কৈবর্ত বিদ্রোহ ঃ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সুসংগঠিত গণবিদ্রোহ

লেখক
সুকুমার সরকার

পূর্ব প্রকাশিতের পর,

কিন্তু ভবসুন্দরী রাজার কোনো কথাই শুনলেন না৷ তিনি যুদ্ধ করলেন৷ যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দি হলেন৷ মানসিংহ আকবরের কাছে সংবাদ পাঠিয়ে জানতে চাইলেন, একজন রাণী যুদ্ধ করতে এসে বন্দি হয়েছেন তাঁকে কী করবো? একজন নারী  আকবরের সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছিলেন শুনে আকবর প্রীত হলেন ও বললেন, রাণী কী চান? মানসিংহ জানালেন রাণী বাঙলার স্বাধীনতা চান৷ একজন নারীর এই সাহসের তারিখ করে আকবর বললেন, নামমাত্র করে বাঙলাকে স্বাধীন করে দিয়ে এসো৷ সেই সঙ্গে তিনি বীরাঙ্গনা  এই রাণী ভবসুন্দরী জন্য ‘‘রায়বাঘিনী’’ খেতাবও দিয়ে পাঠালেন৷ আকবর জাহাঙ্গিরকে ঘিরে বর্ধমানের অনেক ইতিহাস লেখা আছে কিন্তু এই রায়বাঘিনী ভবসুন্দরীকে নিয়ে কোনো ইতিহাস লেখা হয়নি৷ কিন্তু মানসিংহের দুর্গ গড়া সেই ‘শক্তিগড়’ ছিল৷ বিভিন্ন স্থানে রাণীর উল্লেখ ছিল৷ ‘ভবী ভুলবার নয়’ প্রবাদ ছিল৷ ‘রায়বাঘিনী’ উপাধি ছিল৷ এইসবের উল্লেখ থেকে আমরা ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা করিনি৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী করেছেন৷ ও বিস্মৃত সেই ইতিহাস গ্রথিতও করেছেন৷

হ্যাঁ, কৈবর্ত বিদ্রোহের এই বিস্মৃত ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এমনই একজন নারীর কথা৷ কীর্তিগাথার আলোকে ইতিহাস খুঁজতে যাইনি বলেই ইতিহাসের এই বিপত্তি ঘটেছিল৷ সেখানে ঐতিহাসিকরা হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন আর বলছিলেন, দিবেবাক প্রথমেই বিদ্রোহ করেননি৷ কিংবা মহীপাল অত্যাচারী রাজা ছিলেন না৷ তাহলে প্রথমে কে বিদ্রোহ করেছিলেন? মহীপাল অত্যাচারী রাজা না হলে  অত্যাচারী রাজা কে ছিলেন?

হ্যাঁ, এই উত্তরের মধ্যেই নিহিত আছে কৈবর্ত বিদ্রোহের প্রকৃত ইতিহাস৷ আর তার সূত্র ছিল পাল-বৌদ্ধযুগের সমাজ-সংস্কৃতির মধ্যেই৷ যেখানে নেপথ্য থেকে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন একজন অন্তঃপুরবাসিনী নারী৷ দ্বিতীয় দেবপালের  ধর্মপত্নী লজ্জাদেবী৷ হ্যাঁ, সেই যুগে স্ত্রীর প্রতিশব্দ হিসেবে ধর্মপত্নী বা সহধর্মিনী, ভার্যা, কলত্র, দ্বারা প্রভৃতি অনেকগুলো প্রতিশব্দ ছিল৷ দায়িত্ব ও কর্তব্যের ভিত্তিতে এক একজন স্ত্রী এক একরকম অধিকার ভোগ করতেন৷ যে স্ত্রীকে যজ্ঞের সমিধ দেবার অধিকার দেওয়া হতো তাঁকে বলা হতো ‘ধর্মপত্নী’ বা ‘সহধর্মিনী’৷ রাজ পরিবারে তিনিই হতেন প্রধান মহিষী বা পাটরাণী৷ তিনি প্রায় রাজার সমতুল্য মর্যাদা ভোগ করতেন৷ ও  অনেক ক্ষেত্রে সম অধিকারে রাজকার্যেও হস্তক্ষেপ করতেন৷ বিশেষ করে রাজা যদি দুর্বল বা অত্যাচারী বা  ধর্মবিরোধী হতেন সেক্ষেত্রে অনেক মহিষীই রাজ কর্তব্য করতে এগিয়ে আসতেন৷ ভবসুন্দরীর কথা তো আগেই বললাম৷ কৈবর্ত বিদ্রোহের সময়ও এমনই কিছু ঘটেছিল৷ যেহেতু এর নেপথ্যে ছিলেন একজন নারী, প্রথমত সেইহেতু এই অংশটুকু ইতিহাসে বাদ দেওয়া হয়ে থাকতে পারে৷ দ্বিতীয়ত,রাজপ্রশস্তি গাথায় দ্বিতীয় দেবপালের মতো একজন অত্যাচারী, অন্যায়কারী রাজার নাম কী করে উল্লেখ করেন কাব্যকার! ফলে দিবেবাক-ভীমের কাহিনী  কাব্যে একদিকে দিবেবাককে দস্যু, কুৎসিত বলা হয়েছে, অন্যদিকে অত্যাচারী ছিলেন বলে দ্বিতীয় দেবপালের নাম উল্লেখই করা হয়নি৷

প্রশ্ণ আসতে পারে, এই সূত্রে রাণীর ভূমিকা উঠে আসার প্রেক্ষাপটটা কী? হ্যাঁ, সুন্দর প্রশ্ণ! কৈবর্ত বিদ্রোহের নায়ক দিবেবাক-ভীমের কথা স্বীকার করেও ঐতিহাসিকরা একটি ধন্দ  থেকে বেরোতে পারছিলেন না, তা হলো দিবেবাক বা ভীম উচ্চ রাজকর্মচারী ছিলেন৷ ধন্দটা হলো একজন উচ্চ রাজকর্মচারীর পক্ষে একটি গণবিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়া বা গণ বিদ্রোহ সংঘটিত করা কীভাবে সম্ভব, বিশেষত সেই যুগে?

ঐতিহাসিকদের এই প্রশ্ণ যথার্থ৷ আর এখানেই পাটরাণীর বা ধর্ম পত্নীর ভূমিকা এসে যাচ্ছে৷ সেই সময়ের সমাজ-সামাজিকতায় ধর্মপত্নীর দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে বলতে দিয়ে প্রসঙ্গক্রমে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী এই পাটরাণীর কথা বলেছেন৷ আর তাতেই উজ্জ্বল আলোর রেখায় ফুটে উঠেছে কৈবর্ত বিদ্রোহের  সত্য ইতিহাসের এই বিস্মৃত অংশটুকু৷ যা এতদিন হাজারো প্রশ্ণের ধুম্রজালে ধূমায়িত ছিল৷ চলুন সরাসরি দেখি ইতিহাসের সেই উজ্বল আলোর রেখায় কী ফুটিয়ে তুলেছেন  শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘কথা প্রসঙ্গে বলে রাখি,  সেকালে সমাজ সংরচনা ঠিকভাবে গড়ে ওঠেনি৷ সেকালে মানুষ তার স্ত্রীকে, একজন স্ত্রীকে এই যজ্ঞের সমিধ দেবার অধিকারটা দিত,  একের বেশী স্ত্রীকে নয়৷ রাজারাও যখন যজ্ঞ করত তচার একাধিক স্ত্রীর মধ্যে  একজন স্ত্রীই যজ্ঞে সমিধ দিতে পারত, সেই স্ত্রীকে বাঙলায় বলা হতো পাটরাণী বা মহিষী, সংস্কৃতে  বলা হতো পত্নী৷ বাকীদের সেই অধিকারটা ছিল তাকে বলা  পত্নী৷ পত্নীর যখন ওই অধিকারটা ঠিল তখন পত্নীর কর্তব্যও ছিল তখন পত্নীর কর্তব্যও ছিল সব সময় দেখা, তার স্বামী---সে রাজাই হোক আর বিপ্রই হোক,---যেন কক্ষনো কুপথে, ধর্ম বিরোধী পথে না যায়৷ সেদিকে সে কড়া নজর রাখত, ও যদি  সে ধর্মবিরোধী পথে যেত, তার  বিরুদ্ধে সংগ্রাম করত অর জনসাধারণ সেই পত্নীকে সমর্থন করত৷

বৌদ্ধযুগে দ্বিতীয় দেবপাল যখন বাঙলায় রাজা ছিলেন তিনি অনেক অন্যায় কাজ করেছিলেন, তখন তার প্রজারা তার বিরুদ্ধে  বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল৷ তখন বাঙলার জনগোষ্ঠীর  শতকরা নববই ভাগ ছিল কৈবর্ত্ত৷ পরবর্তীকালে সেই কৈবর্তদের মধ্যে  যাদের লেখাপড়া ছিল, টাকাপয়সা ছিল, তারা তথাকথিত উচ্চ জাতে পরিণত হ’ল৷ গোড়ার দিকে বাঙলার জনগোষ্ঠী মানেই ছিল কৈবর্ত্ত৷ বাঙলা হল দলের দেশ৷ ‘ক’ মানে জল৷ কৈবর্ত্ত মানে জল যার জীবিকা যেমন জলে যে মাছ ধরে, জলের সাহায্যে যে চাষ করে, সবাই কৈবর্ত্ত৷ কৈবর্ত থেকে প্রাকৃত ভাষায় ‘কৈবট্ট’৷ কৈবট্ট থেকে বর্তমান হিন্দীতে ‘কেওট’৷  তা সেই রাজার যিনি পট্টমহিষী-পটরাণী ছিলেন তার নাম  ঠিল লজ্জাদেবী৷ তিনি বললেন ---‘না’ এতো অধর্ম হয়ে যাচ্ছে ও পত্নী হিসেবে কর্তব্য এই অধর্মের বিরোধিতা করা৷ তখন রাণী কী করল?---না, অত্যাচারিত মানুষ যারা তার কাছে  এল,  রাণী তাদের বললেন--- আমি  তোমাদের নিয়ে সংগ্রাম করব৷ সংগ্রাম হল, সংগ্রামে দ্বিতীয় দেবপালের মৃত্যু হ’ল৷ বলতে পার, বাঙলা কেন, পৃথিবীর ইতিহাসে প্রজারা রাজাকে সরিয়েছিল এই ধরনের ব্যাপার উপলক্ষ্য করে এই প্রথম৷ ইংল্যান্ডে ব্যাপারটা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ঠিক এ ধরনের নয়৷ তখন সেই বাঙালী জনতার নেতা ছিলেন ভীম নামে একজন৷ তিনি যুদ্ধে মারা যান৷ তার ভাইপো ছিল দিবেবাক, দিবেবাককে উনি রাজা করলেন৷ অতঃপর রাণী নিজে স্বামীর চিতায় জ্বলে মরলেন৷ কিন্তু স্বামী হত্যা তিনিই করিয়েছিলেন৷ লড়াইটা হয়েছিল বর্তমান পৌণ্ড্রবর্দ্ধন ভূক্তিতে, মালদা আর দিনাজপুর জেলার সীমান্ত এলাকায়৷ দিবেবাক রাজা হলেন৷ নাম হ’ল--- দনুজমর্দ্দন দেব৷ তারই নামে শহর তৈরী হ’ল দিনাজপুর৷’’