গণতন্ত্রের ছিদ্রপথে ধনিকতন্ত্রের প্রবেশ

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

৭৫ বছর পার করেও ভারতীয় গণতন্ত্র সাবালোক হয়ে উঠলো না৷ গণতন্ত্রের প্রচলিত সংজ্ঞা অনুযায়ী শাসককে নির্বাচিত হতে হয় জনগণের দ্বারা৷ গণতন্ত্রের অর্থই জনগণের জন্যে, জনগণের দ্বারা, জনগণের শাসন৷ কিন্তু স্বাধীনতার ৭৭ বছর পূর্ণ করার প্রাক মূহুর্ত্তে আর্থিক বৈষম্যের যে চিত্র সামনে এসেছে তাতে স্পষ্ট শাসক নির্বাচনে জনগণের কিছুটা গৌণ ভূমিকা থাকলেও জনগণের জন্যেও নয়, জনগণের শাসনও নয়৷

সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে ভারতে আর্থিক বৈষম্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশ শাসনকেও ছাড়িয়ে গেছে৷ ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে দেশে এখন ধনকুবেরদের রাজত্ব চলছে৷ এমনও আশঙ্কাও করা হয়েছে শাসন ব্যবস্থা ধনিকতন্ত্র বা প্লুটোক্রেসিতে পরিণত হবে৷ এই প্রতিবেদনেই স্পষ্ট---জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকারে আর্থিক নীতি-রূপায়ণে শাসনতন্ত্র পরিচালনায় জনগণের কোন ভূমিকাই নেই৷ সর্বোচ্চ আদালতের কঠোর পদক্ষেপে নির্বাচনী বণ্ড প্রকাশ্যে আসায় রাজনৈতিক দলগুলির ধনকুবেরদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার যে তথ্য সামনে এসেছে তাতে আরও একটা জিনিস স্পষ্ট হয়েছে নির্বাচনে জয়লাভ করতে রাজনৈতিক দলগুলো জনসমর্থন নয়, ধনিক শ্রেণীর অর্থের ওপর নির্ভরশীল৷

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার লক্ষ্যই হচ্ছে ক্রমবর্দ্ধমান হারে জনসাধারণের সার্বিক কল্যাণ করা৷ এটা তখনই সম্ভব হবে যখন রাষ্ট্রের পরিচালক প্রত্যক্ষভাবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হবে৷ ধনকুবেররা কখনই বিনাস্বার্থে অর্থবিনিয়োগ করে না৷ রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের প্রভাবিত করতে প্রচারে বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয় করে৷ সেই অর্থের যোগান দেয় ধনকুবেররা৷ এই অর্থের জোরেই রাষ্ট্র পরিচালনা ও আর্থিক নীতি নির্দ্ধারণে প্রভাব খাটায় ওই ধনকুবেররা৷ শাসকদলও বাধ্য হয় সাধারণ বোটারদের প্রভাবিত করতে নির্বাচনের পূর্বে যে আদর্শ ও কর্মসূচী ঘোষণা করেছিল সেখান থেকে সরে আসতে৷ কারণ নেতারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে পুঁজিপতিদের অর্থের দাস হয়ে যায়৷ তখন পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষা করতেই আর্থিক নীতি নির্দ্ধারণে বাধ্য হয়৷ প্রাগৈতিহাসিক সমাজের ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিই পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ‘অর্থ যার মুল্লুক তার’ নীতিতে পরিণত হয়েছে৷ শাসক ও ধনকুবের পরস্পরের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে গণতন্ত্রের দ্বারা নির্বাচিত ধনতন্ত্রের দ্বারা শাসিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে৷

ভারতীয় গণতন্ত্রের ছিদ্রপথে ধনিকতন্ত্রের কালো হাত রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে গেছে৷ এখন প্রশ্ণ জনগণই তো নির্বাচিত করছে শাসক৷ ভারতীয় গণতন্ত্রের মারাত্মক একটি ত্রুটি হলো বোট দানের অধিকার৷ প্রাপ্ত বয়স্ক হলেই বোট দেওয়ার অধিকার৷ এরফলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়ার কারণে বোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়৷ আবার শিক্ষার মান নেই, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক চেতনা নেই, কিন্তু বোটাধিকার আছে ভারতবর্ষে এমন মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ৷ এরা ভালমন্দ বিচার না করেই প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে অথবা রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাদের নির্বাচিত করে তাদের নীতি আদর্শ কর্মসূচী বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থের প্রতিকূল৷

ভারতীয় গণতন্ত্রের দ্বিতীয় মারাত্মক ত্রুটি হল বহুদলীয় ব্যবস্থায় কখনই সংখ্যা গরিষ্ঠের শাসক নির্বাচিত হয় না৷ পঞ্চাশ ভাগের কম ভোট পেয়ে সংখ্যা লঘিষ্ট দলের সরকার ঘটিত হয়৷ জনগণের অচেতনতার সুযোগ নিয়ে দলীয় প্রভাব বিস্তার করে প্রশাসনিক কাজ কর্মে হস্তক্ষেপ করে৷ প্রশাসন আইন, বিচার, হিসাব পরিক্ষণ সার্থক গণতন্ত্রের প্রতিটি বিভাগের সর্বেসর্র্ব হয়ে বসে থাকেন একজন মন্ত্রী৷ ফলে গণতন্ত্রের এই বিভাগগুলি স্বাধীনভাবে ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে না৷ গণতন্ত্রের এই ছিদ্রপথেই ধনকুবেররা অর্থের স্রোত বহিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে৷ নেতামন্ত্রীরা এদেরই অঙ্গুলী হেলনে চলে৷ ফলে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ধনিকতন্ত্রে পরিণত হয়েছে৷

ভারতীয় গণতন্ত্রকে সুসংহত ও সার্থক রূপ দিতে হলে গণতন্ত্রের এই ত্রুটিগুলি দূর করতেই হবে৷ এই ত্রুটি দূর না হলে ভারতীয় গণতন্ত্র সাবালোক হয়ে উঠবে না৷ দেশকে আরও অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাবে ধনিকতন্ত্র৷