যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলেছিল বলেই তিনি নিজেকে ব্যস্ত করতে চেয়েছিলেন৷ উপনিষদে আমরা এই আইডিয়াটির সাক্ষাৎ পাই যে, তিনি ভেবেছিলেন--- ‘একাহম্‌ বহুস্যামঃ’ (আমি একা আছি, বহুতে পরিণত হব)৷ সেদিন তাঁর সেই মানসধাতু থেকেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড-সৃষ্টিলীলা উৎসারিত হয়েছিল৷ এই ঘটনাকে ভক্তকবি ভাষায় রূপ দিয়েছেন এভাবে ঃ--- ‘নিজরস আস্বাদিতে প্রভু ধরিলেন কায়া৷’ এই কায়া মানেই হচ্ছে অনন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড৷ তাই, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়েই তাঁর অধিবাস---তাঁর অধিষ্ঠান৷ কবিগুরুর ভাষায়---‘আপনিই প্রভু সৃষ্টি-বাঁধনে পড়েন বাঁধা সবার কাছে’৷ কবিগুরু-বিরচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতের গানের এক কলিতে বাঞ্ছা এভাবে প্রকাশ পেয়েছে---‘বিশ্বময় যোগে যেথায় বিহারো/সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও৷’

পরমব্রহ্ম এক৷ তবে তিনি বহুধা বিস্তৃত বলেই অনেক৷ সমগ্র বিশ্বজগতে তিনি পরিব্যাপ্ত রয়েছেন বলে বিশ্বের যাবতীয় দৃশ্য ও অদৃশ্যসত্তা জুড়েই তিনি বিরাজ করেছেন৷ যে পাঞ্চভৌতিক বস্তুকণা দিয়ে বিশ্বরচিত, সেই বস্তু কণার  প্রতিটি অণু-পরমাণুতেই তিনি রয়েছেন৷ সৃষ্টজগৎ যা যা  সৃষ্টি হয়েছে ও যা’ এখনও সৃষ্টি-রূপ পায় নি--- যা শুভদায়ক ও যা অশুভদায়ক, যা হিতকর ও যা অনিষ্টকারক সবকিছুরই মূলে রয়েছেন তিনি৷  তাই ঋষি বলেছেন

‘‘একোহ বর্র্ণে বহুধা শক্তিযোগদ্‌ বর্ণাননেকান্‌ নিহিতার্র্থে দধাতি৷

বিচৈতিচান্তে বিশ্বমাদৌঃ সদেবঃ সন বুদ্ধা শুভয়া সংযনত্তুণ৷’’

অর্র্থৎ তিনি মূলীভূত এককসত্তা হয়েও  বহুরূপে অজস্র ধারায় সংখ্যাতীত্ব ভূমিকায় প্রতিভাত অরূপ হয়েও বর্ণাতীতভাবেই রূপায়িত৷ তিনি জ্ঞান-বুদ্ধি ও চিন্তারও অগম্য অথচ সর্বদা জগতের শুভ আর কল্যাণই করে চলেছেন৷ তাই বিশ্বের বুকে  পরিদৃশ্যমান যে কোন সত্তা দৃশ্য বা অদৃশ্য, জড় বা চেতন, প্রাণবন্ত বা নিষ্প্রাণ-নিশ্চল--- সবই বিরাজিত উদ্ভূত ও লয় প্রাপ্ত তাঁরই মানসদেহে, তাঁরই সংকল্প সৃষ্ট প্রপঞ্চময় বিরাট বিশ্বে৷

পরমপিতা তথা বিশ্বপিতা (ক্রিয়েটার অব দ্য য়ুনিবার্স) তাঁর সৃষ্টিলীলাকে সর্বদা সচল রাখতেই অতি সুনিপুণ জাদুকরের মতো সকলের অজান্তে, অলক্ষ্যে,অনুপনেয়ভাবে মায়ার মোহময়ী জাদু দিয়ে জীবজগৎকে আষ্টে -পৃষ্টে বেঁধে রেখেছেন৷ জগতের বুকে এককোষী প্রাণী থেকে  বিশালাকায় ঐরাবত, ম্যামথ বা তিমির মতো প্রাণীদেরও বিশ্বপিতা লালন পালন করাচ্ছেন৷ তাঁরই আজ্ঞাবহ প্রকৃতিকে দিয়ে৷ আর মানুষ যেহেতু তাঁর সর্র্বেন্নত জীব হিসেবেই উন্নত দেহ-মন আর বিচারশীলতার (র‌্যশনালিষ্ট) দ্বারা ঋদ্ধ, তাই মানুষকেই তিনি স্বাধীন ও সাবলীলভাবে চলাফেরার অনুমতি দিয়েছেন৷ মানুষের জীবন হচ্ছে এক আদর্শ প্রবাহ৷ বলা হচ্ছে---হিউম্যান লাইফ ইজ অ্যান ইডিওলজিক্যাল ফ্লো৷’ তাই মানবজীবনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে---পশুত্বকে পিছনে ঠেলে রেখে মনুষত্বে প্রতিষ্ঠিত হওয়া---অসম্পূর্ণতা থেকে নিজেকে সম্পূর্ণতায় প্রতিষ্ঠিত করা৷ এই অর্থেই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন শিক্ষার সংজ্ঞা দিয়ে যে---‘ শিক্ষা হচ্ছে সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষ তাঁর অন্তর্নিহিত সত্ত্বাকে পরিপূর্ণতায় বিকশিত করে তুলতে পারে৷’ তাই তো, মানুষের জীবনের মূলভিত্তিটা হওয়া চাই নৈতিকতার  (মর‌্যালিটি) শক্ত গাঁথুনিতে মজবুতভাবে গড়ে তোলা৷ সেই নৈতিকতার শক্ত ভিত  তৈরী করতে হলে--- জড়ের  উপাসনা একমাত্র ভোগের আকর্ষণে দিশাহীনভাবে ছুটেচলা, সংযমহীন আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে চলা, বিবেক-বুদ্ধি ও বিচারশীলতাকে এড়িয়ে চলা পরিহার করতেই হয় আর, সেজন্যেই চাই বৈয়ষ্টিক আত্মানুশীলন, যার অপর নাম হচ্ছে--- আধ্যাত্মিক সাধনা৷ ‘অধি+ আত্ম --- অধ্যাত্ম’--- এখানে অধি-কথার মানে হচ্ছে ব্যাপ্ত করা বা বিস্তৃত করা  আর ‘আত্ম’ কথাটির মানে আত্মচেতনা তথা বৈয়ষ্টিক চেতনা৷ এভাবে, আত্ম-চেতনালাভের মাধ্যমেই ব্রহ্ম-চেতনা তথা বৈয়ষ্টিক চেতনা৷ এভাবে, আত্ম-চেতনালাভের মাধ্যমেই ব্রহ্মচেতনা তথা বিরাটতত্ত্বের অনুভূতি ও উপলদ্ধি জাগ্রত হয়৷ সেই বিরাটত্বের চেতনা থেকেই জাগে বিশ্বচেতনা--- যার প্রভাবে মানুষ জড়তার মোহ সংবরণ করে বিশ্বপ্রাণিনতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে৷ নরেন্দ্রনাথ দত্ত স্বামী বিবেকানন্দ সুভাষচন্দ্র বসু নেতাজী, অরবিন্দ ঘোস ঋষি অরবিন্দ, মার্গারেট নোবল সিস্টার নিবেদিতা, গদাধর পুরুত ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস প্রমুখদের মতই বিশ্ববরেণ্য ও চির-প্রণম্য ব্যষ্টিত্বে পরিণত হতে পারেন৷ এই যে ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার প্র্যাকটিস--- এরই নাম হচ্ছে আধ্যাত্মিক সাধনা৷ আর এই ভোগবাদী ক্ষুদ্র মানবিকসত্তার গণ্ডী পেরিয়ে, অণু-মনের  পরিধিটাকে বড় করে তোলার নিরন্তর প্রয়াস--- এরই প্রকৃত নাম হচ্ছে---ধর্ম সাধনা তথা ধর্মানুশীলন৷ এরই মাধ্যমে সত্যিকারের মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটানো সম্ভব৷ (ক্রমশঃ)