আন্দামান, বাঙালী ও কমিউনিষ্ট পার্টি

লেখক
অসিত দত্ত

‘হেথায় আর্য হেথা অনার্য হেথায় দ্রাবিড়হীন

শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন৷’

ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের পূর্বে সম্প্রদায়গত যে মিলন তার কথা বলে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাজাতির জয়গান করেছেন৷ কিন্তু তিনি এখানেই থেমে থাকেননি তিনি আরো এগিয়ে বললেন,

‘এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ এসো এসো খৃষ্টান৷’

প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন এ ধরণের কবিতায় রচনা করেন তখন ভারতবর্ষে ইংরেজ দোদণ্ড প্রতাপে রাজত্ব করছে৷ কিন্তু ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজ জাঁকিয়ে শাসন শোষণ শুরু করে তখন তিল তিল করে গড়ে ওঠা সম্প্রদায়গত সুস্থ স্থিতাবস্থায় এক আলোড়ন সৃষ্টি করে৷ কিন্তু ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বা সিপাহী বিদ্রোহের সময় এই আলোড়ন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি৷ তবে বৃটিশ মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করেছিল ভারতবর্ষে সম্প্রদায়গত বিভেদ সৃষ্টি করতে না পারলে তাদের শাসন শোষণ অব্যাহত গতিতে চলবে না৷ সুতরাং তারা বিভেদের বীজ সক্রিয়ভাবে বপন করতে শুরু করে৷ ভারতবাসী এই ফাঁদে পা দেয়৷ এরই পরিণতিতে হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায় পরস্পর পরস্পরকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে৷ তা সত্ত্বেও কবিগুরু থেকে তখনকার অন্যান্য মনীসিরা সম্প্রদায়গত বিভেদ নয় ঐক্যের জয়গান করেন৷ কিন্তু  ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবী করা হয়৷ এই পৃথক রাষ্ট্র আদায় করার জন্য বিচ্ছিন্নভাবে দাঙ্গা শুরু করে৷ যে ভারতবর্ষে দীর্ঘদিনের  তিল তিল করে গড়ে ওঠা হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই---এই বোধ তৈরী হয়েছিল সেখানে ভাই ভাইপোয়ের বুকে ছুরি চালায়৷ যার ফলশ্রুতি ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজন৷ পশ্চিম পাকিস্তান,পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান ও খণ্ডিত ভারতবর্ষ৷ এই বিভাজনেই কিন্তু শান্তি স্থাপন হল না৷ লুটপাট, অগ্ণি সংযোগ, হত্যালীলা, নারীধর্ষন, জবরদস্তি ধর্মান্তকরণ অবাধে চলতে লাগলো৷ দুকোটি মানুষ ভিটেছাড়া হয়েছিল৷ দশলক্ষ মানুষের প্রাণ চলে গিয়েছিল৷ অনেকে বিকলাঙ্গ হয়ে বাকী জীবন কাটিয়েছেন৷ ধর্ষন ও অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছিল একলক্ষ নারীকে৷  জোর করে কতজনকে ধর্মান্তরিত করা হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না৷

পঞ্জাব ও বঙ্গের মানুষেরা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হল৷ ভারত সরকারের সক্রিয় সহযোগিতায় পাঞ্জাবীদের সমস্যা অনেক সমাধান হলেও বাঙালীরা কিন্তু সে ধরণের সহযোগিতা পায় নি৷ দলে দলে বাঙালী উদ্বাস্তু ভিটেমাটি স্বজন হারিয়ে এপার বাংলায় চলে আসে৷ ক্ষুদ্র পশ্চিমবঙ্গের সরকারের নাভিশ্বাস৷ এই বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুদের সমস্যা কীভাবে সমাধান করা যায়৷ এইটুকু পশ্চিমবঙ্গ আর তার উপর এই বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুর চাপ৷ তাদের অন্ন,বস্ত্র, বাসস্থান,শিক্ষা,চিকিৎসা, সর্র্বেপরি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, এই দূরূহ কর্তব্য কর্ম তাদের  সামনে৷ অবশ্যই তারা আন্তরিকতার সঙ্গে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়৷ তারা অন্যান্য প্রদেশে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেয়৷

এরকম একটা অবস্থায় সরকারের নজর পড়ে বঙ্গোপসাগরের  বুকে ফুলের মালার মতো দ্বীপপুঞ্জের দিকে৷ আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ৷ ব্রিটিশ আমলে আন্দামানের সেলুলার জেল ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দীপান্তর শাস্তির  জন্য কুখ্যাত জেল৷  স্বাধীনতার পর অবশ্য এটা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়৷ সেই আন্দমানে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য নির্ধারিত করা হল৷ প্রথমদিকে উদ্বাস্তু পরিবার পিছু ২০ বিঘা চাষ জমি দেওয়া হয়েছিল৷ উদ্বাস্তুরা যাতে কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে৷ পরবর্তীকালে  ১০ বিঘা করে কৃষিজমি দেয়৷ এমনি করে নীল, নিকোবর পোর্টব্লেয়ারের সংশ্লিষ্ট এলাকায় বাঙালী উদ্বাস্তুদের  পুনর্বাসন দেওয়া হোল৷ সেখানে ভিটেমাটি ছাড়া বাঙালীরা এসে নতুন করে বাঁচার রসদ খুঁজে পায়৷ কিন্তু আরো অনেক উদ্বাস্তুকে সেখানে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হোতো৷ আরো অনেক উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান হতে পারতো৷ কিন্তু তা হলো না৷ এখানেই ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির একটা ভূমিকা ছিল৷ তারা আন্দোলন শুরু করলো এই বলে যে বাঙালী এভাবে সাগর পারে পাঠানো চলবে না৷ আন্দোলন এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে সরকার থেকে আন্দামানে যে উদ্বাস্তু পাঠানো চলছিল তা বন্ধ করে আর উদ্বাস্তুদের সেখানে পাঠানো হোল না৷ কিন্তু সেই আন্দমানে মূলতঃ তামিল ভাষাভাষি বহু মানুষ পৌঁছে গিয়েছিল নতুন জীবিকার সন্ধানে৷ তারা কিন্তু মূলতঃ উদ্বাস্তু ছিল না৷ এইভাবে সামগ্রিক বাঙালী অধ্যুষিত অঞ্চলে তামিলদের সঙ্গে মিলে মিশে এক মিশ্র জনগোষ্ঠীতে পরিণত হল৷ তা  সত্ত্বেও বাঙালী জনগোষ্ঠীর হার শতকরা ৬৬ জন৷ কিন্তু তা হলে কী হবে৷ যেহেতু এটা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তাই সেখানে হিন্দী ও ইংরাজী রমরমা৷ বাংলা ভাষাভাষীদের পঠন পাঠনে বাংলাভাষা উপেক্ষিত৷  এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যদি কমিউনিষ্ট পার্টি বাঙালী উদ্বাস্তুদের আন্দামানে পুনর্বাসন দেবার কাজে সরকারের বিরোধিতা না করতো তবে হয়তো বাঙালীর সেখানে আরো সংখ্যা গুরু হয়ে নিজেদের ভাষা সংস্কৃতি রক্ষায় অনেক সুবিধা পেত৷ ভিটেমাটি ছেড়ে আসা আরো অনেক উদ্বাস্তু সেখানে পুনর্বাসনের  ও জীবিকা অর্জনের  সুযোগ পেত৷ কিন্তু কমিউনিষ্ট পার্টির এই ভূমিকা হয়তো ভবিষ্যতে মানুষ ভুলে যাবে৷ কিন্তু এটাই ছিল সেদিনকার নির্মম সত্য ঘটনা৷