শোষিত বাঙলা - বঞ্চিত বাংলা ও বাঙালী

লেখক
তারাপদ বিশ্বাস

বাঙলায় জলবায়ু পৃথিবীর বিস্ময়৷ প্রকৃতির অফুরন্ত দানে বাঙলা কৃষিজ-খনিজ-বনজ-জলজ সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ, জীবনের আবির্ভাব ও বিকাশের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় অত্যুর্বর মাটি, পর্যাপ্ত মিষ্টি জলভান্ডার, সূর্যালোক, তাপমাত্রা, হাওয়া, বৃষ্টিপাতের প্রাচুর্যের কারণে বাঙলা সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা এক সোনার দেশ৷ সোনার বাঙলার অফুরন্ত সম্পদ ভান্ডার ছিল, বিশ্বাবাসীর ঈর্ষার বিষয়৷ ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, সেই সম্পদের লোভে খ্রী: পূ: ৩২৭ অব্দে ম্যাসিডোনিয়া সম্রাট আলেকজান্ডার দি গ্রেট বাঙলা অভিযানের সংকল্প নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন কিন্তু বাঙলার গঙ্গারীডি রাজার অপরাজেয়, অমিতবিক্রম বাহিনীর সামনে দাঁড়াতে সাহস হয় নি, ফিরে যান৷ শক, হুন, পাঠান, আরাকান, মোগল, বর্গী-মারাঠী, তুর্কী-গ্রীক, ওলন্দাজ-পার্সী-ফার্সীরা একের পর এক বাঙলার সম্পদ লুঠ করে নিয়ে গেছে৷ সর্বশেষ লুটেরা সামাজ্যবাদী ব্রিটিশরা ও তাঁদের তল্পীবাহক পশ্চিম বাদামী শোষকেরা অর্থাৎ হিন্দী সাম্রাজ্যবাদীরা৷

১৭৫৭ থেকে ১৮৭০ পর্যন্ত বাঙালীরা, ইংরেজদের বিরুদ্ধে অসংখ্য আন্দোলন, বিদ্রোহ,সশস্ত্র বিপ্লব সংঘটিত করে৷ ইংরেজরা তাদের ১১৩ বছরের ভারত শাসন কালে, একমাত্র বাঙালী জাতিকেই বিপজ্জনক বলে চিহ্ণিত করে৷ সে কারণে বৃটিশ শাসকরা, দীর্ঘকালব্যাপী ভারত শাসন বিরুপদ্রবে অব্যাহত রাখতে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে---(১) বাঙালীর একতা ধবংস করতে হবে ও (২) দেশব্যাপী ব্রিটিশবিরোধী সেন্টিমেন্ট তৈরী করা-সহ আন্দোলন-বিদ্রোহের অগ্রপথিক বাঙালী জনগোষ্ঠীর ক্ষাত্রশক্তি, সাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তা ও আর্থিক শক্তি ধবংস করতে হবে৷

(১) বাঙালীর একতা -- ধূর্ত্ত ইংরেজ শাসকরা শাসনকার্যের সুবিধার অজুহাতে, বাঙালীকে ভূ-খণ্ডগত একতা বিনষ্ট করতে শুরু করে৷ প্রথমে বাঙলার দেহ থেকে বাঙলার নিজস্ব এলাকা বিচ্ছিন্ন করে, নোতুন নামে নোতুন কমিশনারেট, প্রভিন্স ইত্যাদি ঘটন করে তারপর অবশিষ্ট বাঙলা কে মাঝামাঝি দ্বি-খণ্ডিত করে পৃথক রাষ্ট্রের জন্মদেয়উদ্দেশ্য -- ঐক্য বিনষ্ট করা, নূন্যতম আস্তিত্বিক অধিকার হরণ করা পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ঐতিহাসিক পোল্যান্ডের মত ‘‘বাঙলা’’ নামটি মুছে ফেলে, বাঙালী-জনগোষ্ঠীকে শ্যাওলার মত ভাসমান জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা---দেশহীন, রাষ্ট্রহীন, নাগরিকত্বহীন যাযাবর জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা৷

(২) বাঙলার ক্ষাত্রশক্তি, সাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তা ও আত্মিক শক্তিঃ বাঙলার কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও মাতৃভাষা কেড়ে নিয়ে, হিন্দী-উড়িয়া-অসমীয়া-মিতেই তেলেগুে ইত্যাদি ভাষায় পঠন-পাঠন চর্চা বা দৈনন্দিন জীবনের সর্ব কাজে ব্যবহার করতে বাধ্য করা । সুকৌশলে যৌনতা -সব বহিঃমুর্খী সাহিত্য -সংস্কৃতি-শিল্পকলা, বাঙালী জনমানসে চাপিয়ে দেওয়া ---আর ধীরে ধীরে বাঙালী জনগোষ্ঠীকে মূক-কালা বধির-স্থবির অথচ উচ্ছৃঙ্খল এক প্রতিবাদ-প্রতিরোধহীন জড়ভরত জাতি হিসাবে বেঁচে থাকতে বাধ্য করা৷

১৮৭১ সালে ব্রিটিশরা সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ভারতবের্ষের জমি জরিপ ও জনগণনার কাজ শুরু করেছিল৷ ১৮৭২ সালে ব্রিটিশ সরকার-প্রকাশিত বাংলার মানচিত্রাধীন আয়তন ছিল ২,৪৮,২৩১ বর্গ মাইল অর্থাৎ ৫,৩৫, ৪৭১ বর্গ কি,মি৷ বাঙালীর ঐক্যবদ্ধ ক্ষাত্রশক্তির ভয়ে ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা কৃষিজ-বনজ সম্পদবহুল বাঙলার পূর্বাংশ কেটে অসম কমিশনারেট তৈরী করে ফলে বাঙলার দেহ থেকে ১,২০,৭৫০ বর্গ কি,মি বিচ্ছিন্ন করা হয়৷ মৃল বাঙলার আয়তন দাঁড়ায় ৪,১৪, ৭২১ বর্গ কি,মি৷ ১৯০৬ সালে ইংরেজদের বুদ্ধি তথা পরামর্শে তৈরী হয় ‘মুসলীম লীগ’ উদ্দেশ্য-হিন্দু মুসলমানের মধ্যে দ্বন্ধ লাগিয়ে, বিভেদ তৈরী করে, বাঙালীর ঐক্যবদ্ধ শক্তি ধবংস করা তথা বাংলা ভাগের রাস্তা প্রস্তুত করা৷ ১৯১২ সালে বাঙলার পশ্চিমাংশের খনিজসম্পদে ভরপুর (ক) ধানবাদ জেলা, (খ) সিংভূম জেলা, (গ) রাঁচী জেলার সিল্লি, সোনাহাতু, বুন্দু, তামার অঞ্চল, (ঘ) হাজারিবাগ জেলার দক্ষিণাংশ, (ঙ) সাঁওতাল পরগণার জামতাড়া, দুমকা, দেওঘর ও কিষাণগঞ্জ অঞ্চল,(চ) উত্তর-পূর্ব ময়ূরভঞ্জ, (ছ) উত্তর কেওনঝড়, পূর্ব সুন্দরগড় অঞ্চল বাঙলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ঘটন করা হল বিহার ও উড়িষ্যা, নামক প্রদেশ। সেই সঙ্গে নতুন এলাকাসহ অসম কমিশনারেটকে পুনঘর্টন করা হয় (যা ১৯৩৬ সালে অসমপ্রদেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে) ফলে বাঙলার আয়তন কমে দাঁড়াল ২,৩৬, ৩২২ বর্গ কিমি তে অর্থাৎ বাঙলার ১,৭৮, ৩৯৯ বর্গ কিমি নিজস্ব অঞ্চল থেকে বাঙলার নাম মুছে গেলো৷ ১৯৪৭ সালে আবার বাঙলা ভাগ হলো, পাকিস্তানের অন্তভুর্ক্ত হলো ১, ৪৭, ৫৭০ বর্গ কিমি ও বাকী অংশের নামকরণ হল পশ্চিবঙ্গ। ১৯৫৫ সালের পুনর্ঘটন অনুযায়ী পশ্চিমবাঙালার ভাগে জুটল মাত্রা ৮৮, ৭৫২ বর্গ কিমি৷ গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের মাধ্যমে নেপালীরা পশ্চিমবঙ্গের ৩,১৪৯ বর্গ কিমি দাবী করেছে৷ অতীতের পোল্যাণ্ডের মতো বাঙলাও পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ধীর ধীরে মুছে যেতে চলেছে৷

১৯৪৭ এ ভারত বিভাজনের পরে, ইংরেজদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জওহরলাল নেহেরু, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারিয়া ও অন্যান্যদের নেতৃত্বধীন ভারত সরকার, বাঙালী জাতির প্রতি সীমাহীন অন্যায়-অবিচার করেছে। উদ্বাস্তু পুনর্বাসন ও নাগরিকত্বের প্রশ্ণে ভারত সরকার বাঙালীদের চরমভাবে বঞ্চিত করেছে৷ পশ্চিম সীমান্তে লোক বিনিময়ের মাধ্যমে সম্ভাব্য উদ্বাস্তুদের এক সঙ্গে ভারতে আসার সুযোগ করে দিয়ে ১৯৪৯ সালের মধ্যে সুষ্ঠ পুনর্বাসন প্রদান করেছে। অথচ বাঙালী উদ্বাস্তুদের লোক বিনিময়ের সুযোগ দেওয়া হয়নি---উল্টে জওহরলাল নেহেরু ১৯৫০ সালের ৮ই এপ্রিল পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে বাঙালীদের আশ্বস্ত করেন তিনি তাঁর মন্ত্রীসভার দুইজন বাঙালী ও পূর্ণমন্ত্রী চারুচন্দ্র বিশ্বাস ও অনিল কুমার চন্দকে পূর্ব বাঙলায় পাঠিয়ে সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধদের দেশ ত্যাগ না করার পরামর্শও দেন৷ সংখ্যালঘু বাঙালীর স্বভাবতই ভারত সরকারের আশ্বাসে বিশ্বাস করে দেশ ত্যাগ না করে মাতৃভমিতেই থাকতে চেয়েছিল৷ সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানে যখন তীব্র ধর্মীয় অত্যাচার, খুন, ধর্ষন ইত্যাদি চুড়ান্ত ভাবে প্রকটিত হয়েছে, তখনই সংখ্যালঘু বাঙালীরা দলে দলে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে৷ পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে, পাঞ্জাবী-সিন্ধি ইত্যাদি উদ্বাস্তুদের সুষ্ঠ ব্যবস্থা গ্রহন করা হলেও বাঙালী উদ্বাস্তুদের চুড়ান্ত ভাবে অবহেলা করা হয়েছে---তাঁদের ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে -ছিটিয়ে নামকাবাস্তে পুনর্বাসনের কাজ শেষ করেছে৷ এখনও লক্ষ লক্ষ বাঙালী পুনর্বাসন পায় নি৷ আজ ভারত সরকার ভিত্তিবর্ষ স্থির করে বাঙালীকে বে-নাগরিক করতে চাইলে, বাঙালীরা মানবে কেন?

নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন ১৯৮৬ ও ২০০৩ পাশ করে, ভারত সরকার কয়েক কোটি বাঙালীকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর লেবেল এঁটে দিয়ে বিদেশী বানিয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গ, অসম, মণিপুর, ত্রিপুরা, মেঘালয়, উত্তরাখণ্ড, হিমাচলপ্রদেশ, উড়িষ্যা, ছত্তিশগড়, আন্দামানসহ ভারতবর্ষের রাজ্যে রাজ্যে বাঙালীরা তীব্র অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে---বাঙালীদের উচ্ছেদ করার জন্য আইন প্রণয়ন তথা সংশোধন করা হচ্ছে৷ অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক অসম চুক্তিকে ১৮৮৫ তে আইনের মর্যাদা দিয়ে বাঙালীকে তাড়াবার দলিল তৈরী করা হয়েছে, তার ভিত্তিতে চলছে দেশ থেকে বহিষ্কার করা, ডিটেনশান ক্যাম্পের নামে জেলে চুকিয়ে রাখা, নাগরিক-পঞ্জী তৈরী করার নামে পূর্ব পুরুষের সম্পর্কে প্রমানের দোহাই দিয়ে ৩০ লক্ষ বাঙালীকে বে-নাগরিক (ডি-ভোটার) করার চক্রান্ত চলছে৷

১৯৩১ সালের জনগণনা অনুসারে অসম রাজ্যে অসমীয়া-ভাষী ও বাংলা-ভাষীরা সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৯,৮২,৫১৬ জন ও ১৯, ৫৪,০৩৫ জন (১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ পূর্ব বাংলার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত শ্রীহট্ট জেলার ২০,০০,০০০ জন বাদে)৷ স্বাধীন ভারত সরকার পরিচালিত ১৯৫১ সালে জনগণনায়, অসমীয়াভাষীর সংখ্যা ৪৯,১৩,৯২৯ জন (বৃদ্ধি ১৫০ শতাংশ)অথচ বাংলাভাষীর সংখ্যা ১৪,৪৭,০০০ জন (হ্রাস ২৫ শতাংশ)৷ একই পথে ১৯৭১-এর জনগণনায় অসমীয়া-ভাষীর সংখ্যা ও বাংলাভাষীর সংখ্যা দাঁড়ায় যথাক্রমে ৮৯,০৪,৯১৭ জন ও ২৮,৮০,০০০ জন৷ দেশভাগের ফলে প্রচুর উদ্বাস্তু অসমে আসা সত্ত্বেও, ১৯৫১-র জনগনায় বাঙালীর সংখ্যা ১৯৩১ সালের সংখ্যা থেকে ২৫ শতাংশ কমে গেল৷ গণিতশাস্ত্রের কোন ম্যাজিকে এটা সম্ভব ?....কোন ম্যাজিকেই সম্ভব নয়। একমাত্র ছল, চাতুরী, মিথ্যা, বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় গ্রহণ করলেই সম্ভব---হয়েছেও তাই৷

১৯৫১ সালের জনগণনায়, জাতীয় কংগ্রেস-পরিচালিত কেন্দ্র ও অসমের রাজ্য সরকারের ষড়যন্ত্রে, কম করেও ২৫ লক্ষ বাঙালীকে অসমীয়াভাষী দেখিয়ে নথিপত্রে কারচুপী করা হয়েছে। ফলে অসমীয়াভাষীদের সংখ্যা বৃদ্ধি তথা সংখ্যা-গরিষ্ঠতা সম্ভব হ’ল৷ ১৯৭১ সালে একই উপায়ে সরকারী নথিপত্রে অসমীয়াভাষীদের গরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও, ১৯৭১ থেকে ‘‘অসু’’-র নেতৃত্বে হিংসাত্বক বাঙালী-বিতাড়ন আন্দোলন শুরু হয় হাজার হাজার বাঙালী খুন হয়৷

১৯৮৫ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে, কেন্দ্রীয় ও অসম রাজ্য সরকার তথা আসু-র মধ্যে ‘‘অসম চুক্তি’’ স্বাক্ষরিত হয় অসমের জন্য নাগরিকত্ব আইনে বিশেষ সংশোধন করা হয়। সেই মত বহু ঘটনার মধ্য দিয়ে অসম চুক্তি কার্যকর করা শুরু হয়---জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এন,আর সি) অদ্যতন করা চলছে---ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ১৯৪৬ ও সংশ্লিষ্ট নিয়মাবলী। ১৯৬৪ অনুযায়ী বাঙালীদের বিদেশী হিসাবে চিহ্ণিত করার পরিকল্পিত নাটক চলছে অসমে৷

‘‘অসম সহিত্য সভা’’-র সোৎসাহ অনুপ্রেরণায় বাঙালী-বিদ্বেষী হিন্দী সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর প্রচ্ছন্ন মদত ও আসু-র নেতৃত্বে, উগ্র- ‘‘অসমীয়া জাতীয়তাবাদী’’-রা, পরিকল্পিত বিদেশী-বিতাড়নের নামে কম-বেশী প্রায় ৩০ লক্ষ বাঙালীকে অসম থেকে উচ্ছেদ করার লক্ষে এগিয়ে চলেছে৷ অসম প্রশাসন ও পুলিশ এ কাজে নির্লজ্জ ভূমিকা নিয়েছে৷ পশ্চিবঙ্গের বাঙালীদের আশ্চর্যজনক নীরবতা, বিভিন্ন রাজ্যে বাঙালী নির্যাতনকারীদের সাহস বৃদ্ধিতে সহায়ক হচ্ছে৷ সম্প্রতি বাঙালী-বিদ্বেষী অসম সরকার নতুন কয়েক হাজার বাঙালীকে বিদেশী সন্দেহে ট্রাইবুন্যাল -নোটিশ ধরিয়েছে। যদিও অসমে চালু ৩৬টি ট্রাইবুনালে ৫ই জানুয়ারী ২০১৩ পর্যন্ত প্রায়, ২, ৩৭,৬৩১ টি কেস জমে রয়েছে৷ মায়াংমারের ইউনান প্রদেশের ‘‘তাই’’ নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী-উদ্ভূত অহোম জাতির ৯০০০ মানুষ (অধিকাংশ পুরুষ) ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দে অসমে বসতি স্থাপন করে৷ সেই অহোমদের উগ্র অসমীয়া জাতীয়বাদী দাদাগিরির অত্যাচারে এক-এক করে পার্বত্য উপজাতী জনগোষ্ঠী অসম থেকে বিচ্ছিন্ন হ’য়ে নাগাল্যাণ্ড, মেঘালয়, নিজোরাম, অরুনাচল প্রদেশের জন্ম দিয়েছে৷ খণ্ডিত অসমের ব্রহ্মপুত্র উপতক্যার প্রকৃত বাঙালী মুলসমানরা যদি ‘‘অহোম-ভীতি’’ কাটিয়ে জনগণনায় তাঁদের আসল মাতৃভাষা বাংলাকে নথিভুক্ত করেন তা’হলে অহোমদের দাদাগিরি চলবে না---এই ভবিষ্যৎ ভীতির কারণে অসমীয়ারা বাঙালী বিতাড়নের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। আর উগ্র অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের প্রতিভু, বিগত ৬৯ বছর ব্যাপী কেন্দ্রিয় সরকারে আসীন দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাঙালাকে খণ্ড-বিখণ্ড করে ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় সরকারে বাঙালীর প্রতিনিধিত্ব খর্ব করে বাঙালার সম্পদ লুন্ঠন করছে৷

নেপালীরা অর্থাৎ গোর্খা, লিম্পো, থারু, মগর, শেরপা, গুরুং, রাই নেবারী, তিববতী ইত্যাদি জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষ বা পশ্চিমবঙ্গ অথবা দজিলিং পাহাড়ের ভূমিপুত্র নয়---মূল অধিবাসীও নয়৷ সিকিম ও দার্জিলিং মুখ্যতঃ লেপচা-ভূটিয়াদের দেশ৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০০১ সালে প্রকাশ করে এল.এস.এস ও ম্যালের ১৯০৭ সালের ‘‘বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার্স, দার্জিলিং’’ সেখান থেকে জানা যায়, ১৮৫০ সালে দার্জিলিং পাহাড়ের জনসংখ্যা ১০০০০জন ৷ ১৯৫১ সালের জনগণনার তথ্যানুসারে, দার্জিলিং জেলার নেপরী-ভাষাভাষী ভারতীয় নাগরিককে (Indian Nepalese) সংখ্যা ৮৮, ৯৫৮ জন৷ এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন, বিজেপি-র রাজ্যসভার সাংসদ শ্রী প্রভাত ঝা ২০১০ সালের ২১ শে এপ্রিল, বুধবার, তিনি রাজ্যসভায় উল্লেখ করেছেন, ‘‘.......the census of 1951 for Darjeeling District Projected the nepali-speaking population as a miniscule minority by showing Nepali-speaking population only 17 per cent.’’ ‘গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা’---প্রকাশিত ‘হোয়াই গোর্খাল্যাণ্ড’ (why Gorkhaland) নামক পুস্তিকাতেও নিশ্চিত করা হয়েছে---‘“The cencus of Darjeeling....the Nepali-speaking population was shown as only 17 percent....’’ (অর্থাৎ দার্জিলিং এর মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ মাত্র নেপালী-ভাষা মানুষ)।

ইতোপূর্বে ১৯৫০ সালে, ভারতবর্ষ ও নেপাল সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়, ‘‘ভারত-নেপাল শান্তি ও মৈত্রী চুক্তি ১৯৫০’’৷ উপরিউক্ত চুক্তি অনুযায়ী ভারতবর্ষের নাগরিক নেপালে আর নেপালের নাগরিক ভারতবর্ষের যে কোন স্থানে যাতায়াতে করা, সম্পত্তি, ক্রয়-বিক্রয় করা, স্থায়ীভাবে বসবাস করা, চাকুরী গ্রহন সহ উপার্জনমূলক অর্থনৈতিক উৎপাদন-উদ্যোগ-ব্যবসা-বানিজ্য ইত্যাদি করতে পারবে কিন্তু অটোমেটিক নাগরিকত্ব লাভের কোন গল্প চুক্তির শর্তে নেই৷ স্বভাবতঃই ভারতবর্ষের সংবিধানের ৫ নম্বর ধারা অনুসারে, ১৯৫১ সালের গণনা-লব্ধ দার্জিলিং জেলার ৮৮, ৯৫৮ জন নেপালী ও তাদের উত্তর পুরুষরাই একমাত্র ভারতীয় নেপালী Indian Nepalese) অর্থাৎ ভারতীয় নাগরিত নেপালী৷

ঘটনা হচ্ছে, ১৯৫০ সালের ভারত-নেপাল চুক্তি অনুযায়ী নেপালীরা দার্জিলিং-ডুয়ার্স-জলপাইগুড়িতে আসছে থাকছে চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি উপার্জনমূলক কাজকর্ম করছে জমি-সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয় করছে---করতে পারে করবে৷ চুক্তি অনুযায়ী উপরিউক্ত সব কাজই বৈধ৷ শুধুমাত্র ১৯৫০ সালের পরে ভারতবর্ষে প্রবেশ করা নেপালী ভাই-বোনদের ও তাদের বংশধরদের নাগরিকত্ব লাভের কাজটা সম্পূর্ণ অবৈধ--- বে-আইনী কাজ৷ নাগরিকত্ব অর্থাৎ নাগরিকত্ব সঞ্জাত অধিকার, যেমন, ভোটাধিকার প্রাপ্তি, ভোটদান, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতা করা ( এম,এল, এ/ এম, পি হওয়া) ত্রি-স্তরীয় পঞ্চায়েত রাজের নেতৃত্ব প্রদান করা তথা আলাদা রাজ্যের দাবী জানিয়ে উগ্র অগতান্ত্রিক আন্দোলন সংঘটিত করা ইত্যাদি স্পষ্টতঃই অবৈধ কারণ দু-দেশের মধ্যেকার ‘‘শান্তি ও মৈত্রী চুক্তি’’ - অনুযায়ী নেপালীরা ভারতবর্ষে আটোমেটিক নাগরিকত্বের অধিকারী নয়৷ তাহলে ভারতবর্ষে বা পশ্চিমবঙ্গে গোর্খা বা নেপালীরা নগরিকত্ব পায় কিসের ভিত্তিতে? শাসন কার্যে অংশগ্রহন করতে পারছে কিভাবে? সংবিধানের কোন অধিকার বলে ‘‘গোর্খাল্যাণ্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন’’ তৈরী হয়? উত্তর দেবার কেউ নেই সরকার নীরব৷ ভারত সরকার শুধুমাত্র বাঙালীদেরকে বিদেশী ঘোষণা করে তাড়িয়ে দেবার কাজে অতি ব্যস্ত কেন? অসমে বাঙালীদের বিদেশী বানাবার কাজে যুদ্ধকালীন তৎপরতা সত্ত্বেও পশ্চিমবাংলার বাঙালী সরকার এসব বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে আছেন৷ ১৯৫০ সালের মৈত্রী চুক্তির পূর্বে কত নেপালী ভারতবর্ষে ছিলেন এবং বর্তমানে কত নাগরিক পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ি জেলায় আছেন তার কোনও সুপষ্ট আইনানুগ সংখ্যাত্তত্ব নেই৷ ভারতবর্ষে বিদেশী নেপারীরা বসবাস করলেই নাগরিকত্ব পায়, অথচ স্বাধীনতা যজ্ঞের পুরোধা বাঙালীরা ভারতবর্ষে স্থায়ী ভাবে বসবাস করলেও নাগরিকত্ব পায় না৷

আমাদের জানতে হবে, দার্জিলিং জেলায় প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক নেপালী (Indian Nepalese)-র সংখ্যা৷ ১৯৫১ সালের সরকারী গণনালব্ধ ৮৮,৯৫৮ নেপালীবাসী ভারতীয় নাগরিক প্রতি দশকে ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি ধরে, ২০১০ সালের ডিসেম্বর ভারতীয় নাগরিক নেপালীর সংখ্যা হচ্ছে ৩০৮,০০০ জন৷ ২০১১ সালের সরকারী জনগণনায দার্জিলিং জেলার লোকসংখ্যা ১৮, ৪৬, ৮২৩, জন৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লিখিত ঘোষণায় জানা যায়, দার্জিলিং জেলায় ভারতীয় নাগরিক নেপালী (Indian Nepalese) ও বিদেশী নেপালী (Foreigener Nepalese) -র সংখ্যা দাজিলিং জেলার মোট জনসংখ্যার ৫৮:৪ শতাংশ৷ সে হারে ২০১০ -এ দার্জিলিং জেলায় বিদেশী নেপালীদের সংখ্যা কম-বেশী ৮৮৪৬,০০০৷

নেপাল সরকারের ২০০৪ সালের ডিসেম্বরের রেকর্ড অনুযায়ী প্রতি ঘন্টায় ২০০ জন নেপালী ভারতবর্ষে জীবিকার সন্ধানে প্রবেশ করছে৷ কাঠমাণ্ডু পোষ্ট-এর ১৯-১২-২০১৪ তারিখের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিদিন জীবিকার সন্ধানে ১৫০০ নেপালী ভারতবর্ষে প্রবেশ করছে৷ উপরিউক্ত তথ্য প্রমান করছে, দার্জিলিং-এর প্রতি চার (৪) জন নেপালীর মধ্যে তিন (৩) জনই বিদেশী নেপালী৷ স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ণ উঠছে, গোর্খা কারা? সংখ্যাধিক্য বিদেশী নেপালীদের স্বার্থে বাঙলা ভাগের চক্রান্ত করছে কারা? ‘গোর্খাল্যাণ্ড টেরিটোরিয়্যাল অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন’ সরকারী স্বীকৃতির পূর্বে ‘গোর্খাল্যাণ্ড’ শব্দটিকে বাদ দেওয়া হল না কেন? তথ্যসূত্রে জানা যাচ্ছে, জলপাইগুড়ি জেলায় রয়েছে প্রায় ৪০০,০০০ (চার লক্ষ) নেপালী৷ সত্য উদঘাটনের একমাত্র পথ, কঠোর অনুশাসনভিত্তিক জনগণনা৷

বাঙলা-কে খণ্ড-বিখণ্ড করার কাজ শুরু করেছিল সামাজ্যবাদী ব্রিটিশরা ১৮৭৪ সালে৷ পরবর্ত্তীকালে ব্রিটিশদের সেই বাঙালীবিরোধী ষড়যন্ত্রে এক এক করে যোগদান করে, মুসলীম লীগ, কম্যুনিষ্ট পাটি ও জাতীয় কংগ্রেস৷ ইংরেজরা বাঙালার ভূ-খণ্ডগত ঐক্যের অধিকাংশই ধবংস করে ১৯৪৭ সালে বাঙলা তথা ভারত ছেড়ে চলে গেছে৷

ইংরেজদের অসমাপ্ত কাজ দ্রুত শেষ করে চলেছে, স্বাধীন ভারতবর্ষের বাদামী শোষকেরা পশ্চিমা হিন্দি ভাষা-সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিপতিরা ও তাদের নিলর্জ্জ রাজনৈতিক প্রহরীরা---অর্থাৎ পশ্চিম শিল্পপতি ব্যাবসায়ী ও ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় সরকার তথা বিভিন্ন রাজ্য সরকার৷ ভারতবের্ষ বাঙালী বাঙলী ছাড়া যেকোন জাতি জনগোষ্ঠীর মানুষ নাগরিকত্ব পেতে পারে--- পাচ্ছে ওপাবে৷ কয়েক কোটি বাঙালীকে বিদেশী বানাবার সুদূর প্রসারী চক্রান্ত অনুযায়ী কাজ শুরু করে দিয়েছে হিন্দি-উর্দু সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (INC) ও বি,জে,পি (BJP) যথাক্রমে ১৯৮৬ ও ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব আইন পরিবর্তন এনে, কোটি কোটি বাঙালীকে বিদেশী ঘোষণা করার আইন চালু করে রেখেছে৷ বাঙালী জাতিকে নাগরিকত্বহীন, জলের ওপরে থাকা শেকড়হীন শ্যাওলার মত, ভাসমান জনগোষ্ঠীতে পরিনত করার প্রশ্ণে জাতীয় কংগ্রেস ও বি,জে,পি, অভিন্ন হৃদয় বন্ধু কারণ দু’টি দলই হিন্দি উর্দু সামাজ্যবাদী পূঁজিপতিদের হাতের পুতুল (মাত্র)৷ বাঙালী জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব, অধিকার, মাতৃভাষার অবদমন প্রসঙ্গে, একমাত্র ‘‘আমরা বাঙালী’’ ছাড়া ঠিকানা পশ্চিমবঙ্গের বি,জে,পি/কংগ্রেস/টি,এম,সি/সি,পি,এম-এর অনান্য রাজনৈতিক দলগুলোর কোন বক্তব্য নেই--- কোন ভূমিকাও নেই৷ বাঙলার যুব ছাত্র সমাজ দিশাহারা---বুদ্ধিজীবি সমাজ নীরব, যেন বোবা-কালা-বধির-স্থবিরতাঁদের মুখে রা-টি কাড়ছে না৷

এখন প্রসঙ্গ ঃ বাঙালী জনগোষ্ঠীর ক্ষাত্রশক্তি, সাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তা ও আত্মিক শক্তি৷ মাতৃভাষায় পঠন-পাঠন ও দৈনন্দিন জীবনের ভাব প্রকাশ করতে না পারলে, সংশ্লিষ্ট ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে---(ক) বৌদ্ধিক অনগ্রসরতা প্রথমে ধীরে ধীরে জীবনের সর্বকাজে পরাজিতের মনোভাব বৃদ্ধি পায় (খ) হীনম্মন্যতাবোধ ও ভীতম্মন্যতাবোধ বৃদ্ধি পায়৷ এ বিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে ইংরেজরা বাঙালী জনগোষ্ঠীর ক্ষাত্রশক্তি, সাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তা, ও অত্মিক শক্তি ধবংশ করার চক্রান্ত শুরু করেছিল পূর্বাহ্ণেই সে উদ্দেশ্য ইংরেজরা ১৮৫০ সালে অধিক আরবী পার্সী, প্রবাবিত উর্দু ভাষাকে ভারতবর্ষের প্রশাসনিক ভাষা ঘোষণা করে তার পরস্পরই উর্দু বা হিন্দুস্থানী বুলিতে সংস্কৃত তৎসম -তদ্বভ শব্দের সংখ্যাধিক্য ঘটিয়ে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে হিন্দী ভাষার জন্ম সুনিশ্চিত করে৷ গঙ্গা-যমুনার দোয়াব এলাকা অর্থাৎ উপত্যকা এলাকার বুলি ‘‘খালিবোলি’’ বা ‘‘খারি’ বুলি---যা মূলতঃ উর্দু বা হিন্দুস্থানী ভাষার বুলি৷ ভাষা-ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ বলেন, ‘‘খরিবোলি’’ বা ‘‘খরি’ বুলিই হিন্দিতে রূপান্তরিত হয়েছে৷ বিংশ শতাব্দীর ভাষা বিশারদ দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের অভিমত---‘‘...উর্দু বা হিন্দুস্থানী ভাষা থেকে পরবর্ত্তীকালে আরবী-ফার্সী তুর্কী শব্দ কমিয়ে ও সংসৃকত তৎসম ও তদ্ভব শব্দ বাড়িয়ে দিয়ে হয়েছিল ফার্সীর বদলে নাগরী অক্ষরে....৷

উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালীর নবজাগরণের প্রভাবে, ভবিষ্যত ভারতবর্ষের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে, ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা হিন্দি ভাষার জন্ম ঘোষণা করে৷ ১৮০০ খ্রীঃ কলিকাতায় প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রথম প্রিন্সিপ্যাল জন বি গিলক্রিস্ট, যথাক্রমে ১৭৮৬ ও ১৭৯০ সালে ইংরাজী-হিন্দুস্তানী হিন্দী অভিধান ও হিন্দী ব্যকরণ প্রকাশ করেন। কলিকাতার প্রথম হিন্দী সংবাদপত্র ‘‘উদন্ত মড়টান্ডা (Udanta MARTANDA) ১৮২৬ সালে এই কলিকাতা থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল৷ ইংরেজরা প্রশাসনিক কাজেও হিন্দীর ব্যবহার শুরু করেছিল৷ সরকারী কাজ, বিভিন্ন প্রচারবিভাগ-সহ নানাবিধ কৌশল হিন্দির প্রচার-প্রয়োগ চালাতে লাগলো ইংরেজরা। একটা উদাহরণঃ মেদিনীপুর মেজিস্ট্রিট বার্ড পেডি ডগলাসের হত্যার পরে, বিপ্লবী-যুব সমাজের আত্মিক শক্তি-সংযম হননের উদ্দেশ্যে, ইংরেজরা, মেদিনীপুর শহরে ‘অরোরা’ সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা করল। যৌন-আবেদন-মূলক হিন্দী ছবি দেখানোর ব্যবস্থা করল। মেদিনীপুর শহরের বিবিগঞ্জ, অলিগঞ্জ এলাকায় পতিতালয় চালু করেছিল সুসভ্য ইংরেজ শাসকরা৷ হিন্দী, উর্দু সাম্রাজ্যবাদীদের পাহারদার রাজনৈতিক দলগুলি (জাতীয় কংগ্রেস, বি,জে,পি ও তাদের সহযোগী আঞ্চলিক দলগুলো)’’ স্বাধীনতার ঊষালগ্ণ থেকে বাঙলা ভাষা-সংসৃকতির অবদমনের ক্ষেত্র ও কৌশল লক্ষ্যণীয়।

(১) ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এর মধ্যে কয়েক কোটি বাঙালীকে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, ছত্রিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, উড়িষ্যা, অসম প্রভৃতি রাজ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়৷ তাঁদের জন্য নামমাত্র প্রাথমিক বা কোথাও কোথাও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল কিন্তু বাংলা ভাষার পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষকের ব্যবস্থা নেই৷ ছাত্র-ছাত্রারা মাতৃভাষা শিখতেই পারছে না হিন্দী, তামিল, মিতেই, উড়িষা, অসমীয়া, ইত্যাদি মাধ্যমে পড়াশুনা করতে বাধ্য হচ্ছে৷

(২) আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ২৫টি বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়কে, ভারত সরকারের ‘‘এন,সি,ই,আর,টি (NCERT)’’ বিভাগ ১৯৫৫ সাল থেকে, বাংলা পাঠপুস্তক ও শিক্ষকের ব্যবস্থা না করে হিন্দি ও তামিল মাধ্যমে রূপান্তরিত করেছে৷

(৩) মানিপুরের জিরিবাম জেলার ৫৬ টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরীয় বাংলা মাধ্যমে বিদ্যলায়, ‘মিতেই’ মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে৷

(৪) ঝাড়খণ্ডের গড় ৭০ শতাংশ মানুষ বাঙালী সেখানকার সমস্ত বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় হিন্দী মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে৷ সরকারী কাজের ভাষা হিন্দি৷

(৫) খোদ পশ্চিমবঙ্গের সরকারী-বেসরকারী কাজ-কর্ম বাংলা ভাষায় করা হয় না৷ সমস্ত প্রাথমিক-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাংলা পড়ানো হয় না৷

(৬) জাতীয় সংহতির প্রতীক ‘‘কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়’’ গুলিতে বাংলা ভাষা পড়ানো হয় না৷ পূর্বের ‘‘ত্রি-ভাষা সূত্র’’ বন্ধ করে, হিন্দী-ইংরেজীর সঙ্গে একটি ভারতীয় ধ্রুপদী ভাষা (ক্লাসিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ) পড়ানোর ফরমান জারী করা হয়েছে আর ভারত সরকারের বিচারে বাংলা ভাষা ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পায় নি৷

(৭) পৃথিবীর চতুর্থ (মতান্তরে ৫/ষষ্ঠ) সংখ্যাগরিষ্ঠ, এশিয়ার প্রথম ও একমাত্র নোবলেজয়ী ভাষা তথা ভারতবর্ষের সব থেকে বেশী শব্দভান্ডার (সংস্কৃত বাদে) ও দ্বিতীয় সংখাগরিষ্ঠ ভাষা বাংলা-কে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা ভারত সরকার দেয় নি৷

(৮) দিল্লীর কেন্দ্রীয় টিভি চ্যানেলগুলিতে ভারতের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা বাংলায় তথা বাংলা-র কোন প্রোগ্রাম নেই৷

(৯) ভারতীয় পার্লামেন্টের ধারাবিবরণী, প্রশ্ণোত্তর, বা সিদ্ধান্ত, বাংলা ভাষার প্রকাশিত হয় না৷

(১০) দক্ষিণ ভারতের অন্ধপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও কেরালা তে ব্যাঙ্ক সহ সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকারী অফিসের কাজ-কর্ম-সংক্রান্ত ফর্ম-প্রত্রাদি আঞ্চলিক ভাষায় ছাপা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে হয় না৷

(১১) নোবেলজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কে জাতীয় কবির স্বীকৃতি ভারত সরকার দেয় না। তাঁকে ভারতরত্ন-সম্মানও দেয়নি৷

(১২) ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বজন গ্রাহ্য মহানায়ক, বিশ্বের বিপ্লবীদের হৃদ-স্পন্দন, রাজনীতির জ্বলন্ত ধূমকেতু, পৌরুষের বজ্রকৌস্তভ, উল্কার অনল-জ্বালা, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিনকে ‘‘দেশপ্রেমিক দিবস’’ ঘোষণা ও তাঁকে ‘‘ভারতরত্ন’’ সম্মান দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় না মাহামান্য ভারত সরকার৷

(১৩) পশ্চিমবঙ্গের বেতার, দূরদর্শন তথা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের অনুষ্ঠান নেই বললেই চলে৷ হিন্দী অনুষ্ঠানের রমরমা৷

(১৪) বাঙলায় পরিচ্ছন্ন বাংলা ভাষায় বঙ্গ সংস্কৃতি-কেন্দ্রিক কোন এফ.এম. (F.M) চ্যানেল নেই৷

(১৫) নতুন দিল্লী থেকে ‘টাইমস্ অফ ইণ্ডিয়া’-র ০৬-১০-২০১৫-তে প্রাপ্ত খবর জার্মানির রাষ্ট্রপ্রধান শ্রীমতী এ্যাঞ্জেলা মার্টেলের তিন দিনের ০৪-১০-২০১৫ থেকে ০৬-১০-২০১৫) রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতবর্ষের অবস্থান কালে, ভারতবর্ষ ও জার্মানির মধ্যে ১৮টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তার একটি ভারত-জার্মান শিক্ষা বিষয়ক চুক্তি: ভারতবর্ষে জার্মান ভাষা শেখানো হবে আর জার্মানিতে ভারতবর্ষের চারটি ভাষা শেখানো হবে--- সংস্কৃত, হিন্দি, তামিল ও মালায়ালাম৷৷ উপেক্ষিত বাংলা ভাষা--- যে ভাষায় রচিত ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেয়েছে৷৷

(১৬) কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা কেন্দ্রীয় সরকারী দপ্তর সমূহে, ত্রি-ভাষা সূত্র মেনে প্রতিটি সরকারী কাজে হিন্দি ও ইংরাজীর পাশাপাশি প্রাদেশিক ভাষাকেও সমান গুরুত্ব দেওয়াটাই আইনসিদ্ধ৷ ১৯৮৬ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী ত্রি-ভাষা সূত্র পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, জওহর নবোদয় বিদ্যালয়, সৈনিক স্কুল এ্যটমিক এনার্জী স্কুল, রেল ও অন্যান্য দপ্তর পরিচালিত বিদ্যালয়ে মানা হয় না৷ (ক্রমশঃ)