জামালপুর ভ্রমণ

লেখক
আচার্য নারায়ণানন্দ অবধূত

কয়েক বছর আগে আনন্দনগরের রেলসংক্রান্ত বিশেষ কাজে আদ্রারেল ডিভিশন অফিসে যাওয়া হয় ও কাজের বিষয়টি নিয়ে এ.ডি.আর.এমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। আমার সংঘটন ও গুরুদেবের কথা বলাতে শুনলাম উনি বাবাকে অর্থাৎ গুরুদেব ও আনন্দমার্গের প্রবক্তা শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারকে  ভালো করেই জানেন। কথা প্রসঙ্গে জানালেন জামালপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপ অফিসে কর্মজীবনে গুরুদেব যে চেয়ারে বসে  কাজ করতেন সেটি তাঁর "স্মৃতিচিহ্ন" হিসাবে রেল ডিপার্টমেণ্টে সযত্নে রাখা আছে।

খবরটি শুনে আমি খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম ও সুযোগ হলে দেখার ইচ্ছে জেগে ওঠে । তাছাড়াও বাবা যে রেল স্কুলে পড়াশোনা করেছেন সেই স্কুলের বর্তমান পরিস্থিতি ও বর্তমান শিক্ষকদের নিকট বাবাকে নিয়ে তাদের অভিমত জানারও ইচ্ছে ছিল। আরও একটিজায়গা দেখার আগ্রহ ছিল তা হ'ল বাবার 'জন্মস্থান'। কিন্তু কিভাবে, কবে হবে, জানা ছিল না। হঠাৎ করেই সুযোগ এসে যায় কেরালার কালিকট থেকে অনেক পুরনো ভক্ত মার্গী বেলাইদুন দাদা ও তাঁর সহধর্মিনী শ্রীমতী শৈলজা দিদি জামালপুর হয়ে আনন্দনগর আসার প্রোগ্রাম করেন। ওদের একজন গাইড দরকার ছিল। আমি আচার্য মোহনানন্দ অবধূত দাদাকে অনুরোধ করি ওনাদের গাইড করার জন্যে। যেহেতু দাদার স্থানীয় সবকিছু জানা আছে তাই আমিও উপরোক্ত লক্ষ‍্যপূরণে তাঁদের সঙ্গে সামিল হয়ে যাই। আমরা কলকাতা থেকে জামালপুর এক্সপ্রেস ট্রেনে ২৬শে মার্চ'২২ সকালে জামালপুর অবতরণ করি।

      সকালে স্নান, সাধনা সেরে ও জলখাবার খেয়ে একটি টোটো নিয়ে চারজন বেড়িয়ে পড়ি। প্রথমে বাবার জন্মস্থান, পরে সংলগ্ন জাগৃতি ভবন, তারপর বাবা যে রেল কোয়ার্টারে বসবাস করতেন, শেষে বাবার বিদ্যালয় যা রেল পরিচালিত। যখন বাবা ওই বিদ্যালয়ে পড়তেন তখন ওটি ছিল ম্যাট্রিক পর্যন্ত ও বিহার এডুকেশন বোর্ডের অধীনে। ২০০৩ সাল থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে উন্নীত  হয়েছে ও ২০০৮ সাল থেকে সিবিএসসি এডুকেশন বোর্ডের অধীনে রয়েছে। তখন ছিল বয়েজ স্কুল, ১৯৮৬ সাল থেকে সেটি কো-এডুকেশনাল হয়েছে। আমরা গেটে প্রবেশ করতেই দারোয়ান এসে বললেন বিনানুমতিতে ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। আমাদের আসার উদ্দেশ্য ব‍্যক্ত করাতে ওনারা একজনকে ডেকে সমস্ত বিষয়টি বললেন,  তিনি  তৎক্ষণাৎ  অনুমতি দিয়ে আমাদের সঙ্গী হয়ে  বিদ্যালয় ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন কিছু পরে আরও একজন এগিয়ে এলেন ও ক্লাসরুম, কমনরুম, অফিস ঘুরিয়ে দেখালেন। সবশেষে প্রিন্সপালের সঙ্গে দেখা করতে ঢুকলাম।  তাঁর ঘরে প্রবেশ করতেই দেখি প্রিন্সিপালের পেছনের দেওয়ালে ওপরের দিকে একটি "বাবার ফটো" টাঙানো আছে। প্রিন্সিপালকে জিজ্ঞেস করাতে জানালেন  উনি আমাদের স্কুলের গর্ব। তারপর এক এক করে ডেথভ‍্যালি, তেঁতুল গাছ যেখানে বাবা প্রায়শই গিয়ে বসতেন। কালিপাহাড় যে জঙ্গলে ছোটবেলায় একাই বিভিন্ন ভয়ংকর জন্তুদের সঙ্গে ঘুরেবেড়াতেন, সাহেবের কবর ও বাঘের কবর যেখানে বসে আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন, বিভিন্ন গ্রন্থের রচনা করেছেন। মুঙ্গেরের কষ্টহারিনী ঘাট। প্রবাদ আছে এখানে গঙ্গায় কেউ স্নান করলেই উক্ত ব‍্যষ্ঠির সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা অন‍্যরকম হলো। খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আমাদের যাওয়ার ঘণ্টা দুই আগে সেনাবাহিনীতে চাকুরী করেন এক যুবক স্নান করতে গিয়ে তলিয়ে যায়। ডুবুরী এসে দুই ঘণ্টা খোঁজে মৃতদেহ উদ্ধার করেছেন, আমাদের ওখানে পৌঁছনোর একটু পরেই। ঐতিহাসিক একটি ঘটনাও এখানে উল্লেখ্য । মিথিলার বিখ্যাত কবি বিদ‍্যাপতি ও বৈষ্ণব সাহিত্যের বিখ্যাত কবি চণ্ডীদাসের সাক্ষাৎ ওই ঘাটেই হয়েছিল।

     যাহোক খুবই খারাপ লাগছিল। আমরা যখন রেলের একাউন্টস অফিসে বাবা চাকুরী করতেন সেখানে যাই। আমার খুবই আগ্রহ ছিল সেই চেয়ারটি দেখবো বলে। কিন্তু সেইদিন কলকাতা থেকে রেলের জেনারেল ম্যানেজার ওয়ার্কশপ নিরীক্ষণ ও পরিদর্শন করতে এসেছিলেন। আধিকারিকরা ওনাকে নিয়েই ব‍্যস্ত ছিলেন। তাই আমার সুপ্ত আকাঙ্খা এ যাত্রায় আর পূর্ন হলো না।

খুঁজতে যারে হয় না কোথাও চোখ যেন তায় দেখে,

সদাই যে রয় কাছে তারি পরশ যেন ঠেকে।

       নিত্য যাহার থাকি কোলে

              তারেই যেন যাই গো ব'লে--

                    এই জীবনে ধন্য হলেম তোমায় ভালোবেসে ॥

রবি ঠাকুরের একটি গানের অন্তরা টুকু ভাবতে ভাবতে ফিরে এলাম তাঁর অনেক যত্নে ভালোবাসায় গড়া আনন্দনগরে।