দুর্নীতিতে দেশ ডুবে যাচ্ছে : মুক্তির উপায় ?

লেখক
সুকুমার সরকার

পশ্চিমবঙ্গ সহ সমগ্র ভারতবর্ষের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি এটাই প্রমাণ করেছে যে, চরম এক মাৎস্যন্যায় অবস্থায় বিরাজ করছি আমরা । শশাঙ্কের মৃত্যুর পর যে মাৎস্যন্যায় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, বর্তমান অবস্থা তার থেকেও খারাপ । সেই যুগের সেই মাৎস্যন্যায় অবস্থা থেকে বাঁচতে মানুষ একজন গোপালকে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন । তারপর প্রায় তিনশো বছর বাঙলা তথা ভারতবর্ষ একটি সমৃদ্ধ সুশাসনে এসেছিল । বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বাঁচার উপায় কী ? 

ভারতবর্ষ স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গে তেমন কোনো শিল্পোন্নতি হয়নি বললেই চলে ।  বিগত চৌত্রিশ বছর বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গকে বন্ধ্যা রাজ্যে পরিণত করে ছেড়েছে । যা কিছু শিল্প কলকারখানা ছিল, তার বেশিরভাগই বন্ধ করে ছেড়েছে । শিক্ষা-সংস্কৃতি সবেতেই একটি ভাবজড়তার পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়ে গেছে । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার তারচেয়েও কয়েককাঠি উপরে । এখন চারিদিকে শুধুই অরাজকতার পরিবেশ । শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, চাকরি সর্বক্ষেত্রেই সে যুগের মাৎস্যন্যায় অবস্থাকেও ছাড়িয়ে গেছে । সেসবের ফিরিস্তি দিয়ে নিবন্ধের কলেবর বাড়িয়ে লাভ নেই । কমবেশি সকলেরই জানা ।

পুঁজিবাদী প্রচারযন্ত্রগুলি সারাদিন এসবের পক্ষে-বিপক্ষে তর্কযুদ্ধের বুলবুলি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে । উদ্দেশ্য মানুষকে বিভ্রান্ত করা এবং  ভুলিয়ে রাখা । বিচার বিভাগ কখনো কখনো গোপাল খোঁজার মতন দু'একটি সমাধানের ইঙ্গিত দিচ্ছেন বটে । কিন্তু প্রকৃত মুক্তির পথ অধরা । কেননা, বর্তমানের সমাজ-রাষ্ট্র শশাঙ্কের পরের মাৎস্যন্যায়ের থেকে ভিন্ন । বর্তমান সমাজ-রাষ্ট্রে পুঁজিবাদী হস্তক্ষেপ যান্ত্রিক উন্নয়নের নিরিখে বিচার্য । তাও আবার তা মানস-অর্থনৈতিক শাসন-শোষণের আওতাধীন । আর এতদিনের সকল প্রতিরোধ আন্দোলন বা দর্শন দিশার অভিমুখ ছিল সাধারণ অর্থনীতি কেন্দ্রিক । যা সাধারণ মানুষের কাছে অজ্ঞেয় । আর তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রেও বুঝেও না বোঝার ভান করা কিংবা সত্যিই না বোঝা । ফলে তাঁদের চিৎকার বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা সমাধানের দাওয়ায় ভিন্ন অনেকগুলি সমস্যার সৃষ্টি করে চলেছে ।

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় এসেই জড়িয়ে পড়ল সারদা-নারদা সহ নানান আর্থিক দুর্নীতিতে । ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের তর্ক-বিতর্কে তার সমাধান হলো না । সাধারণ মানুষ টাকা ফেরত পেল না । সম্প্রতি যোগ হয়েছে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি । শুধু শিক্ষক নিয়োগে নয়; যেকোনো চাকরি, যেকোনো বদলি সর্বক্ষেত্রে এখন টাকা দিতে হয় । পশ্চিমবঙ্গ সহ প্রায় প্রতিটি রাজ্যে সরকারগুলি নানান দুর্নীতিতে গলা জলে ডুবে থেকেও উন্নয়নের নামে মিথ্যা গলা ফাটাচ্ছেন । নানান কেলেঙ্কারিতে দেশের নেতা-মন্ত্রীরা নিমজ্জিত । সেসব দুর্নীতি থেকে বাঁচতে দল ভেঙে ক্ষমতাশীল দলে নাম লেখাচ্ছেন । পাঁচ বছরের আগে সরকার ফেলে দিয়ে চোরেদের সরকার গড়ছেন । এতসব মাৎস্যন্যায় অবস্থার কত ফিরিস্তি তুলে ধরবো  ? 

আসলে ভারতবর্ষের জন্য সেদিনের গোপালের মতো একজন শুধু ভালো মানুষ নন; আজ একটি ভালো দর্শন দিশার খোঁজ করতে হবে আমাদের । নইলে এতসব কেলেঙ্কারি থেকে সমাজ-রাষ্ট্রের উত্তরণ ঘটবে না । পুঁজিবাদীদের ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের তত্ত্বের কচকচানি বা তর্কযুদ্ধের ঝড়ে মানুষ আজ দিশাহারা । শিক্ষার নামে কুশিক্ষা বা ভুল শিক্ষা । উন্নয়নের নামে দান-খয়রাতি । উৎপাদনের নামে অনুৎপাদিত প্রকল্পে অর্থ ব্যয় । পুঁজিবাদী অঙ্কের হিসেবে দেশের জিডিপ বাড়লেও সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে । একদিকে এক শ্রেণীর মানুষ ক্রমান্বয়ে ভিখারিতে পরিণত হচ্ছে, আরেকদিকে এক শ্রেণীর মানুষ অর্থের পাহাড় গড়ছে । সেখানে দুর্নীতি অবধারিত বিষয় । যতই আমরা তত্ত্বের কচকচানি করি না কেন, নোতুন কোনো আর্থসামাজিক দর্শন দিশা ছাড়া এর থেকে প্রকৃত মুক্তির উপায় নেই । বর্তমানে যে চরম মানস-অর্থনৈতিক শাসন-শোষণের যুগ চলছে এর থেকে মুক্তি পেতে গেলে সেদিনের গোপাল খোঁজার মতো মানস-অর্থনৈতিক দর্শন খুঁজতে হবে আমাদের । দু'একজন ববিতা সরকার আদালতে জিতে চাকরি পেলেও হাজার হাজার ববিতা সরকাররা বঞ্চিতই থেকে যাবেন । স্থায়ী চাকরির পরিবর্তে সরকারগুলি 'সিভিক ভলেন্টিয়ার' বা 'অগ্নিবীর'-এর মতো স্বল্প বেতনের অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করবেন ।  অল্প পয়সার অস্থায়ী কর্মচারি নিয়োগ করে সাধারণ মানুষের ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত  অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেবে । এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ  আন্দোলনও যে খুব একটা হবে তাও নয় । কারণ প্রতিবাদ আন্দোলন যারা করবেন সেই যুবসমাজের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে । প্রতিবাদ আন্দোলন এখন হাতের দর্পনে ।

প্রতিটি মানুষের হাতে পুঁজিবাদীরা এমন একটি যন্ত্র তুলে দিয়েছে, যার দর্পনে প্রতিটি মানুষ বুদ হয়ে পড়ে আছেন । স্বপ্নে সকলেই এখন ইথারীয় বিশ্ব দেখছেন  । বাস্তবের মাটির সঙ্গে খুব একটা সম্পর্ক নেই । বাস্তবের মাটির সঙ্গে যা সম্পর্কিত তা গুজব এবং দাঙ্গা-ফ্যাসাদের বিষয় । গঠনমূলক কোনো বিষয় নিয়ে নয় । এটাও পুঁজিবাদীদের মানস-অর্থনৈতিক শাসন-শোষণের এক ধরনের কৌশল । এসব থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। নোতুন কোনো প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের সহায়তা নিয়ে কৃষি, শিল্প, চাকরি, ব্যবসা সর্বক্ষেত্রে একটি সুসন্তলিত আর্থসামাজিক সমাজ-রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে । জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন নয়; পুঁজিবাদীদের মানস-অর্থনৈতিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে মানস-অর্থনৈতিক দর্শনদর্শন দিয়ে বৌদ্ধিক ভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে । নইলে পুঁজিবাদীদের নানান যান্ত্রিক কৌশলের কাছে সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে  দাঁড়িয়ে থাকবেন । অসৎ নেতা-নেত্রীদের নিত্যনতুন নানান কেলেঙ্কারি, নানান দুর্নীতিতে দেশ ছেয়ে যাবে । প্রতিকার অধরাই থেকে যাবে ।