ত্রিপুরার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

পূর্ব প্রকাশিতের পর

 এই বর্ণচোরা মানিকদের সহজে চেনা বড়ই কঠিন ---শাদা, লাল, গেরুয়া, গোলাপী, বা পাজামা-ধূতি -পঞ্জাবী,ফতুয়া-টুপী-লুঙ্গি বা তিলক - তসবির- রামাবলী-আলখাল্লা কোনটাতেই প্রয়োজনে অরুচি হলে তখন হাতে বোমা-পিস্তল-বন্দুকের নলকেই শক্তির উৎস বলে চালিয়ে দেওয়া ওদের রপ্ত হয়ে গেছে৷ ওই শ্রেণীর নেত-নেত্রীরা আসলেই রাজনীতির ময়দানে অতি-ধুরন্ধর অভিনেতা-অভিনেত্রী ছাড়া আর কিছু নন৷ তাই, ওদের পাতানো ফাঁদে পা রেখে ওদের ছিটিয়ে দেওয়া টোপ গিলেই বিগত প্রায় সাত দশক ধরে সম্যক ভারতবাসীর  সঙ্গে আমাদের ত্রিপুরাবাসীরা পাহাড়ী-বাঙালী বা জাতি-উপজাতি/জনজাতি নির্বিশেষেই শিকারে পরিণত হয়ে বিভ্রান্তিবশতঃ মোহান্ধকারে শুধুই হাবুডুবু খেয়ে চলেছে৷ কখনও সাম্প্রদায়িক উস্কানি, কখনও জাতি-জনজাতি নির্বিশেষেই শিকারে পরিণত হয়ে বিভ্রান্তিবশতঃ মোহন্ধকারে শুধুই হাবুডুবু খেয়ে চলেছে৷  কখনও ধর্মীয় গোঁড়ামির উন্মাদনা, কখনও আইডেনটিটির লড়াই বা মাটির মালিকানা-সম্পর্কিত সেন্টিমেন্টের এলার্জি তথা সুড়সুড়ি কখনও আবার তথাকথিত স্বাধীনতার ইউটোপিয়া অর্থাৎ আলাদা রাজ্য তৈরী বা অঞ্চল গড়ে তোলার এককথায় --- অবচারড ইন দ্য ওপেন স্কাই’ গড়ার খোয়াব দেখিয়ে আসলে যে মুনাফালোভীরা লোক সাধারণকে ইউটিলাইজ করে ধান্দাবাজদেরই পোয়াবারো হয়ে থাকে, এইটুকু সত্যও নিম্ন মধ্যবিত্ত গরীব, শিক্ষিত ---অশিক্ষিত, জুমিয়া--- শহরবাসী, গৃহস্থ-গৃহহীন নির্বিশেষে বুঝে নিতে ভুল করে থাকেন৷ আর এটাই হচ্ছে জাতি-জনজাতি নির্বিশেষে আমাদের সাধারণ চিন্তা-চেতনার জনগণের  জীবনে বিরাট ট্র্যাজেডি৷ তাই, তাঁরা সর্বক্ষেত্রেই পোলটিক্যাল ম্যাজিশিয়ানদের জাদুকরী চালটাকেই বড় করে দেখতে গিয়ে বারবারই ভুল করে থাকেন এজন্যেই, নেতা-নেত্রীর বদল হয়, পার্টির পতাকার রঙ বদল হয় অথচ ছা পোষা জনগণের  ভাগ্যলিপি বদলায় না৷ দিন কতক আগে জনৈক দেববর্মা মশাইয়ের একটা লেখা নজরে এল৷ এতে দেখলুম উনি প্রশ্ণ তুলেছেন গুটিকয়েক৷ প্রশ্ণগুলো দেখে আমি অনুভব করতে সক্ষম হয়েছি যে এর পেছনে প্রশ্ণকর্র্তর মনে বেশ ক্ষোভ জমা রয়েছে আর ক্ষোভের কারণ হচ্ছে মূলতঃ বঞ্চনা ও হতাশা আর এরও  পেছনে সঠিক সচেতনতার অভাববশতঃ কিছুটা হয়তো সংশয় অসহিষ্ণুতা৷ যেমন, একটা প্রশ্ণ তুলেছেন তিনি যে, সমতল ত্রিপুরার বাঙালী ত্রিপুরার রাজাদের প্রজা সাধারণ হবার সুবাদেই তাঁরা খাজনা বা রাজস্ব দিতেন আর প্রাপ্ত সেই অর্থ ছিল রাজপরিবারের ভরণ-পোষণ, সৈন্যসামন্তদের রসদ যোগান, রাজ্যের উন্নয়নমূলক ব্যয়---নির্বাহের প্রধান উৎস৷ কথাটি সর্বাংশে যে সত্য তা তিনি ইতিহাস ও রাজন্য আমলের দলিল-দস্তাবেজ ঘাঁটলেই যথার্থ প্রমাণ পেতে পারেন৷ কিন্তু সেজন্যে সংকোচবোধের কোন কারণ নেই৷ কেননা, রাজন্য আমলে পার্বত্য ত্রিপুরার প্রজা সাধারণ তথা পাহাড়বাসী জুমিয়ারা তখন ছিলেন রাজাদের নিষ্কর প্রজা মাত্র৷ প্রতিবছর দুর্গাপূজার সময়ে রাজবাড়ীতে সেই প্রজাগণ নিমন্ত্রিত হয়ে আসতেন ও তখন যে যার সাধ্যমত তাঁদের জুমের ফসল এনে রাজাকে উপঢৌকন দিতেন---এইটুকুমাত্র৷ মোগল আমলে সমতল ত্রিপুরা চাকলা-রোশনাবাদ হয়ে কিছুদিনের জন্যে হাতছাড়া হয়েছিল৷ পরবর্তী ব্রিটিশ আমলে সেটি আবার পুনরুদ্ধার হলে ব্রিটিশ এর নাম পাল্টে ‘‘ত্রিপুরা ডিষ্ট্রিক্ট’’ নাম করে দিয়ে ত্রিপুরাধিপতিকে এই পার্বত্য ত্রিপুরার রাজা ও ত্রিপুরা জেলার জমিদার বলে ঘোষণা করেছিলেন--- একথা সবৈব ঐতিহাসিক সত্য৷ দ্বিতীয় প্রশ্ণ, বাংলাভাষা ত্রিপুরার রাজভাষা ও রাজপরিবারের কথোপকথনের ভাষা, আর সেইসঙ্গেই শ্রীচৈতন্যদেবের গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মে রাজ পরিবারের দীক্ষিত হবার বিষয় নিয়ে৷ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু একবার মণিপুরে এসেছিলেন সীলেটের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মপ্রচারের জন্যে৷ তখনই তিনি ত্রিপুরায় এলে ত্রিপুরার রাজ পরিবার ও পরিষদবর্গ শ্রীচৈতন্য দেবের কাছ থেকে দীক্ষা পান৷ তখন থেকে ত্রিপুর রাজ্যের ঘোষণা ছিল যে, গুরুর ভাষাই তাঁদেরও ভাষা, গুরু সংস্কৃতিই তাঁদের সংস্কৃতি৷ ১৪৬৪ খ্রীঃ উপজাতি -সর্দার ডাঙ্গরফা-র কনিষ্ঠ পুত্র রত্নকা ঢাকার সুলতান রুকন্‌-উদ-দীন বারবার সা-র সহযোগিতায় রত্নমাণিক্য নাম ধারণ করে ত্রিপুরার রাজ-সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন৷ ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে যে, রত্নমাণিক্য হলেন আনুষ্ঠানিকভাবে রাজপদে অভিষিক্ত সর্বপ্রথম ত্রিপুরাধিপতি৷ সেই  রত্নমাণিক্য ঘোষণা করেছিলেন বাংলাভাষাকে ত্রিপুরার ‘‘রাজভাষা’’ হিসেবে আর সেই আদেশ বহাল ছিল ১৯৪৯ সালে ১৫ই অক্টোবর ত্রিপুরার ভারত ডোমিনিয়নে যোগ দেবার দিন পর্যন্ত৷ অবশ্য এর পূর্বে রাজা  রত্ন মাণিক্যের পূর্বপুরুষ মুচাং-ফা যার নেতৃত্বে টিপরাগণ এদেশে এসেছিলেন তিনি নিজে বাংলাভাষা না জানলেও বাংলাভাষাই এখানে চালু হোক বলে তাঁর অনুগামীদের প্রেরণা যোগাতেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়৷ মু-চাং-ফা-র কয়েক পুরুষ পরবর্তী ডাঙ্গরকা নিজেই তাঁর ছেলেকে ঢাকার সুলতানের সহযোগিতা চেয়ে রত্নফাকে পাঠিয়ে ছিলেন৷ ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্রমাণিক্য নিজেই ছিলেন বাংলাভাষার কবি ও গায়ক সঙ্গীতকার৷ রাজকুমারী অনঙ্গমোহিনী দেবী ও ছিলেন এক মহিলা কবি বাংলাভাষার৷ বীরচন্দ্রের পরে রাধা কিশোর, বীরেন্দ্র কিশোর, বীর বিক্রম কিশোর --- এই চার পুরুষ ধরে ত্রিপুরা রাজ পরিবারের পরমাত্মীয় হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ৷ রাজা বীরচন্দ্রই তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথকে ‘‘শ্রেষ্ঠ কবি’’ আখ্যা দিয়েছিলেন৷ পরবর্তীকালে মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর রবীন্দ্রনাথকে কবি ভাস্কর’’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক আগরতলার উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ, মালঞ্চ নিবাস, বীর মহল ইত্যাদির নামকরণ হয়েছিল৷ শুধু তাই নয়৷ ত্রিপুরার রাজারা বাঙালী প্রজাদের কাছ  থেকে যেমন খাজনা  নিয়েছেন, তেমনি তারও  বাঙালী বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখদের আর্থিক সহায়তা   দিয়েছেন৷ বিশ্বকবির শান্তিনিকেতন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও ত্রিপুরার রাজকোষ থেকে বহু অর্থদান করা হয়েছিল বলে ইতিহাস বলছে৷ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ত্রিপুরার রাজারা অজ্ঞ বা নিশ্চেষ্ট ছিলেন না৷

পরিশেষে আরও কয়েক অতি প্রয়োজনীয় ও যুগোপযোগী কথা বলেই এ নিবন্ধটির ইতি টানব৷ কথাগুলো সংক্ষেপে এইরকমঃ বলতে  গেলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই আমাদের দেশ৷ পৃথিবীগ্রহে যত প্রাণীরা রয়েছে, তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী হচ্ছে মানুষ৷ কেন?--- না, সবচেয়ে বেশী বিকশিত ও উন্নত মননশীল বলিষ্ঠ মনের অধিকারী জীব বলেই এই প্রজাতির নাম হয়েছে মানুষ বা মনুষ্য বা মানব৷ মানুষ বিচারশীল জীব---একথাটা পৃথিবীতে কেবল মানুষের জন্যেই খাটে---অন্যকোন জীবের জন্যে তা’ প্রযোজ্য নয়৷ তাহলে, স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ণ জেগে ওঠে---মানুষ প্রজাতিভূক্ত সব মানুষই তো মানুষ,কারণ মানুষকে মানুষ না বলে দানব বা জন্তু-জানোয়ার তথা পশু বা পাখী বা সরীসৃপ অর্থাৎ মানুষের চাইতে হেয় বা অনুন্নত বা নীচ বা নীরস অন্য কোন প্রজাতির প্রাণী তো বলা কিছুতেই সম্ভব নয়---উচিতও নয়৷ কবির ভাষায়---‘‘জগৎ জুড়িয়া এক জাতি ও সেই জাতির নাম মানুষজাতি৷’’ তাই যদি হয়, তাহলে মানুষে মানুষে উঁচু-নীচু, শাদা-কালো-বাদামী, জাতি -উপজাতি বা জনজাতি, ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বৈশ্য-শূদ্র, শাক্ত-বৈষ্ণব-শৈব-গানপত্য, হিন্দু মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান এসব বিভেদ মানা হচ্ছে কেন? সবাই যদি একই পরমেশ্বরের সৃষ্টি, তাহলে মানুষে মানুষে এই বিভেদ বা বিভাজন করলেন কে?---ঈশ্বর, গড, আল্লাহ---কে এর দায় নেবেন? তাহলে, গড্‌ বা যীশু, আল্লা, খোদা,কৃষ্ণ, নারায়ণ, গণেশ রাম, কালী,দুর্গা--- এসব নাম তো ঈশ্বরেরই নাম৷  পরমসৃষ্টিকর্তা এক যদিও তাঁর নাম অনেক৷ আর অনেক নাম ঈশ্বরের তৈরী নয়---তৈরী মানুষের৷ সুতরাং মানুসে মানুষে বিভাজন ঘটাচ্ছে সুবিধাবাদী কিছু সংখ্যক কুচক্রী মানুষেরা৷ তাই এ যুগের মানুষকে এসব বিভ্রান্তি সরাতে এগিয়ে আসতেই হবে৷ আর এটাই হবে আমাদের ত্রিপুরারও সার্বিক কল্যাণের  চাবিকাঠি৷