কৃষি আইন ও সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রসঙ্গে

লেখক
এইচ.এন.মাহাত

সম্প্রতি কৃষি আইনে সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ দিলো৷ শুনতে খুবই ভালো লাগছে, এই প্রথম বিজেপি সরকার একটি জবরদস্ত ধাক্কা খেয়েছে৷ কোর্টের আদেশকে আমিও স্বাগত জানাই৷ কিন্তু প্রশ্ণ থেকেই যাচ্ছে৷ মাসাধিক কাল পেরিয়ে গেছে দিল্লি বর্ডারে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে অবস্থান  আন্দোলন করতে গিয়ে কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছেন অথবা  বিভিন্ন কারণে যে মৃত্যু হয়েছে তার সংখ্যা কম নয়৷

রায়ে বলা হয়েছে কোর্টের তৈরী চার জনের একটি কমিশন দুই মাসের মধ্যে বিলটিকে নিয়ে বিশ্লেষণ করে একটি রিপোর্ট পেশ করবেন৷ তারপরেও আরো কিছু দিন লাগবে আলোচনা ও পর্যালোচনায়৷ তাতে দুই পক্ষের কারোর পছন্দ নাহলে আবার সেটা কোর্টে গড়াবে৷ কোর্ট যে চারজনকে মনোনীত করেছেন তারা মোদী সরকারের কৃষি বিলকে আগেই সমর্থন জানিয়েছেন৷ এ বিষয়েও প্রশ্ণ থেকেই যাচ্ছে---এদের কাছ থেকে নিরপেক্ষভাবে এই জটিল সমস্যার সমাধানের কোনো সুপারিশ আসতে পারে কী? অবশ্য ইতোমধ্যেই কোর্ট মনোনীত ৪ জন সদস্যের একজন পদত্যাগ করেছেন৷

অন্যদিকে কোর্ট আন্দোলনকারীদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রশ্ণে যাইবলুক কেন আন্দোলনকারীরা কিন্তু  পিছপা হতে রাজি নয়৷ কর্ষকদের স্বার্থের পরিপন্থী তিনটি কৃষি বিলের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের  বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস ও হার না মানা মানসিকতাকে দমন করার এটা নতুন কোন চাল কিনা কে জানে৷

গণতান্ত্রিক আন্দোলন ক্রমাগত চালিয়ে যেতে হলে লোকবল ও আর্থিক বল খুবই প্রয়োজন৷

আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কর্ষক ও সরকার দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা বারবার ব্যর্থ হয়েছে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের অহংবোধ ও পুঁজিপতিদের  স্বার্থ রক্ষায় বাধ্য-বাধকতার জন্য যা সুপ্রিম কোর্টও আলোচনায় স্বীকার করে নিয়েছে৷

শুধু তাই নয়৷ আলোচনা বিফল হওয়ার আরো কারণ, সরকার কোনমতেই বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি থেকে একচুল না সরে কর্ষকদের আইনটি মেনে নিতে বলছে৷ বারবার একটি কথাই বলছে কর্ষকরা এখন থেকে শষ্যের নাকি সঠিকমূল্য পাবে৷ কিন্তু বিলে লেখা হয়েছে যে ---বহুজাতিক সংস্থার আওতায় যে জমি থাকবে তারাই সেই জমিতে কি ধরনের  ফসল হবে তা যেমন নির্ধারণ করবে ও উৎপাদিত ফসলের দামও ধার্য করে দেবে৷ অধিকন্তু জমির জন্য বীজ, সার, লাঙ্গল, শ্রমিক ইত্যাদির মূল্যও সেই সংস্থা নিজেরাই নির্ধারিত করবেন একতরফাভাবে৷ কর্ষক কোন অবস্থাতেই অন্যকোন জায়গা থেকে এইসব ক্রয় করতে পারবে না৷ এটাই হবে কৃষির উপর একচেটিয়া ব্যবসা৷ তাছাড়াও প্রাকৃতিক বা অন্য কারণেই হোক শষ্য কম উৎপাদন হলে বা কর্ষক ক্ষতি হলে সেই সংস্থা দায়ী হবেন না৷ সাধারণত পণ্য সামগ্রী সরবরাহ কম হলে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও নতুন আইন কার্যকরী হলে কর্ষকরা লাভবান হবে না৷ পরিবর্তে মুনাফা লুটবে বহুজাতিক সংস্থা৷ এভাবে চলতে থাকলে জমির মালিক একদিন জমির স্বত্ত্ব বহুজাতিক সংস্থার হাতেই বিক্রয় করতে বাধ্য হবে৷ অতিরিক্ত করের নামে জমিদারি শোষণ বন্ধ করার জন্য ইন্দিরা গান্ধী জমিদার প্রথা ও রাজন্য প্রথা বিলোপ করে ছিলেন৷ বর্তমান সরকার রাজনৈতিক স্বার্থে নতুনভাবে কৃষি ও কর্ষকদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার জন্যই কৃষি সম্পর্কিত তিনটি আইন এনে ভারতের স্বাধীন কৃষি ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে পরাধীন ভারতের নীলচাষের মত কৃষি উৎপাদন সিষ্টেম চালু করতে চাইছে৷

ভারতবর্ষ কৃষিভিত্তিক দেশ৷ এদেশের অর্থনীতিও কৃষির উপর নির্ভরশীল৷ এমতাবস্থায় ভারতের কোন দল বা নেতৃত্বের কাছে রাজনৈতিক , সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুষ্ঠু সমাধানের নীতিমালা না থাকার ফলে ভারত অর্থনৈতিক  দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছে৷ সেইক্ষেত্রে কৃষি ও কর্ষকদের কথা চিন্তা করে ‘‘প্রাউট’’ (সামাজিক অর্থনৈতিক দর্শন) প্রবক্তা মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার কৃষি ও কর্ষকদরে বলিষ্ঠ অর্থনৈতিক ভিত গড়তে বললেন--- কৃষিকে বাঁচাতে হলে কৃষি ও শিল্পের মধ্যে সুসামঞ্জস্য পরিকল্পনা চাই৷ প্রথমেই  দরকার কৃষিকে শিল্পের মর্যাদা দেওয়া৷ শিল্পের  উৎপাদিত পণ্যের  বাজারে  বিক্রয় মূল্য নির্র্ধরণ হয় যেমন করে তেমনি কৃষিক্ষেত্রেও কৃষি উৎপাদিত পণ্যের  বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করতে হবে৷ কৃষিকে কেন্দ্র করে --- ব্লকে ব্লকে কৃষিভিত্তিক ও কৃষি সহায়ক শিল্পের মাধ্যমে কর্ষকদের আত্মনির্ভরশীল করতে হবে৷ এরজন্য প্রাউট প্রবক্তা বলেছেন--- সুসন্তুলিত ও সুসামঞ্জস্য পরিকল্পনা কথা৷ সেই অনুযায়ী কৃষিক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ কৃষিজীবী, কৃষিকে কেন্দ্র করে কৃষিভিত্তিক শিল্পে ও কৃষি সহায়ক শিল্পে ৪০ (২+২০) শতাংশ, ব্যবসায় ১০ শতাংশ ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান যেমন অফিস ও প্রতিষ্ঠানে ১০ শতাংশ মানুষকে কাজে ১০০ শতাংশ মানুষের  কর্মসংস্থান করে রাষ্ট্রের আর্থিক উন্নতি করা৷ বর্তমানে রাজনৈতিক নেতারা অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে বেশী করে লোক নিয়োগে উৎসাহিত৷ কারণ তাদেরকে সরকারী কাজ অপেক্ষা রাজনৈতিকভাবে দলের স্বার্থে বেশী ব্যবহার করা যাবে৷ রাষ্ট্রের আর্থিক উন্নতি করতে হলে কৃষি পরিকল্পনার  প্রথমেই নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষের দ্বারা ‘সমবায় তৈরী করে গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী করতে হবে৷ কৃষি মানেই জমি আর তাই প্রতি ইঞ্চি জমিতে জলসেচের ব্যবস্থা করা৷ কোন অবস্থায় উর্বর কৃষি জমিতে শিল্প গড়ে গ্রামীন অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে ধবংস করা যাবে না৷ অন্যদিকে উৎপাদিত পণ্যকে বাজারজাত না করে উৎপাদক সমবায়ের মাধ্যমে গোডাউনজাত করলে কর্ষকরা বেশী লাভবান হবে৷

তিনি আরও বলেছেন ‘‘ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনার’’ মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যকে দিয়ে কুঠির শিল্প ও সমবায়ের মাধ্যমে শিল্প গড়লে সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান ও বাঁচার প্রশ্ণে গ্রাম থেকে শহরে আসার স্রোত  বন্ধ হবে৷ ফলে গ্রাম ও শহরের মধ্যে সমন্বয় রক্ষা হবে৷