শ্রীপ্রভাতরঞ্জনের গল্প

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

নুকাইঁ নুকাইঁ

তৃতীয় ধরনের কপটাচরণও আমরা কম দেখি নাঙ্গ শুনেছিলুম, আমেরিকায় এক ভদ্রলোক একটি প্রচণ্ড রকমের মদ্যপানবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন৷ এক জনসভায় মদের অপকারিতা সম্বন্ধে তিনি ওজস্বিনী ভাষায় ঠায় এক ঘণ্ঢা বত্তৃণতা করেছিলেন৷ তারপর বললেনউঃ, উঃ গলা শুকিয়ে গেছে, এক গ্লাস ব্র্যাণ্ডি দাও৷  

* * * * * * * *

সেবার আমি সাহেক্ষগঞ্জ থেকে দুমকা যাচ্ছি৷ সুদীর্ঘ পথ৷ সাহেক্ষগঞ্জ শহর পার হবার পরই শুরু হল পাহাড় আর জঙ্গল৷ পশ্চিম রাঢ়ের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি রমণীয়৷ ইচ্ছে হ, এই পাহাড়জঙ্গলের মধ্য দিয়ে মাইল খানেক পায়ে হাঁটি৷ গাড়ি থেকে নেবে পড়লুম..........হাঁটতে শুরু করলুম৷ কিছু দূর যাবার পর দেখছি, পায়ে নতুন জুতোপরা সাতআট বছরের একটি ন্যাংটো ছেলে কঞ্চি দিয়ে মাঠের একটি গর্ত্তের মধ্যে খোঁচা দিচ্ছে৷ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলুমতুর নাম কী বটেক?

সে বললেরামকৃষ্ণ তুরী বটেক গো৷

আমি বললুমকী করছিস বটেক?

ছেলেটি বললেইন্দুর ধরছি৷

আমি জিজ্ঞেস করলুমইন্দুর লিয়ে কী করবি?

সে বললেপুড়াই খাব৷

আমি জিজ্ঞেস করলুমব্রাহ্মণকায়স্থরাও খায়?

সে বললেহঁ, উয়ারা নুকাইঁ নুকাইঁ খায়৷

এই নুকাইঁ নুকাইঁ খাওয়ালোকের সামনে নিজের ত্রুটি ঢাকার অপচেষ্টা৷ এটাও এক  ধরনের কপটতা৷

ধরা আর সরা

দেশজ শব্দে যথাযথভাবেই বজায় থাকে৷ আর বা মৌলিক শব্দ হিসেবেই থেকে যায়৷ যেমন, আজ ভুলোর সঙ্গে ভোঁদার আড়ি হয়ে গেল৷ ওরা বলছে, ওরা আর একসঙ্গে মার্বেল খেলবে না, একটা পেয়ারাও আর কামড়াকামড়ি করে খাবে না৷ গোপনে কান পেতে শোনাকেও আড়িপাতা বলে৷ এটিও বাংলা দেশজ শব্দ৷

সেই যে একজন মহিলা আহ্লাদে আটখানা হয়ে তার এক বেন্ধুকে বলেছিলতোমার সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তা ভাষায় বলতে পারছি না৷ বন্ধু বলেছিল, তোমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তার একটু আভাস আমায় দাও৷ মহিলাটি বলেছিল, আহ্লাদের আতিশয্যে আমার এখন ধরাকে সরা মনে হচ্ছে৷ সেই সময় হয়েছে কী, একজন চাষীর গোরু হারিয়ে গেছে৷ সে গোরু খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে যে বাড়ির বারান্দায় বসেছে সেই বাড়িরই ঘরের ভেতর ওই মহিলাটি বলছেআমি আনন্দের আতিশয্যে ধরাকে সরা মনে করছি৷ চাষী আড়ি পেতে কথাটা শুনে নিলে৷ এবার সেও আনন্দের আতিশয্যে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে ঘরের বাইরে থেকে ওই মহিলাটিকে গড় করে বললেমা লক্ষ্মী, এই বিরাট ধরাটা যখন তোমার কাছে সরা হয়ে গেছে তখন দয়া করে বলে দাও, ওই সরার কোন্খানটিতে আমার গোরুটা রয়েছে৷

উলুবেড়ে লোক্যাল

অনেকে ভাবে, বিতর্ক মানে তর্কসংক্রান্ত বা তর্কযুক্ত জিনিস৷ কথাটি আংশিকভাবে সত্য৷ বিশেষ ধরনের তর্ককে বিতর্কবলা হয়৷ কিন্তু এটাই বিতর্কশব্দের শেষ কথা নয়৷ বিতর্কমানে অতি জল্পন (অহেতুক বকবক করা)৷ এই বকবক করার সঙ্গে যদি বদ্মেজাজ বা প্রগল্ভতা সংযুক্ত থাকে তবে তা বিতর্কপর্যায়ভুক্ত–‘কষায়পর্যায়ভুক্ত হবে না৷ নীচে কয়েকটা বিভিন্ন স্বাদের বিতর্কের দৃষ্টান্ত দিচ্ছি

একজন হাওড়া ইষ্টিশনে গেছে৷ একটু দেরী হয়ে গেছে৷ একজন ভদ্রবেশধারী মানুষকে জিজ্ঞেস করলেদাদা, উলুবেড়ে লোক্যাল ছেড়ে গেছে? ভদ্রলোক মুখ ঝামটা দিয়ে খেঁকিয়ে বলে উঠলেনউলুবেড়ে লোক্যালের খবর রাখা কি আমার ডিউটি? আমাকে কি টাইমটেবল পেয়েছেন? আশ্চর্য সব বেআক্কিলে লোক.........যত্ত সব........যত্ত সব....... এই জন্যেই দেশটার উন্নতি হচ্ছে না.......আমি এন্কোয়ারী অফিস নাকি?

কাছেই আর একজন মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ তিনি বললেন, উলুবেড়ে লোক্যালের খোঁজ নিচ্ছেন৷ হ্যাঁ, গাড়িটা আজ পাঁচ মিনিট দেরীতে ছাড়ছে৷ ছাড়ছে এগার নম্বরপ্লাটফরম থেকে৷ একটু তাড়াতাড়ি পা চালালে গাড়িটা ধরতে পারবেন৷ 

প্রথমোক্ত ঘটনাটি বিতর্কের দৃষ্টান্ত, দ্বিতীয়োক্তটিকে বলা হয় প্রমিত বাক্৷ প্রমিত  বাকে দরকার মত কথাটাই কেবল বলা হয়, আজেবাজে কথা বলা হয় না৷