বাঙালী জাতির অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

লেখক
প্রফুল্ল কুমার মাহাত

মহান দার্শনিক সমাজগুরু ও সমাজসংস্কারক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের অমোঘ ও অব্যর্থ বাণী দিয়েই এই প্রবন্ধের উপক্রমনিকা শুরু করছি৷ তিনি বলেছেন---‘‘আমরা পৃথিবীর,পৃথিবী আমাদের দেশ আরও ভালো ভাবে বলতে গেলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই আমাদের দেশ৷ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক কোণে পৃথিবী নামে যে ছোট গ্রহটা আছে সেই পৃথিবীর এককোণে বাঙালী নামে যে জনগোষ্ঠী আছে সেই জনগোষ্ঠীও অতীতের অন্ধকার থেকে এগোতে এগোতে তার অন্ধকারের নেশা শেষ হয়ে গেছে৷ তার জীবনে নোতুন সূর্যদয় এসেছে, এবার তাকে এগিয়ে চলতে হবে৷ চলাটাই তার জীবনধর্ম মরমের ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলবার মতো প্রাণশক্তি তার যথেষ্ট আছে’’৷ মানবমুক্তি মহান উদগাতা শ্রী সরকার বলেছেন---সভ্যতার আদি বিন্দু হচ্ছে এই বাঙলার রাঢ় ভূমি৷ সে আজ ত্রিশ কোটি বছর আগেকার কথা পার্বত্য উসর ভূমি সম্বন্ধে বলবার  মতো নাম নেওয়ার মতন বৃক্ষরাজিও তখন পৃথিবীতে আসেনি৷ এই নাম না জানা গিরি ভূমিকে  পরবর্তীকালে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রাঢ় দেশ’৷ মানুষের উদ্ভব পৃথিবীতে কয়েকটি বিশেষ বিশেষ বিন্দুতেই হয়েছিল৷ কে আগে কে পরে এ নিয়ে বিশেষ আলোচনা না করেও বলতে পারি রাঢ় ভূমিতে তথা (রাঢ় বাঙলায়) মানুষের উদ্ভব অতি প্রাচীন৷ এরচেয়ে প্রাচীনতম মনুষ্য নিবাসের  কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি৷ অসংখ্য নদনদী বিধৌত বাঙলার উর্বর মৃত্তিকা কৃষিজপণ্য ও বনজে সম্পদে ছিল পরিপূর্ণ এছাড়া ভূগর্ভস্থ বহুবিধ খনিজ  সম্পদও এখানে কম ছিল না৷ আবার বাঙলার মানুষেরা বৌদ্ধিক দিক থেকে খুবই উন্নত, কারণ বাঙলার সভ্যতা হচ্ছে তিনটি বদ্বীপিয় সভ্যতার বিমিশ্র রূপ- তথা ---গাঙ্গেয় সভ্যতা, ব্রহ্মপুত্র সভ্যতা ও রাঢ় সভ্যতা৷ জগতে সভ্যতার ইতিহাসে এটাই সর্বত্তম বিমিশ্র সভ্যতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ৷ তাই সভাবতই বাংলার সভ্যতা অত্যন্ত শক্তিশালী সভ্যতা-বৌদ্ধিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যা খুবই প্রাগ্যস্বর, বাঙলার মানুষের বৌদ্ধিক বিকাশের ব্যাপারে প্রকৃতির সাহায্য অযাচিত৷ কারণ পৃথিবীর আর কোথাও গঙ্গা ব্রহ্মপুত্রের মতন অত বড়ো দুটো নদী একত্রে মিলিত হয় নি৷ আসলে বাঙালী এমন একটা জাতিং গোষ্ঠী যা বিশ্বে বিরল৷ এই বাঙালী জনগোষ্ঠী শিক্ষা, সাহিত্য,সংস্কৃতি, কাব্য সংগীত, শিল্প, নৃত্য, অঙ্কন, দর্শন, নৃতত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, জ্যোতিষশাস্ত্র, দেশাত্ববোধ, আধ্যাত্মিকতা প্রভৃতির ক্ষেত্রে মানুষের জীবনে যতগুলি দিক রয়েছে তার সমস্ত দিক দিয়ে বাঙলা ও বাঙালীকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে৷ এই বাঙলা ছিল সর্বদা এগিয়ে৷ তাই মহামতি গোখলে বলেছিলেন---বাঙলা আজ যা চিন্তা করে ভারত তা করে আগামীকাল৷ এখন ইন্টারনেটের যুগে একথা জোর করে বলা যায়, সমগ্র বিশ্ব তা চিন্তা করবে আগামী পরশু অর্র্থৎ ভারতও পরে৷ যে বাঙলা ছিল মানবসভ্যতার আদি বিন্দু ও পথপ্রদর্শক সেই বাঙলা ও বাঙালী ঐতিহ্য আজ অবলুপ্তি ও ধবংসের পথে৷ একদা সুজলা সুফলা বাঙলা আজ সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও রাজনৈতিক নেতাদের অদূরদর্শিতা ও বঞ্চনায়, কায়েমী স্বার্থন্বষীদের চক্রান্তে নির্মমভাবে নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে শ্মশানে পরিণত হয়েছে৷ আজ খণ্ড, বিচ্ছিন্ন দরিদ্র অবক্ষয়ে বাঙলার দিকে তাকিয়ে দেখি একশীর্ণ রিক্ত অবস্থায় উপনীত হয়েছে যা সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসের চিত্ররূপে ফুটে উঠেছে৷ এই নির্মম শোষণ বঞ্চনা প্রতারণা ও শক্তিহীন করা ষড়যন্ত্র প্রাকস্বাধীনতা করার সময় চলছে ও ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়া জাতিবিশেষ দ্বারা চলেছে৷ আজ স্বাধীনতার পরেও এই অবাধ শোষণ বঞ্চনা   ও ষড়যন্ত্র ততোধিকভাবে হয়েছে হিন্দিসাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমাঞ্চলের ধনকুবের তথাকথিত রাষ্ট্রনেতাদের দ্বারা, বর্তমানে এর শোষণ বঞ্চনা হয়ে চলেছে সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক শিক্ষা ভাষা প্রতিটি ক্ষেত্রে৷ সুপ্রাচীনকাল থেকেই বাঙালী জাতি তার শৌর্য বীর্য ঐশ্বর্য,প্রাণীনতা, সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে এসেছে৷ ইতিহাসে তার প্রচুর প্রমাণ রয়েছে৷ ১৭৫৭ খ্রীঃ পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় সুবা বাঙলার নবাব সিরাজদৌল্লার পরাজয়ের পর থেকেই ব্রিটিশ ইষ্টইণ্ডিয়া কোম্পানি বাঙালি জাতি শক্তি সামর্থ্যকে দুর্বল করার জন্যে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র করতে থাকে৷ বাঙালী যুবকদের কেরানী করার প্রলোভন দেখিয়ে ফোর্টউইলিয়ম  কলেজ প্রতিষ্ঠা করে ও উচ্চপদে নিয়োগের জন্য ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার ব্যবস্থা করে৷ কিন্তু নেতাজীর সুভাষচন্দ্র বসুর মতন বহু দেশপ্রেমিক যুবক আই.সি.এস পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়েও ব্রিটিশের দাসত্ব করতে অস্বীকার করেন ও স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করেন৷ ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দে বাঙলার বুকে ব্যারাকপুরের সামরিক ছাউনিতে মঙ্গল পাণ্ডে ও ঈশ্বর পাণ্ডে নামক দুই যুবক এন.ফিল্ড রাইফেলের গোরু ও শূকরের চর্বিযুক্ত টোটা ব্যবহার করতে অস্বীকার করে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন শুরু করে৷ সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সব সেনা শিবিরে যথা মিরাট ও কানপুরে এই বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে৷ ব্রিটিশ বাহিনী কোনক্রমে বিদ্রোহ দমন করেন এইভাবে বাঙলার বিদ্রোহী যুবকেরা কোম্পানির সরকারকে অতিষ্ট করার প্রেক্ষাপটে ইংল্যাণ্ডের পার্র্লমেন্ট সরকার কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করে নেয়৷ সেই সঙ্গে বাঙলা তথা ভারতের আন্দোলনের ভয় ভেদমূলক শাসন নীতি গ্রহণ করে৷ এইরকম ডিভাইড এ্যাণ্ড রুল নীতি প্রয়োগ করে সুবা বাঙলাকে টুকরো টুকরো করে, বিচ্ছিন্ন করে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করার ব্যবস্থা করে৷ ১৮৭১সালে বাঙলার জমি জরিপ করে সীমানা নির্দ্ধরণ করা হয় এবং ১৮৭৪ সালে শাসনকার্যের সুবিধার অজুহাতে অসমকে বাঙলা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় ও বাঙালী অধ্যুষিত গোয়ালপাড়াকে অসমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়৷ এইভাবে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন সরাসরি মধুমতি পদ্মা বরাবর ভাগ করলেন৷ কিন্তু বাঙলার বিপ্লবী যুবকদের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আইন বাতিল করতে বাধ্য হয়৷ এবং বাঙলার বিপ্লবের ভয় ভীত হয় ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে বিভিন্ন অজুহাতে ব্রিটিশ ভারতে-রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত করে৷ সেইসঙ্গে বাঙলার সীমানা পুনর্বিন্যাস করে বাঙলার দেহ থেকে সিংভূম,ধানবাদ,বালেশ্বর,কেওনঝড় প্রভৃতি পশ্চিমী খনিজ সম্পদ পূর্ণ বাংলাভাষাভাষী অঞ্চলগুলি বিহার ও ওড়িষ্যার সঙ্গে যুক্ত করা হয়৷ অন্যদিকে বনজ ও খনিজ সম্পদপূর্ণ অঞ্চল অসমকে পুনরায় বাংলার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়৷ বিদেশী ব্রিটিশ  বনিকের জাতি ইংরেজরা মুনাফালাভের আশায় ষড়যন্ত্র করে শোষণের জন্য দুরভিসন্ধিমূলক দুর্নীতির আশ্রয়ে নিতে পারে৷ কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তীকালে দেশীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী হিন্দিসাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রনায়কেরা বাঙালী জাতির ওপর যে দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছে তা অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় সেকথা ভাবতেই অবাক লাগে, মনে কষ্ট হয়, শরীরের  শিরা, উপশিরা ধমনিতে রক্তের চাপ বৃদ্ধি পায়৷ কিন্তু স্বাধীন ভারতে বাঙালী জাতি ও বাঙলার প্রতি যে শোষণ, বঞ্চনা ও বিদ্বেষমূলক আচরণ হয়ে চলেছে হিন্দিসাম্রাজ্যবাদী নেতাদের ষড়যন্ত্রে৷ যে বাঙলার সুসন্তানেরা ভারতের মুখ উজ্বল করেছে বিশ্বের দরবারে, তাদের প্রতি এহেন, বিমাতৃসুলভ আচরণ লজ্জাজনক, নক্কারজনক কাজ সে বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই৷ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ  গীতাঞ্জলির অঞ্জলি দিয়ে যে বিশ্ববাসীর হৃদয়ে জয় করেছেন বা স্বামী বিবেকানন্দের উদাত্ত বত্তৃণতায় বিশ্ববাসীর হৃদয় ভারতের গৌরবকে গ্রথিত করে দিয়েছেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, বিজ্ঞানের জগতে নোতুন দ্বার উদ্‌ঘাটন করে বিশ্ববাসীকে চমককৃত করে দিয়েছেন৷ তেজস্বিতার ব্রর্জ্যকৌস্তভ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বিশ্বের শক্তিধর জাতি ইংরেজদের কলিজা প্রকম্পিত করে  ভারতকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য করেছেন৷ এরা সবাই বাঙালী বাঙলা মায়ের কন্ঠহার, এরাই ভারতের তথা বিশ্বের রূপকার৷ এরকম আরও অনেক বাঙালী সুসন্তান বাঙলা তথা ভারতের মুখউজ্জ্বল করেছেন বিশ্বের মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে৷ তবুও কেন, কেন বাঙালীদের প্রতি এ হেন বিদ্বেষ মূলক আচরণ? বাঙালী জাতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর প্রয়োজন প্রতিটি ভারতবাসীর কিন্তু তার পরিবর্তে বিপরীত ছবি ফুটে উঠেছে, আজ বাঙলার ও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে৷ এ দৃশ্য সত্যিই অত্যন্ত মর্মন্তুদ৷ তবুও তা হয়ে চলেছে, যদিও আদৌও কাম্য ও বাঞ্ছনীয় নয়৷ এটা এখন আমাদের বাঙালীদের সুগভীর সমীক্ষার ব্যাপার৷ সমীক্ষাতে এটাই বোঝা যাবে যে, হিংসা পরশ্রীকারতা ও আত্মম্ভরিতা অহংকার ও কায়েমী স্বার্থসিদ্ধির প্রয়াসের জন্য৷ বাঙলা ও বাঙালীর প্রতি এত বিদ্বেষ বিরম্ভনা বঞ্চনা শোষণ বাঙালীর ক্ষাত্র তেজকে অবদমনের প্রয়াস৷ ব্রিটিশের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে তাই ডিভাইডেড এ্যাণ্ড রুল পলিশি অর্থাৎ ভেদমূলক বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতির প্রয়োগ করে বাঙলার ভূখণ্ড ছিন্নভিন্ন করার ও বাঙালী জাতির ঐক্য, ঐতিহ্য ও তেজস্বিতাকে দুর্বল ও নিষ্প্রভ করার চেষ্টা করে চলেছে৷ কিন্তু এটা মোটেই ঠিক নয়, আর এটা টিকবেও না বেশিদিন কারণ সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকানো যায় না৷ কুয়াশা বা মেঘের আড়ালে সূর্যকে বেশিক্ষণ আড়াল করা যায় না, যাবে না৷ তেমনি বাঙালী জাতির মহিমা মর্যাদা ও ঔজ্বল্যকে দাবিয়ে রাখা যাবে না---বেশিদিন৷ যথাসময়ে বাঙলা ও বাঙালী জাতির অচিরেই স্বমহিমায় প্রতিশ্রুত হবেই হবে৷ এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই৷  এটা অবধারিত, অনিবার্য ও অনস্বীকার্য৷ এ ব্যাপারে মহান দার্শনিক মহান সমাজ সংস্কারক ও সমাজগুরু শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন---‘‘বাঙালী নামধেয় জনগোষ্ঠী, অতীতে জীবিত ছিল আজও জীবিত আছে, আমি আশা করবো, ভবিষ্যতে সে আরও দুর্দান্তভাবে জীবিত থাকবে’’৷ যুগত্রাতা শ্রী সরকারের এই অমোঘ বাণী  কোন অন্যথা হবে না৷ (ক্রমশঃ)