বাঙালীস্তান কেন প্রয়োজন?

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

‘বাঙালীস্তান’ নাম-বাচক শব্দটির মধ্যেই জুড়ে রয়েছে ‘বাঙালী’ নামের জনগোষ্ঠী-বোধার্থক, জাতিবাচক তথা সভ্যতাজ্ঞাপক বা সংস্কৃতি-দ্যোতক শব্দটি৷ আর, তা-ই, বোধ হয়, সংকীর্ণচেতা ও সংকীর্ণমনা ব্যষ্টিবর্গের মনে স্বভাবতঃই উসখুস লাগার মত অবস্থার উদ্ভব ঘটতেও দেখা যেতে পারে যে, সাম্প্রদায়িকতার  উসকানি দেওয়া হচ্ছে অথবা ইন্ধন  যোগানো হচ্ছে৷ আবার যারা বর্তমানে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের পর থেকে এই খণ্ডিত ভারতবর্ষকে গণপ্রজাতন্ত্রী, ধর্ম-নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ‘এক দেশ, এক জাতি, এক প্রাণ’ রূপে দেখতে চাইছেন  বলে ফলাও করে প্রচার-মাধ্যমে মনের আঙিনা খোলসা করে জনমানসে--- মহান ভারত, উদার নৈতিক ভারত,  বন্যা বহায়ে দিয়ে জনমানসে আলোড়ন সৃষ্টি করে বাজিমাৎ করতে চাইছেন, তারা হয়তো প্রমাদ গুণে গোঁসাও দেখাতে পারেন৷ তা যা-ই হোক, সময়ই যথাসময়ে সঠিক  জবাব দিতে পারবে আর সবার উপরেই রয়েছেন সর্বনিয়ন্তা স্বয়ং মহাকাল৷ আমার এই উল্লেখিত শিরোনামাংকিত নিবন্ধটির যুগোপযোগী অতি আবশ্যিক কিছু মন্তব্য উপস্থাপন করতে চেয়েছি৷

আমরা এই পৃথিবীর জীব৷ পৃথিবী গ্রহটিই আমাদের প্রিয় বাসভূমি৷ আবার এই পৃথিবীরটাও আধৃত রয়েছে মহাবিশ্বেরই কোন এক বিন্দুতে৷ সুতরাং, অনন্ত এ মহাবিশ্বের এক কোণে, পৃথিবী গ্রহটিরও একটি নির্দিষ্ট প্রান্তে, নির্দিষ্টস্থানে অবস্থান করছি--- আমি, আপনি, তিনি, সে--- এককথায় পৃথিবীর সকল মানুষরাই প্রত্যেকে যার যার অবস্থানে৷ তাহলে প্রশ্ণটি খুব সাধরণ যুক্তিতেই চলে আসছে যে--- এই যে আমার বসতবাড়ীর  চৌহদ্দিসহ বাড়ীটা, তারপর আমার গ্রাম বা শহর, মহকুমা, জেলা, রাজ্য কিংবা রাষ্ট্র ভারতবর্ষ, মহাদেশ এশিয়া, মহাদেশ ও মহাসাগরগুলো নিয়ে গোটা পৃথিবী আবার লাখ লাখ  কোটি কোটি  অযুত-সংখ্যক গ্রহ-নক্ষত্র-উল্কা-জ্যোতিষ্কসমূহ নিয়েই  মহাবিশ্ব--- এসবের কোনটি মানুষের নিজের সৃষ্ট? মানুষ কি কোন মৌলপদার্থ নিজে নিজে সৃষ্টি করতে সক্ষম, যেমন এক বালুকণার মৌল উপাদান কিংবা এককণা জলবিন্দুর মৌল উপাদান? উত্তরটি যে নেহাতই নেতিবাচক, তাতো সকলেই  স্বীকারোক্তি দেবেন বলেই আমার বিশ্বাস রয়েছে৷ তাই বলতে  হচ্ছে যে, আমরা মানুষরা পৃথিবীর বুকে যদিও রাজনৈতিক সীমা তথা গণ্ডী এঁকে মহাদেশ, দেশ, রাষ্ট্র, রাজ্য, জেলা, মহকুমা গ্রাম শহর চিহ্ণিত করতে পারছি বটে তবে আমাদের দৌড়টাই তদ্দুর পর্যন্ত৷ তাই না? এরপরও আমাদের অজ্ঞতারূপ দৈন্যকে আড়াল করতে চেয়েই আমরা কিন্তু নাগরিকত্ব বা এন.আর.সি নিয়ে, পাসপোর্ট বা ভিসা নিয়ে ভিত্তিবর্ষ ইণ্ডিজেনাস বা ভুমিপুত্র, আদিবাসী আর অধিবাসী, স্বদেশী আর বিদেশী, স্থায়ী আর বহিরাগত, ঘুষপেটিয়া অর্থাৎ অনুপ্রবেশকারী আর আগুন্তুক,  হানাদার আর দখলদার--- এসব নিয়ে যখন যা’ খুশী ধান্দাবাজি তথা কূটজাল রচনা করতেও শাসকগোষ্ঠী বা সমাজ-মাতববরদের নগ্ণ-ভূমিকা দেখতে পাই৷ আশা রাখি, এসব কথার দৃষ্টান্ত এখানে তুলে না ধরলে পাঠকবর্গের অসুবিধে বোধ হবার কথা নয়, লেখক এখানে কী বলতে চেয়েছে সেটুকু বুঝে নিতে৷ যাক, লেখাটির গৌরচন্দ্রিকা ছেড়ে এখন মূল প্রসঙ্গেই চলে আসছি৷ তবে বাঙালীস্তান নিয়ে কথা বলতে চাইলেই বাঙালী জাতিসত্তা তথা জনগোষ্ঠীটার কথা তো চলে  আসবে তাইতো স্বাভাবিক৷ তাই আরও স্বাভাবিক প্রাচীন বঙ্গদেশ বা গৌড়দেশ নিয়ে বলা৷ তাইতো চলে আসবেই মানবসভ্যতার  আদিবিন্দু রাঢ় ও পৃথিবীর বুকে মানবশিশুর আদি আঁতুরঘর গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ড ও তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ রাঢ়ভূমি সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া, কেননা এসব নিয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যায়  যাবার এখানে অবকাশ খুবই সীমিত৷ তাছাড়াও বাঙালীস্তান গড়ে তোলার পেছনে যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সর্বোপরি মানবিক অপরিহার্য যুক্তিগুলো রয়েছে, সে আলোচনাটিও এই স্বল্প পরিসরে বিঘ্নিত হয়ে পড়বে৷ আগেই বলে নিয়েছি যে, আমরা এই গ্রহের অর্থাৎ পৃথিবীর  প্রাণীজগতের সেরা জীব৷ বলতে গেলে গোটা পৃথিবীই আমাদের স্বদেশ৷ আরো ভালোভাবে  বলতে গেলে, সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই আমাদের দেশ৷ উল্লেখ্য যে, এ মর্মে আমাদের পরিচায়ক টার্ম ‘সিটিজেন’ না হয়ে ‘কসপোপলিটান’ তথা ‘বিশ্বনাগরিক’ হওয়াটাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত ও বাঞ্ছনীয় নয় কি?

এই পৃথিবীর এককোণে বাঙালী নামে যে জনগোষ্ঠী রয়েছে, তার বর্তমান মোট জনসংখ্যা কম করেও ত্রিশকোটি হবে৷ তবে  এদের সম্পর্কে বৈচিত্র্যপূর্ণ কথাটিও হল যে, বাঙালীরা এখন নির্দিষ্ট করে কোনো একটি বা দুটো অঞ্চল জুড়েই যে বসবাসরত তা কিন্তু নয়৷ অদৃষ্টের পরিহাসে আর পৃথিবীজোড়া বৃহৎ মানব পরিবারের গুটিকয়েক অতীব কায়েমী স্বার্থবাদী ও অত্যন্ত সুবিধাবাদী ষড়যন্ত্রীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতেই বাঙালীরা আজ নিজভূমে প্রবাসী কেউ কেউ জন্ম মাটিতেও বিদেশী, অনুপ্রবেশকারী, আবার রাষ্ট্রনৈতিক  হুজ্জুতি বা দুরভিসন্ধির শিকার হয়ে একটা সংখ্যার বাঙালীরা কচুরিপানার মতই ভেসে  বেড়াচ্ছেন দেশে বিদেশে--- তাদেরই কেউ বা ঠিকানাবিহীন, কেউ কেউ জবরদস্তিমূলক ঠিকানাবিহীন, নাগরিকত্বহীন, রাষ্ট্রবিহীন হবারও হুমকির মুখে দণ্ডায়মান৷ সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি মানব-ইতিহাসের যে, বর্তমানের ভারত যুক্তরাষ্ট্রেরই  এক অঙ্গরাজ্য অসমে সত্তরোর্ধ বছরকাল স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে জীবনে বহুবার বোট দিয়ে মন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদ ইত্যাদি বানাবার পরও, কার অভিশাপে জানা নেই, তথাকার রাজ্য-সরকার কর্তৃক ‘ডি-বোটার’ বলে চিহ্ণিত হয়ে ডিটেনশন-ক্যাম্পে অমানবিক নির্যাতন ও অপ্রত্যাশিত শোকের গ্লাণি সইতে না পেরে ইহলীলা সাঙ্গ করেছেন ও তারপর এই ব্যাষ্টি মৃতদেহ তাঁরই সন্তান-সন্ততিসহ পরিবার পরিজনেরা সৎকারের জন্যে গ্রহণ করেন নি তিনি সরকারের দৃষ্টিতে ‘সন্দেহজনক নাগরিক’ ঘোষিত  হয়েছিলেন বলে৷ সম্ভবতঃ বেচারা ভদ্রলোকটি বাঙালী হয়ে এই ভারতবর্ষের মত দেশে জন্মেছিলেন বলেই বোধ হয় তার এই পরিণতি হয়েছিল৷ কেউ কি বলবেন, জগদীশ্বরের বিচারালয়ে সেই বিদেহী আত্মা কোনদিন ন্যায়-বিচার পাবেন কিনা৷ এতো শুধুই একটি ঘটনা৷ হয়তো পাঠক-পাঠিকাদের কারোর আরও অনেক জানা রয়েছে৷                         l এরপর  পরবর্তী সংখ্যায়