ভারতীয় অর্থনীতি ও বেকার সমস্যা

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

প্রাক্‌-স্বাধীনতা আমলে ভারতবর্ষ ছিল বিদেশী শাসিত৷ আর, ব্রিটিশরা সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ভারতবর্ষে এসে ছিল দাঁড়ি-পাল্লা হাতে নিয়ে বণিকের বেশ-ভূষায় সজ্জিত হয়ে৷ দিয়েছিল রাজদন্ড তথা শাসনদণ্ডরূপে৷ ব্রিটিশরা এদেশ যে শাসন করত এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল এদেশে অবাধ শোষণ চালানো৷ তাই তীব্র শোষণ অবাধগতিতে অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যেই ওই শাসকরা নির্মম নির্যাতন চালাত৷ উল্লেখ্য যে, সমাজে পুঁজিবাদী শোষণটা অতীব সূক্ষ্ম তো বটেই, নির্মম ও অতিমাত্রায়৷ অবশ্য, মার্কসবাদ এক্ষেত্রে শোষণের বিশ্লেষণ দেখাতে গিয়ে মানব-মনস্তত্বের দিক থেকে গোড়াতেই ভুল রয়ে গেছল বলে মার্কসবাদী ভাবাদর্শে যারাই বিশ্বাসী ও অণুপ্রাণিত হয়েছেন ও রয়েছেনও, তারাও শোষণের মারাত্মক স্বরূপ ও ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া হয়তো সম্যক উপলব্ধি করতে সক্ষম নাও হতে পারেন৷ তাই, প্রয়োজনবোধেই এখানে উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, পুঁজিবাদী শোষণটা চলে মূলতঃ তিন ধরণের, যথাঃ---১) ঔপনিবেশিক শোষণ (২) সাম্রাজ্যবাদী শোষণ (৩) ফ্যাসিস্ট কায়দায়৷ এখানে এ প্রসঙ্গ  নিয়ে বিশদ আলোচনার অবকাশ নেই বলেই সেদিকে আর এগোবে না৷ তবে,মার্কসবাদ এতটা গভীরে পৌঁছাতে হয়তো ব্যর্থতার কারণেই শুধু অর্থনৈতিক শোষণের কথাটাই বলছেন ও ব্যাখ্যাও করেছেন এভাবে যে প্রাউট তত্ত্ব অনুসারে উৎপাদনের ক্ষেত্রে যদি মালিকপক্ষ উপার্জিত মুনাফার লভ্যাংশ থেকে শ্রমিকদের কোনভাবে  বঞ্চনা দেখায় বা প্রতারিত করে নিজেদের স্বার্থে বেশীর ভাগ মুনাফাটা আত্মসাৎ করে নেয়---সেটাই  হল শোষণ৷ কিন্তু, এছাড়াও পুঁজিবাদীরা শোষণ চালাও আরো নানাভাবে, যেমন--- দৈহিক বা ভৌতিকস্তরে আর্থ-মানসিকস্তরে, মানসিক বা বৌদ্ধিকস্তরে ও আধ্যাত্মিক স্তরে৷ আর, ব্রিটিশ শাসককুল ছিল ওই ধরণেই শোষক৷ বলা বাহুল্য যে, সেই ব্রিটিশ শাসকও শোষক শ্রেণী ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে গেছে বটেতবে সেই তীব্র শোষণের ছলা-কলাসহ মেশিনারী ও অপারেটরগণ সবই পূর্বাবস্থায় রয়ে গেছে বলে এদেশের অর্থনৈতিক  ব্যবস্থাপনা ‘ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা’ অর্থাৎ যেমন ছিল তেমনটিই চলছে, লাভের মধ্যে শাদা চামড়ার সাহেবরা গিয়ে বাদামীচর্মের শোষকরা মত্তকা লুটছে৷

স্বাধীনোত্তরকালে আমাদের সংবিধানমতে আমরা এখন এক গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের মহান দেশের অধিবাসীর৷ তাই, কাগজীয় ঘোষনা মতে---গণতন্ত্র অনুসারে আমাদের বর্তমান শাসনব্যবস্থা হচ্ছে--- ‘জনগণের  দ্বারা, জনগণের জন্যে ও জনগণেরই শাসন৷ অর্থাৎ স্থানের নাম সুবর্ণগ্রাম হলেও আসলে জায়গাটা কিন্তু মাটি দিয়েই গড়া৷ স্বাধীনোত্তর কালের প্রায় সাড়ে সাত দশক কাল ধরে  দেশের চলমান অবস্থা,নিয়ম-কানুন ও জনসাধারণের বাস্তব-পরিস্থিতি সহ জনজীবনের প্রকৃত চেহারা ও ভুক্তভোগীমাত্রেরই আপন-অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, ভারতীয় গণতন্ত্রের, প্রজাতন্ত্রের ও সমাজতন্ত্রেরও আসল স্বরূপটা কীরকম৷ এ বিষয়ে আর বিস্তৃত ব্যাখ্যায় না গিয়েও শুধু এটুকুই বলতে চাইছি যে,---ভারতের সমাজব্যবস্থা পুঁজিবাদী সেই তথাকথিত গণতন্ত্র নামক মোড়কের আড়ালে আর তার প্রশাসনিক ব্যবস্থাটা অবশ্যই পুঁজিবাদের সঞ্চালক বৈশ্যদের পরিচালিত৷ কেন না, খণ্ডিত ভারতবর্ষের শাসনব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে ও পরিচালনা করছে শুধুই পুঁজিপতিরা৷ গণতন্ত্র বলতে আমরা যে-টুকু পেয়েছি তা হল,---স্রেফ প্রাপ্ত বয়স্কের বোটাধিকার৷ বোটের মাধ্যমেই রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা যে সরকার ঘটন করেন, সেই বোট-আদায় প্রক্রিয়া তথা নির্বাচনী অপরিমিত ব্যয়নির্বাহ করে থাকেন দেশের বিত্তবান, সম্পদশালী, শিল্প-মালিক, ভূমাধিকারী ও করপোরেট মালিকরা সেই কারণেই কারা বোটে জয়ী হয়ে সরকার ঘটন করবেন সরকার ঘটিত হয়ে প্রশাসন চালাবেন সেইসবও স্থির করে দেন জনগণের নাগাল থেকে বহুদূরে, সু-উচ্চ শীততাপ-নিয়ন্ত্রিত কক্ষে নিভৃতে বসে৷ আবার প্রশাসনে কিংবা সরকারে কারা কতদিনে টিকে থাকবেন, তাও নির্ভর করে অর্থের যোগানদাতা পুঁজিপতিদেরই মর্জির ওপরে৷ সুতরাং দেশের  কৃষি-আইন, শিল্প-নীতি, শিক্ষা-পরিকাঠামো, বাণিজ্যনীতি, উন্নয়ন- পরিকল্পনা, যোজনা-পরিষদ, বাজেট-নির্ধারণ ইত্যাদি যাবতীয় নীতি বা পরিকল্পনা গৃহীত হয়ে থাকে একই ফর্মূলায়৷ আর, সে কারণেই দেশের  দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি যেমন লাগামহীন চলছে সেই একই কারণেই বেকার  সমস্যার সমাধানও অধরা হয়েই রয়েছে৷ তবে, পুঁজিবাদ ভিত্তিক তত্ত্বসূত্র অথবা প্রেস-মিট সমূহে গালভরা চটকদার রকমারি বুলি শ্লোগান আউড়ে, গণতন্ত্রের সওদা তথা বোট-আদায়ের নিমিত্ত লম্বা-চওড়া ভাষণ দিতে গিয়ে বিশেস বিশেষ ক্ষেত্রে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি শুণিয়ে সেই গণতন্ত্রের জোয়াল টেনে চলা জনগণের মনোরঞ্জনের খাতিরে আমাদের নেতানেত্রীদের অভিনেতা-অভিনেত্রী সাজতে হয় বৈকি৷ যাক, এ কাসুন্দি আর না ঘেঁটে এবারে আসা যাক, এই আত্মঘাতী পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় উদ্ভাবনের লক্ষ্যে সঠিক দিশা খুঁজে বের করার আলোচনায়৷

তবে, বিশেষ প্রয়োজনবশতঃই শোষণের নিরসন তথা তা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে আলোচনাটি সহজতর হয়ে উঠবে বলে মনে করছি, যদি এদেশের বিভিন্ন ধরণের শোষণের গতি-প্রকৃতির দিকটা আমরা পূর্বেই ধরে নিতে পারি৷ তাই এ সম্পর্কেও একটু আলোচনা    রইল ৷ (ক্রমশ)