আমার সন্তান যেন থাকে  দুধে ভাতে

লেখক
একর্ষি

পূর্ব প্রকাশিতের পর,

বিকেন্দ্রিত অর্থব্যবস্থার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি---তৃতীয় নীতি হচ্ছে---উৎপাদন ও বন্টনের কাজ সব সময় সব পরিস্থিতিতে একমাত্র সমবায় দ্বারাই পরিচালিত হওয়া৷ তবে সমবায় পদ্ধতির নাম শুনেই কেউ কেউ হয়ত নাসিকা কুঞ্চন করবেন কেননা পৃথিবীতে একমাত্র ইজরায়েল ছাড়া কোথাও সমবায় প্রথাতে সেভাবে সাফল্য আসেনি৷ অসফলের  কারণগুলোও সহজেই নজরে আসে, এরজন্যে খুব বেশী মাথা ঘামাতে হয় না৷ যেমন--- সবচেয়ে বড় কারণ হল সমবায়ের সঙ্গে জড়িত সদস্যের দৃঢ় নৈতিকমান না থাকা৷ অর্থাৎ নৈতিকতার দৃঢ় ভিত্তি ছাড়া সমবায় দাঁড়ায় না৷ নৈতিক চরিত্রের দৃঢ়তার অভাব সমবায়গুলোয়৷ দ্বিতীয় কারণ জড়বাদভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিবেশ৷ মানেটা হল---স্থূলবস্তুর উপভোগ সর্বস্ব জীবনচর্যা, বল্গাহীন লোভ ও লাভের লালসা ও মানবিকতার দিক থেকে মুখ ফেরানো৷ অর্থাৎ কিনা সকলের সমান অধিকার সমান স্বার্থ, সকলকে  নিয়ে একসঙ্গে চলার এষণাকে জলাঞ্জলি দেয়া৷ তৃতীয় কারণের উৎপত্তি এরই অনিবার্য কুফলেই৷ অর্থাৎ স্থানীয় জনসাধারণ সর্বান্তকরণে সমবায়কে আর্থিক মুক্তির মাধ্যম বা দিশারী হিসেবে মেনে নিতে ভরসা পায়নি৷

চতুর্থতঃ---স্থানীয় বাজারের দখল নেওয়ার  জন্যে সমবায়কে সঙ্ঘটিত  ও শক্তিশালী প্রভাবশালী-ক্ষমতাশালী একচেটিয়া পুুঁজিপতিদের সঙ্গে  প্রতিযোগিতায় নামতে হয়৷ এই পরিস্থিতিতে কাঁচামালের ওপর স্থানীয় মানুষের অধিকার স্বীকৃত হয় না, তাই ক্ষমতাবানদের দাপটে কাঁচামালের যোগানে তৈরী  হয় অনিশ্চয়তা, কৃত্রিম অভাব৷ এই অসম প্রতিযোগিতায় সমবায় দাঁড়াতে পারেনি৷ তাছাড়া ভারতের মত দেশগুলোতে সমবায় অর্থনৈতিক উন্নতির জন্যে তৈরী হয়নি৷ তৈরী হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্যে৷

আসলে অসফল সমবায়ের ক্ষেত্রগুলোকে সমবায় প্রথার যে অন্তর্নিহিত ভাব ---‘সকলে আমরা সকলের তরে, প্রত্যেকে আমরা প্রত্যেকের তরে’ অর্থাৎ বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার ভাব---তা পুরোপুরি উপেক্ষিতই হয়েছে৷ মনে রাখা দরকার ---সমবায় প্রতিষ্ঠান সাধারণতঃ গড়ে  ওঠে সেই জনমণ্ডলীর মিলিত শ্রমে ও বুদ্ধিতে, যে জনমণ্ডলী একই অর্থনৈতিক কাঠামোয়, একই প্রয়োজনের তাগিদ নিয়ে বাস করছে, ও সামবায়িক ভিত্তিতে উৎপন্ন বস্তুর বাজার হাতের কাছে পাছে৷ এই তিনটি শর্তের একত্র সমাবেশ না হলে সমবায়ের বিকাশ হতে পারে না৷ এই ত্রয়ীর একত্র সমাবেশের অভাবেই আজ বেশীর ভাগ দেশেই সমবায় অসফল হয়েছে৷

কিন্তু বিকেন্দ্রিত অর্থব্যবস্থার সাফল্যের প্রধান কারণই হচ্ছে সমবায় প্রথা সফল হওয়া---যা ‘ফেল করা সমবায়’ এ পাওয়া যাচ্ছে না৷ তাই বিকেন্দ্রিত অর্থব্যবস্থায় ইপ্সিত সমবায় ব্যবস্থার সাফল্যের তত্ত্বগত সূত্রগুলো এবার পরখ করা যাক৷  সমবায় প্রথার সাফল্য নির্ভর করে মূলতঃ তিনটি তত্ত্বের ওপর ৷ যথা-১) নীতিবাদ৷ নীতিবাদ সমবায় প্রথার ভিত্তিভূমি৷ তত্ত্বে ও প্রয়োগে নৈতিকতার সুদৃঢ় বন্ধন ছাড়া সমবায় গড়া যায় না, গড়লে টেকে না--- যা ভারত ছাড়াও বেশীর ভাগ দেশেই ঘটেছে (২) কড়া তত্ত্বাবধান (সুপার্‌ভিশ্‌ন)৷ শুধু সমবায় কেন ঘটনমূলক কোন কাজই নজরদারী ছাড়া রূপ পায় না,  সফলও হয় না৷ আবার সেখানে মধুর সুঘ্রান আছে (অর্থের-সম্পদের গন্ধ) সেখানে মেরে খাওয়া-লুটপাট-লোপাটের ফাঁক-ফোকর ও থাকে৷ পরিস্থিতির চাপে বা বৃত্তিগত ত্রুটি বা সুপ্ত লালসায় মানুষের নৈতিক ভিতটা নড়ে বা ধসে যেতে পারে৷ অথচ সদস্যদের ওপর নির্ভরতা ও সহজ বিশ্বাস ছাড়া একপাও এগোনো যায় না৷ কাজেই কড়া নজরদারী সমবায় সাফল্যের আবশ্যকীয় শর্ত৷ (৩) জনগণের হৃদয় দিয়ে সমবায়কে গ্রহণ৷ ‘‘জনগণ মন প্রাণ দিয়ে তাদের সাধারণ অর্থনৈতিক স্বার্থকে সুরক্ষিত ও মজবুত করতে চায়৷’’ তাই তারা সমবায় চায়, এই মনোভাব ছাড়া সমবায় টিকবে না৷ যেমন, ইজরায়েল চারিদিকে শত্রু দিয়ে ঘেরা থাকায় ওখানকার জনগণের মধ্যে এক স্বয়ং-নির্ভরশীলতার চেতনা গড়ে’ উঠেছে৷ কারণটা ওই জনগণ মন প্রাণ দিয়ে তাদের আর্থিক অবস্থাকে শক্তিশালী করতে চায়৷ এই চেতনার কারণেই ইজরায়েলীরা সমবায় প্রথার সাহায্যে স্থানীয় শুষ্ক মরুভূমিকে শস্য-শ্যামলা করে অসম্ভব কে সম্ভব করে তুলতে পেরেছে৷

বলাবাহুল্য, পৃথিবীতে এই তিন তত্ত্বের  মধ্যে যেখানে যতটুকু রয়েছে সেখানে সমবায় ততটুকুই সাফল্য অর্জন করেছে৷ কাজেই প্রতিটি মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভ বা ক্রয়ক্ষমতা অর্জন বা আর্থিক দিক দিয়ে স্বয়ম্ভর হয়ে ওঠা সমবায় প্রথা ছাড়া  গত্যন্তর নেই৷ একমাত্র বিকেন্দ্রিত অর্থনীতিতেই এটা সম্ভব সুতরাং সমবায় অর্থ ব্যবস্থা আর বিকেন্দ্রিত অর্থনীতি একে অন্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ৷