বিজেপি সরকার কর্পোরেট অর্থনীতির পৃষ্ঠপোষক

লেখক
দেবব্রত দত্ত

নতুন ভারত গড়ার ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ মনকে বাতেসম্মানীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, ভারত সকলের৷ দেশের একশত পঁচিশ কোটি নাগরিকের দক্ষতায় গড়ে উঠবে এক নতুন ভারত৷ নতুন ভারত বলতে কি বুঝিয়েছেন মোদিজি-তা কিন্তু পরিষ্কার করে বলেননি তিনি৷ তবে এটা ঠিক মোদি বিপুল সংখ্যক সাংসদ নিয়ে কেন্দ্রের ক্ষমতা দখল করার পর একটার পর একটা বিধানসভা যেভাবে দখল করে নিচ্ছেন তিনিও কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের রাজনৈতিক অঙ্গনে সামনের সারিতে এনে বসাচ্ছেন---তাতে যথেষ্ট নতুনত্ব রয়েছে---একথা অস্বীকার করার কোনও পথ নেই৷ হয়তো গোটা দেশেই এক পার্টির বা হিন্দুত্ববাদীদের শাসন কায়েম হতে পারে৷ সে তা হলো রাজনৈতিক পরিবর্তন কিন্তু রাজনৈতিক পরিবর্তন তো সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তন নয়৷ দেশবাসীর জীবনে রাজনীতির চেয়ে সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তন সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন৷ যারা ভাবেন সমাজ জীবনের সমস্যাগুলো রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমেই শেষ করা যায়---আমার ধারণা তারা ভুল নৌকার যাত্রী৷

দেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাবার পর থেকেই নেতারা ভুল নৌকার যাত্রী হয়েছেন ও দেশকে ভুল পথেই নিয়ে চলেছেন৷ যার পরিণতিতে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় জীবনধারা, ইতিহাস ঐতিহ্য তথা প্রাণধর্ম থেকে অনেক অনেক দূরে সরে গেছে৷ এর পরিবর্তে ভারতের জীবনধারা পাশ্চাত্ত্যের ভাবধারা দখল করে নিয়েছে৷ আর পাশ্চাত্ত্যের ভাবধারা ব্যাপকভাবে অনুপ্রবেশ ঘটায় এ দেশের মানুষদের গাত্র-চেহারা ভারতীয় হলেও জীবনধারার বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে৷ দেশের মানুষরা না হতে পেরেছে ভারতীয়---না হতে পেরেছে পাশ্চাত্যের মানুষ৷ এরই মাঝখানে পড়ে ভারতীয় জীবনধারার অর্থাৎ সমাজব্যবস্থায় বিরাট বিপর্যয় ঘটে গেছে৷ সমাজ ভেঙে পড়েছে৷ বিপদগামী বা সামাজিক বিশৃঙ্খলা গ্রাস করে নিয়েছে৷ কারণ ভারতীয় সমাজ বা জীবনধারা অন্তর্মুখী৷ বহির্মুখী নয়৷ অথচ ভারতীয় জীবনধারাকে বহির্মুখী বা ভোগমুখী করে ফেলা হয়েছে৷

প্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষ তার নিজস্ব জীবনধারা বা প্রাণধর্ম অনুশীলন করে আসছে৷ শিক্ষাক্ষেত্রে অপরা জ্ঞানের চেয়ে পরা জ্ঞানই দেওয়া হতো বেশী৷

ভারতবাসীর প্রাণধর্ম হচ্ছে অন্তর্মুখীন সাধনা৷ প্রতিটা কাজকে ভারতীয়রা আধ্যাত্মিকতার অঙ্গ হিসাবেই দেখছে বা গ্রহণ করে নিয়েছে৷ কিন্তু বর্তমান ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা পাশ্চাত্যের অনুকরণে বহির্মুখী বা ভোগমুখী করে নেওয়া হয়েছে৷ অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ শাসকরা যে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন---দেশ স্বাধীন হবার পরও সেই শিক্ষা ব্যবস্থাই থেকে গেছে৷ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ভোগী আত্মকেন্দ্রিক মানুষ তৈরি হয়ে বেরুচ্ছে৷ যা ভারতীয় ভাবধারার বিরুদ্ধ জীবনদর্শন৷ এখন প্রশ্ণ হচ্ছে, যদি সত্যিই নতুন ভারত গড়তে হয়, তবে প্রথমেই ভারতকে ভারতীয় জীবনধারা  তথা ভাবধারা---অর্থাৎ প্রাণধর্মে ফিরিয়ে আনতে হবে৷ হিন্দুত্ববাদের মাধ্যমে কি দেশবাসীকে ভারতীয় জীবনধারা বা ভারতীয় প্রাণধর্মে ফিরিয়ে আনা সম্ভব? সনাতনী ভারত কোন ধর্মমতের গণ্ডীর মধ্যে বন্দী হতে চাইবে? যেখানে ভারতীয় ঋষিদের বক্তব্য শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাপরমপুরুষআমার পিতা, পরমা প্রকৃতি আমার মাতা, এ ত্রিভুবন আমার স্বদেশ’--- মন্ত্রে দীক্ষিত করতে চেয়েছেন এ দেশের ঋষিগণ, সেখানে কোনও ধর্মমতের ভিত্তিতে সমাজ গড়ে উঠতে পারে না৷ গড়ে উঠতে পারে একমাত্র মানবধর্মে

বিজ্ঞান যখন উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে গোটা বিশ্বটা তখন একটা বৃত্তের মধ্যে চলে আসছে---তখন ধর্মকে বিজ্ঞানভিত্তিক চোখে দেখতে হবে৷ যেমন  বিজ্ঞান বস্তুর গুণভিত্তিক নামকরণ করে---অর্থাৎ আগুন তাকেই বলা হয়---যার দহন শক্তি রয়েছে৷ তেমনি মানুষেরও ধর্ম রয়েছে৷ আর সেই ধর্ম হচ্ছে, মানুষ অনন্তকে পেতে চায়৷ আনন্দ পেতে চায়৷ যে যা-ই করুক তার পেছনে আনন্দ পাওয়াই তার কাম্য৷ মানুষের অনন্ত ক্ষুধাই তার সত্তাগত বৈশিষ্ট্য, আর সেটাই হচ্ছে অনন্ত ক্ষুধা আর অনন্ত প্রাপ্তির অদম্য ইচ্ছা৷ তাই মানবধর্ম-এক৷ ধৃ ধাতু মন প্রত্যয় করে ধর্ম-অর্থাৎ মন যা ধারণ করে আছে---তাই ধর্ম৷ কিন্তু সব মানুষের ধর্ম এক বা সব মানুষের সংসৃকতি এক হলেও মানুষের জীবনধারা বা সাংসৃকতিক অভিব্যক্তি দেশিক কালিক বা পাত্রিক অনুযায়ী  পৃথক৷ তাই প্রতিটা দেশ বা জাতিগোষ্ঠীর আচার, আচরণ যা জীবনধারার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে---তাই এরই অভিব্যক্তি, একই জীবনধারা বা ভাষা সংসৃকতি সভ্যতা পৃথকই থাকবে৷ কিন্তু যেহেতু সমাজ বা দেশ মানে মানুষ---তাই প্রতিটা দেশ বা প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে হবে৷ চাপিয়ে দেওয়া নয়৷

ঠিক এভাবেই নতুন ভারত গড়া যাবে---এক নতুন বিশ্ব গড়া যাবে৷ কিন্তু প্রতিটা দেশ বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে আরও একটা দিক রয়েছে সেটা হচ্ছে, অর্থনীতি৷ কারণ প্রতিটা মানুষের মধ্যে তিনটা ক্ষুধা রয়েছে-শারীরিক, মানসিক, আত্মিক৷ অর্থাৎ অস্তিত্ব, বিকাশ, সত্তাগত বৈশিষ্ট্যে তথা আনন্দে পৌঁছানো৷ অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান৷ এগুলোর গ্যারাণ্টি থাকতে হবে৷ মানসিক বিকাশের জন্য, সুস্থ পরিবেশ, সংশ্লেষণাত্মক ভাবনা, শিল্প-সাহিত্য, সংসৃকতি- সভ্যতা ও আত্মিক উন্নতির জন্য বৃহৎ ভাবনা ও সাধনা প্রয়োজন৷

মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সুষ্ঠু বা  সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনীতিও প্রয়োজন৷ ভারতবর্ষ গ্রামভিত্তিক দেশ৷ গ্রামীণ অর্থনীতিই ছিল এদেশের অর্থনীতি৷ আঠারো শত শতাব্দীতে অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ আর্থিক ক্ষেত্রে ব্যষ্টিস্বাতন্ত্র্যবাদ চাইলেন৷ এই আর্থিক স্বাতন্ত্র্যবাদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বড় বড় শিল্প কারখানা৷ স্বাতন্দ্রবাদকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে বড় বড় শিল্প কলকারখানা৷ গ্রামীণ কুটির শিল্প প্রতিযোগিতায় হেরে যায় বড় বড় শিল্পের সাথে৷ কুটির শিল্পের শ্রমজীবীরা বেকার হয়ে পড়ে৷ তাই তারা গ্রাম ফেরত শহরমুখী হয়ে ওঠে, শিল্পে কাজ পাওয়ার উদ্দেশ্যে৷ অ্যাডাম স্মিথের এই তত্ত্বই জন্ম দেয় পুঁজিবাদ বা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি৷ আবার ধনতন্ত্র তথা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শুরু হয় শ্রমিক শোষণ৷ সেই শোষণকে লক্ষ্য করেই মহামতি কার্ল মার্কস সমাজকে উপহার দেন বস্তুবাদী দর্শন মার্কসবাদ৷ কমিউন অর্থনীতি, যাকে কমিউনিজম বলা হয়৷ কমিউনবাদীরাই হচ্ছে কম্যুনিষ্ট৷ মার্কস সাহেব সাম্যবাদের কথা বলে ব্যষ্টিগত সম্পত্তির  ব্যষ্টিগত মালিকানা উৎখাত করে শ্রমিক শ্রেণির (প্রোলেতারিয়ত) শাসন কায়েম করার তত্ত্ব দেন৷ প্রথম লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়াতে কমিউনিষ্টরা অস্ত্রের সাহায্যে ক্ষমতা দখল করে৷ কিন্তু দুই বছরের মধ্যে এই দর্শন বা অর্থনীতির অসারতা বা ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়৷

ব্রিটেনে পুঁজিবাদের পূর্ণ বিকাশ ঘটে৷ ব্র্রিটিশরা প্রায় গোটা বিশ্বেই সাম্রাজ্যবাদ বিস্তার করে নিয়েছিলেন৷ গত বিশ্বযুদ্ধের পর একে একে প্রায় সব দেশেই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তথা রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করে৷

রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে৷ কিন্তু অর্থনীতির কোনও পরিবর্তন ঘটেনি৷ প্রতিটা দেশেই পুঁজিবাদ বা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলতে থাকে৷ ব্রিটেন ও আমেরিকার ডলার সারা বিশ্বেই নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হয়৷ ভারতবর্ষও রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করে সেই ধনতন্ত্রেরই বিকাশ ঘটায়৷ এখন তো জি-আট এর ধনতান্ত্রিক বিশ্বায়ন গোটা বিশ্বটাকেই গ্রাস করে নিয়েছে৷ ভারতও বিশ্বায়নের শৃঙ্খলে নিজেকে বন্দি করে নিয়েছে৷

বর্তমান ভারতীয় জনতা পার্টি সরকার পুরোপুরিভাবেই ধনতান্ত্রিক বিশ্বায়নের পথ ধরে কর্পোরেট অর্থনীতির ধারাতেই চলছে৷ দেশি-বিদেশী পুঁজিবাদ বৃত্তে ঢুকে পড়েছে৷ এই বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় আর্থিক কেন্দ্রীকরণ চলছে ধনী-দরিদ্রের বিরাট অসাম্য গড়ে উঠেছে৷ সমীক্ষায় দেখে গেছে বিশ্বের অর্ধেক মানুষের সম্পদের সমান পরিমাণ সম্পদ আটজনব্যষ্টির হাতে চলে এসেছে৷ আর্থিক অসাম্য অপরাধ জগতে উত্থান ঘটেছে৷ দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা, মানুষ আদিম যুগে ফিরে যাচ্ছে৷ সরকার ব্যস্ত হিন্দুরাষ্ট্র গঠন করার প্রক্রিয়ায়৷ এখন প্রশ্ণ হচ্ছে, সম্মানিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে দেশবাসীকে  নতুন ভারতের স্বপ্ণ দেখাচ্ছেন---সেই নতুন ভারত গড়ে উঠবে কি ধনতান্ত্রিক বিশ্বায়নের মাধ্যমেই? মোদিজি যদি বলেন, হ্যাঁ ধনতান্ত্রিক বিশ্বায়নের মাধ্যমেই গড়ে উঠবে নতুন ভারত৷ তবে আমার স্পষ্ট জবাব---এটা একেবারেই সম্ভব নয়৷

নির্বাচনে জেতা আর নতুন ভারত গড়ে তোলা এক কথা নয়৷ যেখানে কম দরে কিছু চাল, কিন্তু সামাজিক ভাতা, আর কিছু ঘর জনগণের মধ্যে বিতরণ করে যদি মোদিজি ভেবে থাকেন নতুন ভারত গড়ে তুলবেন---তবে তিনি অবাস্তব স্বপ্ণই দেখাচ্ছেন দেশবাসীকে৷

অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণ, আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে আর কিছু দক্ষ শ্রমিক সৃষ্টি করে নতুন ভারত গড়া যায় না৷ অর্থনৈতিক ভাষায় উন্নতি দুধরণের হয়৷ প্রথমটা পুজিবাদী উন্নয়ন৷ অর্থাৎ বড় বড় অট্টালিকা শপিং মল, রাস্তাঘাটৃ চাকচিক্য ভোগ্যপণ্যের বাজার সৃষ্টি---ইত্যাদি ইত্যাদি৷ দ্বিতীয়টা হচ্ছে, মানব সম্পদের উন্নয়ন৷ অর্থাৎ দেশের প্রতিটা মানুষের শারীরিক মানসিক, আর্থিক উন্নতির যা যা প্রয়োজন---সেগুলোর গ্যারাণ্টি প্রদান  করার সমস্ত দিক থেকে মানুষের উন্নতি ঘটলে সমাজের উন্নতি ঘটবে৷ অর্থাৎ মনুষ্যত্ব, মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিক মূল্যবোধ ও মানুষের মধ্যে সংশ্লেষণাত্মক অবস্থায় দেশ গড়ে উঠলেই একমাত্র নতুন ভারত গড়ে উঠতে পারে৷

কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টি প্রথমেই যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে---তাতে সনাতন ভারতকে ধর্মমতের বৃত্তে ঢুকিয়ে দিয়ে সংকীর্ণতার জালে আটকে দিচ্ছে আর দ্বিতীয়তঃ ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে দেশকে ঠেলে দিয়ে দেশবাসীকে ভোগবাদী করে চলেছে৷ তৃতীয়তঃ দুর্নীতি, ভ্রষ্টাচার, গার্হস্থ্য বিবাদ, এমনকি সম্পর্ককে পাশ্চাত্যের ধারায় ভাসিয়ে দিয়ে নতুন ভারত গড়ে তোলার স্বপ্ণ দেখানো, সেটা শুধুমাত্র ভণ্ড মনস্তাত্বিকের মধ্যেই পড়ে৷