ধনসঞ্চয়ের স্পৃহা ও সমাজ আন্দোলন

লেখক
খগেন চন্দ্র দাস

‘‘আনন্দসূত্রম’’ দর্শন গ্রন্থের অন্তর্গত পঞ্চম অধ্যায়ের দ্বাদশ সূত্রে বলা হয়েছে---‘‘সমাজ দেশেন বিনা ধনসঞ্চয়ঃ অকর্তব্য৷’’ এই সূত্রটিকে আর্থ সামাজিক দর্শন ‘‘প্রাউট’’ এর পঞ্চ মৌলিক সিদ্ধান্তের প্রথম সিদ্ধান্ত হিসেবে ধরা হয়৷ অর্থাৎ এই সূত্রের বাস্তবায়ন ব্যতিরেকে প্রাউট প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়৷ সূত্রটির একটি অতি সংক্ষিপ্ত বিবরণ যা দর্শন স্রষ্টা তুলে ধরেছেন তা একান্ত আবশ্যক বলেই আমরা উদ্ধৃত করছি৷

‘‘এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সকলের যৌথ সম্পত্তি৷ ভোগ দখলের অধিকার সকলের আছে, কিন্তু  অপব্যয়ের অধিকার কারও নেই৷ কোনো ব্যক্তি (বানান আনন্দসূত্রম গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ অনুযায়ী) যদি অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ ও সঞ্চয় করে সেক্ষেত্রে সে প্রত্যক্ষভাবেই সমাজের অন্যান্যদের সুখ-সুবিধা খর্ব করে থাকে৷ তার আচরণ প্রত্যক্ষভাবেই সমাজবিরোধী, তাই সমাজের অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো ব্যক্তিকেই সম্পদ  সঞ্চয়ের সুযোগ দেওয়া উচিত নয়৷’’ এটি অবশ্যই একটি আপ্তবাক্য ও অপরিবর্তনীয়৷ আপ্তবাক্যসমূহ যাঁরা মহা ব্যষ্টিত্বের অধিকারী তাঁদের চরম উপলব্ধির ফসল আর সেজন্যই অভ্রান্ত৷ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছুর উপর সৃষ্টির সকলের সমান অধিকার’ এর চেয়ে সত্য আর কি হতে পারে?

প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় সকল সচেতন মানুষের মধ্যেই সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি রয়েছে৷ বিষয়টি ব্যধিস্বরূপ হলেও মানুষের পক্ষে সঞ্চয়ের প্রবনতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব৷ ‘‘প্রায়’ শব্দটি আমরা সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি৷ কারণ, বিরল হলেও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সঞ্চয়ের স্পৃহা শূন্য মানুষ একেবারেই নেই এমন কথাও বলা যাবে না৷ তবে তাঁরা অবশ্যই ব্যতিক্রমী৷ মানুষ সাধারণত যে সমস্ত কারণে সঞ্চয়ের জন্য আকুল হয় সেগুলো একবার দেখে নেওয়া যাক৷

ভবিষ্যতের চিন্তা স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে৷ ঘরে আগামীকালের আহারের ব্যবস্থা রয়েছে কি না---এরচেয়ে বড় চিন্তা মানুষের দ্বিতীয়টি নেই বিশেষ করে স্বল্প আয়ের সংসারে৷ (দুই) রোগ-ব্যধিতে চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট অর্থ সঞ্চয়ের কথা প্রত্যেককেই ভাবতে হয়৷ যদিও দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করা মানুষজন অন্নবস্ত্রের সংস্থান করার পর সম্ভাব্য চিকিৎসার জন্য অর্থ সঞ্চয়ের কথা ভাবতেই পারেন না৷

(তিন) ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকেই তার পরিবারের সদস্যদের কিছু সামাজিক কাজকর্ম যেমন বিয়ে ইত্যাদির কথা মাথায় রেখে অর্থ সঞ্চয়ের প্রতি মনোযোগী না হয়ে উপায় থাকে না৷

(চার) সচেতন মানুষ তার পরবর্তী প্রজন্মের সুশিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার  জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সঞ্চয় করে রাখেন৷

(পাঁচ) সমাজে বাস করতে হলে কিছু সামাজিক দায়বদ্ধতাকেও অস্বীকার করার কোন উপায় থাকে না৷  যেমন আত্মীয়-প্রতিবেশী-বন্ধু বান্ধবের বাড়ির আমন্ত্রণ রক্ষা করার খরচ৷ এসবের জন্যও সঞ্চয়ের কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই৷

(ছয়) অনেক সময় মান রক্ষার জন্যও অধিক  অর্থের প্রয়োজন দেখা দেয়৷ উদাহরণ হিসেবে কোন বিশেষ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য বিশেষ পোষাক অনিবার্য হয়ে উঠে৷

(সাত) সঞ্চয় সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষেরই ন্যায় অন্যায় বোধ ও মাত্রাজ্ঞন থাকে না৷ উন্মাদের মত প্রয়োজন থাক বা না থাক ক্রমাগত সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়াতেই থাকেন৷ এটাকে প্রাউট প্রবক্তা ব্যধি হিসেবে চিহ্ণিত করেছেন৷

মানুষের মধ্যে থাকা সঞ্চয়ের আকাঙ্খাকে বিলুপ্ত করার জন্য প্রভাতরঞ্জন সরকার প্রাউট দর্শনের নবম সূত্রে বলেছেন---‘যুগস্য সর্বনিম্নপ্রয়োজনং সর্বেষাং বিধেয়ম্‌’’৷ অর্থাৎ ‘‘মানুষের যা সর্বনিম্ন প্রয়োজন তার ব্যবস্থা সবাইকার  জন্যই করতে হবে৷’’ এমনকি আর একধাপ এগিয়ে তিনি বলেছেন---‘‘অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসগৃহ, শিক্ষা এগুলির ব্যবস্থা সবাইকার জন্যই করা অবশ্য কর্তব্য৷ মানুষের এই সর্বনিম্ন প্রয়োজন আবার যুগে যুগে পাল্টে যায়৷’’

সঞ্চয়ের প্রবনতা রোধকল্পে প্রাউট প্রবক্তার প্রদর্শিত পথে মানুষের সর্বনিম্ন প্রয়োজন পূরণ করতে হলে একটি সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা আবশ্যক৷ শুধু যে মহৎ কথা দিয়ে কখনোই  চিড়ে ভেজানো যায় না মার্ক্সের একটি মহান উক্তিই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷ মার্ক্স বলেছেন---‘‘প্রত্যেকেই নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী শ্রম দাও আর প্রত্যেকেই নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী পারিশ্রমিক নাও’’ from each according his ability, ১৮৭৫ সনে জামার্নির ডেমোক্রেটিক পার্টিকে লেখা কার্ল মার্ক্সের চিঠিতে উল্লেখিত৷) এই বক্তব্যটি মানবিকতার চরমতম উৎকর্ষতার নিদর্শন৷ কিন্তু কজন মার্ক্সবাদী এটাকে মানতে পেরেছেন?

তাই সকলকে সতর্ক করে দিয়ে শ্রী সরকার বলেছেন--- ‘‘সাম্যবাদের উত্থানের ন্যায় আনন্দমার্গ পৃথিবীর অর্থনৈতিক ক্রমবিবর্তন সাপেক্ষ জিনিস নয়... এ হচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাসমূহের এক আমূল পরিবর্তন৷ (কণিকায় প্রাউট, নবম দশম ও একাদশ খণ্ড পৃঃ ১৪৫) এ প্রসঙ্গে  একথাও স্মর্তব্য যে প্রাউট ও আনন্দমার্গ দর্শন দুটো অভিন্ন৷ আনন্দমার্গ ও প্রাউটের চূড়ান্ত  লক্ষ্যের কথা বলতে গিয়ে অন্যত্র অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য কথাটি তিনি বলেছেন---‘‘বিশ্বরাষ্ট্র তথা ‘আনন্দ পরিবারের’ প্রতিষ্ঠা কি বিনা সংগ্রামেই হবে?  এর জবাবে বলব হ্যাঁ, যারা বিশ্বরাষ্ট্রের বা ‘আনন্দ পরিবারের’ প্রতিষ্ঠা চায় তাদের প্রাণশক্তিকে রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে ফেলে না দিয়ে অর্থাৎ রাজনৈতিক সংগ্রাম না করে কেবল সেবার মাধ্যমেই, কেবল রচনাত্মক কাজের মাধ্যমেই মানুষ-জাতের এই চরম সামাজিক কল্যাণ সাধিত হবে৷’’ (কণিকায় প্রাউট,প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ড পৃঃ১৬৫) এই হল মার্ক্সবাদ ও প্রাউট তত্ত্বের প্রয়োগ ভৌমিক পার্থক্য৷ ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে বিপ্লব সংসাধিত করা নয় তত্ত্বের প্রয়োগের মধ্য দিয়ে বিপ্লব সংঘটিত করা৷

প্রাউট অর্থনীতিতে কেন্দ্র বা প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক পরিচালিত সামান্য অংশবাদ দিলে পুরো অর্থনীতিই দাঁড়িয়ে আছে সমবায়কে কেন্দ্র করে৷ প্রভাতরঞ্জন সরকারের এই সমবায় বিপ্লবের চিন্তা একেবারেই নোতুন তেমন নয়৷ সমাজ আন্দোলন থেকে শুরু করে জ্ঞান চর্চার আধার সেমিনার সমস্ত কিছুর একটি লক্ষ---সমবায় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সমাজে অর্থনৈতিক বিপ্লব সংঘটিত করা৷ রক্তস্নাত বিপ্লব বিপ্লবোত্তর সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেই তেমন নিশ্চিততা কে দেবেন?

জনগণের ব্যাপক সমর্থন ছাড়া সমাজ বিপ্লব অকল্পনীয় ও অর্থহীন৷ তাই সমাজ আন্দোলন ও সমবায় আন্দোলন হাতে হাত ধরে চালাতে হবে৷ রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন আনন্দমার্গ আদর্শ প্রতিষ্ঠার একমাত্র সিঁড়ি হলে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী একত্রিশটি ডিপার্টমেন্ট খোলার কি প্রয়োজন ছিল? বস্তুত সংঘটনের সমস্ত শাখা-প্রশাখার বহুল বিস্তারের মধ্য দিয়ে প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার পাশাপাশি একটা সমান্তরাল প্রাউটিষ্ট সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলাই লক্ষ্য হওয়া উচিত৷ সমাজ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য সমাজের মানুষের মধ্যে প্রাউট সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা৷ সমাজের মানুষের মধ্যে ‘‘অস্তেয়, ‘অপরিগ্রহ’ ইত্যাদি বিষয়গুলির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সম্যক বোধ জাগিয়ে তোলার ব্যাপক ও বাস্তবোচিত পদক্ষেপ করতে হবে৷

বাস্তবের কঠিন মাটিতে প্রয়োগের প্রচেষ্টা ছাড়া সমবায় আন্দোলন সফল করার সহজতর বিকল্প কোন পথ নেই৷ প্রাউটের সমবায় আন্দোলন সম্পর্কিত বিষয়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মনে করে সমবায় সম্পর্কিত কবিগুরুর একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করছি--- ‘‘অতিকার্য ধনের শক্তি বহু কায়ায় বিভক্ত করিতে হইবে৷ অর্থনীতিতে মানবনীতির স্থান দিতেই হইবে৷ একদা দুর্বল জীব প্রবল জীবের রাজ্যে জয়ী হয়েছে, আজও দুর্বল হবে জয়ী---প্রবলকে মেরে নেয়, নিজের শক্তিকে ঐক্যদ্বারা প্রবলরূপে সত্য করে৷ সেই জয়ধবজা দূর হতে আমি দেখতে পাচ্ছি৷ সমবায়ের শক্তি দিয়ে আমাদের দেশে সেই জয়ের আগমনী সূচিত হচ্ছে৷’’ (রবীন্দ্রজীবনী, তৃতীয় খণ্ড, প্রভাতকুমার  মুখোপাধ্যায়, পৃঃ ৩১৪)

বীরবলের  কাহিনীতে রয়েছে যে, সম্রাট আকববের মাটিতে  একটি  রেখা টেনে বীরবলকে রেখাটি না ছুঁয়ে ছোট করতে বলেছিলেন উত্তরে বীরবল আকবরের রেখাটির পাশে একটি দীর্ঘতর রেখা এঁকে সম্রাটের রেখাটিকে খর্বকার্য করে তাঁর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন৷ তদ্রূপ পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার পাশে সামবায়িক অর্থ অব্যবস্থার  দীর্ঘতর রেখা টেনে দেওয়ার  মধ্য দিয়েই প্রাউটের  শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রভাতরঞ্জন সরকারের স্বপ্ণ সাকার করার পথ প্রশস্ত হবে৷