আদর্শ সমাজ ঘটনের একমাত্র পথ-আনন্দমার্গ

লেখক
প্রভাত খাঁ

বর্ত্তমান বিশ্বের প্রতিটি মানুষ, জীব জন্তু গাছপালা আজ অত্যন্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ও পরিবেশ এমন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে যা কহতব্য নয়৷ এই ধ্বংসোন্মুখ পৃথিবী গ্রহের অধিকাংশ রাষ্ট্র পরস্পর বিদ্বেষ ঘৃণায় মারমুখী হয়ে মারাত্মক ধ্বংসকেই আহ্বান জানাচ্ছে৷ তারই কারণে এই গ্রহের উদ্ভিদ প্রাণী কুলের কল্যাণার্থে যতোটুকু করা দরকার তা না করে দৈত্যকুলের ন্যায় পৃথিবী ধ্বংসে অস্ত্র প্রতিযোগিতা মুক্তকচ্ছ হয়ে ছুটছে৷

মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজীব৷ তারই উপর পরম পিতা দায়িত্ব দিয়েছেন সকলকে রক্ষার৷ তা না করে ধ্বংসে মেতেছে৷ তাই সভ্যতা আজ দিশাহীন অসভ্যতা রূপে সৃষ্টিকে বার বার পরিহাস করেই চলেছে৷

এই চরম সংকটে সেই সব মানুষ যাঁরা সেই মহান স্রষ্টার কল্যাণময় রূপটিকে হূদয়ের মণিকোঠায় ধ্যান করেন ও তাঁকে উপলব্ধি করেন তাঁদের আশু কর্ত্তব্য হ’ল তাঁর মহিমা ও মহান উদ্দেশ্যকে ব্যাপকভাবে সারা বিশ্বে প্রকাশ করা ও জগৎ কল্যাণে কাজ করে যাওয়া৷ যিনি বিশ্বপিতা তাঁর কাছে জাতপাতের ভেদাভেদ নেই৷ সকলেই তাঁর প্রিয় সন্তান৷ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মাৎসর্য এই ষড়রিপু আর লজ্জা, ঘৃণা, শঙ্কা, ভয়, জুগপ্সা, কুল, শীল, মান এই অষ্ট পাশে আবদ্ধ হয়ে সব কিছু ভুলে গিয়ে সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্য ভুলে ধ্বংসের কাজে মেতেছেন৷ তাদের সম্বিত ফেরাতে ও জগতের সৃষ্টিকে রক্ষা করতে সৎ ব্যষ্টিদের এগিয়ে অবশ্যই আসতে হবে৷ মানবিক  মূল্যবোধ আজ পথের ধূলায় পড়ে কাঁদছে৷ তাই জগৎকল্যাণে নব্য মানবতাবাদীদের ও বিশ্বৈকতাবোধে উদ্বুদ্ধদের বসে বসে শুধু কাল ক্ষয় করার সময় আর নেই-এই আহ্বান জানিয়েছেন মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার ওরফে  শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী৷

আজ জগৎকে যারা ধ্বংস করার, শোষণ করার হীন কাজে ব্যস্ত তাদের গতিরোধ করতে বিশ্বব্যাপী এক কল্যাণকামী চেতনাকে জাগ্রত করা ও পাপ শক্তিকে প্রতিহত করাটাই হ’ল আধ্যাত্মিক সাধকদের কাজ৷ এই কাজই হ’ল কর্মসাধনা৷ যে কর্মসাধনা মানুষকে বৃহৎ এষণার সার্থকতায় পৌঁছে দেবে ও ইতিহাসে সার্থক সংগ্রামী পুরুষ হিসাবে স্বীকৃতি দান করবে৷

সকলেরই আজ কুসংস্কার ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমে নব্যমানবতাবাদের আধারে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মানবিক মূল্যবোধ জাগাতে হবে৷ কেউই ছোট নয়, ঘৃণার নয়, সকলেই সকলের প্রিয়৷ আর গাছপালা, জীবজন্তু সবই হ’ল সেই পরম পিতার প্রিয় সৃষ্টি৷ সবাইকে এক করার ও সকলের বিকশিত হওয়ার পথকে প্রশস্ত করে তোলাটাই হ’ল আসল কাজ৷ আর সেই শুভকর্মকেই বলে সৎকর্ম৷

সকল বাধা বিপত্তিকে উপল খণ্ডের মতো পায়ে দলে যাঁরা সেই কর্ম করে চলেন তাঁরাই প্রকৃত মানুষ৷ তাই হুঁসকে মান্যতা দিয়ে চলতে হয়৷ পৃথিবী যে সেবা আমাদের দিয়ে চলেছেন ও গাছপালা জীবজন্তুর কাছ হতে যে সেবা আমরা পাই তার প্রতিদানে আমাদের সকলেরই কিছু দেওয়ার আছে৷ সেই দেওয়াটাই হ’ল সৎকর্ম৷

সৎকর্ম শুধু নিজে করা নয়৷ সেই কাজ ব্যষ্টি জীবনের ক্ষেত্রে যেমন আবশ্যিক ঠিক তেমনই অন্যকে সেই কাজে ব্রতী করার চেষ্টা করতে হবে৷ তাছাড়া সব কর্মেই সেই পরমপুরুষকে স্মরণ করে করতে হবে তাতে কর্মের অহংকার বর্ত্তাবে না৷ নিজের জীবনকে উন্নত করতে তাঁকে যেমন স্মরণ করতে হবে সাধনার মধ্য দিয়ে অন্যকেও সেই পথে আনার চেষ্টা করতে হবে৷ একাজটি আরম্ভ করতে হবে পরিবারের লোকদের সঙ্গে নিয়ে৷ তবে তার প্রভাবটা ধীরে ধীরে সমাজের ওপর পড়বে৷ পৃথিবীর সর্বত্রই দুর্নীতি, ভোগবাদী আত্মকেন্দ্রীক মানসিকতার প্রচণ্ড প্রভাব পড়েছে৷ মনে রাখতে হবে এই বিশ্ব সংসারের কেউই ঘৃণ্য বা নীচ নয়৷ সকলেরই মর্য্যাদা আছে৷ তাছাড়া সকলেরই বিকাশের পথ প্রশস্ত করে দেবার দায়িত্ব সমাজেরই৷

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ধনতান্ত্রিক ও জড়বাদী সমাজ ব্যবস্থায় মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে৷ তাই তো শোষণের উপর ও বঞ্চনার উপর দাঁড়িয়ে মানব সমাজে অতি মুষ্টিমেয় লোকের সমৃদ্ধি৷ ‘বাঁচ ও অপরকে বাঁচতে দাও’ এই যে মানবিক শ্লোগান এটা আজ মানুষ ভুলে যাচ্ছে৷ লোভ ও লালসার জন্যে এই সুদূর পৃথিবী হতে বহু গাছপালা, জীবজন্তু চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে৷ ফলে আজকের নগর সভ্যতা পৃথিবীতে এক ভয়ংকর পরিণতির সৃষ্টি করে চলেছে৷

এই অবক্ষয়ের হাত থেকে জগতের সকল জীবকে, গাছপালাকে রক্ষার জন্যে শ্রদ্ধেয় মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বিশ্বব্যাপী পিক্যাপ আন্দোলনের সূত্রপাত করে গেছেন৷ ‘‘প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি এগেনস্ট এ্যানিম্যালস্ এ্যান্ড প্লান্টস্’’ অর্থাৎ প্রাণী ও গাছপালার বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতার প্রতিরোধ আন্দোলন৷ তাছাড়া ষড়ঋপু ও অষ্টপাশ থেকে ব্যষ্টি জীবনকে রক্ষা করার জন্যে আধ্যাত্মিক সাধনা প্রত্যেকের জীবনে আবশ্যিক কাজ৷ তা না হলে বিশ্ব সমস্যা মেটার কোন সম্ভাবনা নেই৷ মানুষ বিচারশীল উন্নত জীব বিশেষ৷ মানুষের জীবন নিছক প্রকৃতি মুখী নয়৷ মানুষ তাঁর (ঈশ্বরের) প্রতিনিধি হিসাবে সৃষ্টিকে রক্ষা করে চলতে হবে৷ এই অতি সোজা সরল কথাটাই ভোগ সর্বস্ব পৃথিবীর মানুষ ভুলে গেছে৷ এই অবক্ষয়ের হাত থেকে জগৎকে রক্ষার জন্যেই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আগমন৷ তিনিই মহাসম্ভূতি৷ তিনি বিশাল কর্মকাণ্ডের অবতারণা করে গেছেন৷ সেই মহান ব্রত পালন করে চলেছেন  সমবেত ভাবে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী ও গৃহী মার্গী ভাই-বোনেরা৷ এই কাজে স্বার্থান্বেষীরা নানা ভাবে বাধা দান করে চলেছে৷ এই বাধাকে ত্যাগ নিষ্ঠা ও সাহসের সঙ্গে হঠিয়ে সেই আধ্যাত্মিক সৈনিকদের এগিয়ে চলতে হবেই হবে৷ ''Peace is the result of fight, peace lovers of the Universe must not keep themselves away of fight." এই কথাটাই শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলে গেছেন৷

পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে যাঁরা শাসনে আছেন তাঁদের লোভ হিংসাই সর্বনাশ করে ছাড়ছে বেশী৷ তবুও পাপ শক্তিকে প্রতিহত করতে আপ্রাণ চেষ্টার দরকার৷ তাই আদর্শবান মানুষদের নৈতিকতা ও সততাকে মূলধন করে এমন ভাবে কাজ করতে হবে যাতে প্রত্যেকটি মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজনটুকু যেন সকলে পায়৷ তাছাড়া সকলের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে বিকেন্দ্রিত পথে সকলে কিছু না কিছু রুজি রোজগারের পথ পায় ও সকলেরই ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে তার জন্যে ব্লক বা অঞ্চলভিত্তিক স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়তে হবে৷ সমবায় আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে হতে সারা দেশে কৃষি ও শিল্পে৷ কারণ বেকার সমস্যায় মানুষের সমাজ ধুঁকছে৷ জীবনের সর্বক্ষেত্রেই উৎপাদন ও বন্টনে যতোদূর সম্ভব ততদূর সমবায় ব্যবস্থাতে কাজে লাগিয়ে সরকারী ও বেসরকারী ‘মনোপলি’ ব্যবসাকে রুখতে হবে৷ এই ‘মনোপলি’ ব্যবসা হ’ল শোষণের ভয়ংকর হাতিয়ার৷ তাছাড়া বিশ্বে বিভিন্ন ভাষাভাষী যে আড়াই শ’র বেশী সমাজ আছে তাদের প্রত্যেকটিকে আন্দোলনমুখী করে গড়ে তুলতে হবে যাতে করে মাটির সন্তানরা সবদিক দিয়ে খেয়ে পরে বাঁচতে পারে৷ বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের উন্নয়নে বাইরের দক্ষ শ্রমিক, কলাকুশলীদের আহ্বান করা যেতে পারে৷ শারীরিক পরিশ্রমের কাজগুলি ও অন্যান্য কাজ যেন অঞ্চলের মানুষরা পায়৷ সেদিকে নজর দিতে হবে৷ যাঁরা জগৎ কল্যাণে কাজ করবেন তাঁরা সর্বদাই সৎনীতিবাদীদের সরকার গঠনে কাজ করে যাবেন৷

বর্ত্তমান বিশ্বের সকল সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ হ’ল প্রাউট দর্শন৷ বিশ্বের বুকে প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এছাড়া অন্য কোন পথ নেই৷