কৃষিনীতির আমূল পরিবর্তন চাই

রাজশক্তির উত্থান–পতন হয়ে চলেছে৷ রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতবদল হচ্ছে৷ কিন্তু গ্রামের কর্ষকদের জীবন–কথার কোনো পরিবর্তন হচ্ছেনা৷ তারা গায়ের রক্ত জল করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল ফলাচ্ছে৷ তারা খাদ্য উৎপাদন করছে৷ কিন্তু তারা, তাদের পরিবারবর্গ অর্দ্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, সে খাদ্য মজুত হচ্ছে তাদের ভাঁড়ার ঘরে–এই খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্কই নেই৷ যে মাটিতে খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে, সে মাটিকেই তারা  চেনেই না৷ 
বস্তুতঃ কৃষি থেকেই খাদ্য, কৃষি থেকে তুলা বা বিভিন্ন তন্তু–তা থেকেই বিভিন্ন ধরনের বস্ত্র৷ শিক্ষার প্রধান উপকরণ যে কাগজ তা–ও কৃষিজাত দ্রব্য থেকে তৈরী৷ এইভাবে দেখা যায় কৃষিই সভ্যতার ভিত্তিভূমি৷ অথচ সেই কৃষি ও কর্ষকরাই সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত৷ 
বছরে বছরে শহর নগরের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ী–সবকিছুই পরিবর্তিত হয়ে চলেছে, বিজ্ঞানের নব নব অবদান শহর–নগরবাসীদের্ জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন ঘটাচ্ছে৷ কিন্তু এই গ্রামের কর্ষকরা সেই বিজ্ঞানের আশীর্বাদ থেকে প্রায় বঞ্চিতই বলা চলে৷ 
গ্রামের কর্ষকদের জীবনেতিহাস আবর্তিত হচ্ছে সেই একই পুরানো বৃত্তে৷ পুরুষানুক্রমে সেই একই দৈনন্দিন জীবনচর্যা, একই দুঃখের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি৷
গ্রামের কর্ষক পরিবারগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করুন৷ পুরুষানুক্রমে তারা তাদের জমিতে লাঙ্গল আর বলদ দিয়ে চাষ করছে৷ 
সেচের জলের সংকট আগেও যেমন ছিল, এখনও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তেমনি আছে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বছরে একবারই ফসল হয়৷ তাও বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে খরা, বন্যার সঙ্গে নিত্যই তাদের লড়াই করে যেতে হয়৷ আগে যেমন ভাবে করত৷ এখনও প্রায় একই ভাবে করতে হয়৷ 
শিক্ষিত চাকুরীজীবীরা শহরে নগরে এসে বসবাস করছেন৷ কিন্তু চাষীভাইরা কোথায় যাবেন এই গ্রামেই তাঁদের থাকতে হয়৷ আর অধিকাংশ গ্রামের রাস্তাঘাটের তেমন কিছু পরিবর্তন হয়নি৷ বহু গ্রামে বিদ্যুৎ নেই৷ গরীব চাষীদের রাতে কেরোসিনের আলোর ওপরই নির্ভর করতে হয়৷ তাও তো কেরোসিনের দাম ক্রমেই তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে৷ রেশনে আপেক্ষাকৃত কম দামে কেরোসিন দিলেও গরীব গ্রামবাসীদের ক্রয়ক্ষমতা যে শূন্যের কাছাকাছি৷ তাই তাদের জীবনে আর আলো জ্বলে না৷ 
পৈত্রিক যে জমিতে তারা চাষ করত, তাও ভাই–বোনেদের মধ্যে ভাগ হতে হতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়েছে৷ জমির আলেই অনেক জমি নষ্ট হয়৷ আবার এই জমি ভাগাভাগি নিয়েও কত ঝগড়াঝাটি, কত কোর্ট কাছারি চলছে৷ মান্ধাতার আমলের লাঙ্গল–বলদ নিয়েই চাষ হয়৷ এই গ্রামেরই বা পাশাপাশি গ্রামের কেউ কেউ ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার আনলেও তার জন্যে বাড়তি খরচ করার জন্যে পয়সা কোথায় 
জলের অভাবে বছরের অধিকাংশ সময় জমিকে ফেলে রাখতে হয়৷ মহাজনদের কাছে ধারধোর নিয়ে কোনোরকমে একবার বা দুবার ফসল ফলালেও ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কম দামেই (তখন বাজারে কম দাম থাকে) মহাজনদের কাছে ফসল বেচে ঋণশোধ করতে হয়৷ ফলে চাষীদের অভাব আর মেটে না, অনেক সময় ঋণ করে’ চাষ করা হ’ল, কিন্তু প্রকৃতি বিরূপ হওয়ায় ফসল ঠিকমত হল না৷ এখন মহাজনের ঋণ শোধ করবেই বা কী করে আর সারা বছর কী খেয়ে বাঁচবে আবার ফসল হয়তো হ’ল, কিন্তু বাজারে ফসলের দাম যা তাতে ফসল ফলাতে যা খরচ হয়েছে–তা উঠছেই না৷ ফলে ঋণশোধ ও পরিবারের ভরণ পোষণ কীভাবে হবে–তার কোনো পথ খুঁজে পায় না৷ এই দুশ্চিন্তায়, হতাশায় অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়৷ 
এইভাবে চাষী পরিবারগুলির জীবনের অন্ধকার আর ঘুচছে না৷ এ থেকে উদ্ধারের ঠিক ঠিক পথ কোনো রাজনৈতিক দলগুলিই দেখাতে পারছে না৷ 
কম্যুনিষ্ট পার্টির দাদারা চাষীদের দিয়ে অনেক লড়াই ঝগড়া করে তাদের কাউকে কাউকে ২/৫ কাঠা করে জমি পাইয়ে দিলেন৷ কিন্তু ওই জমি নিয়ে কারুর দুঃখ ঘুচল না৷ কেউ কেউ আর ওই জমি বেচেই দিলেন৷ বর্গায় জমি পেয়েও কি চাষীদের দুঃখ ঘুচল না তাতেও দুঃখ ঘুচল না৷ 
নোতুন নোতুন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এল৷ বড় জোর সাময়িক সরকারী অনুদান ও কমদামে বিনামূল্যে কিছু দিনের জন্যে চাল বা অন্য কিছু দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন৷ তাতে কি চাষী পরিবারগুলির জীবনের অন্ধকার দূর হবে তা তো নয়৷ 
আসলে এইভাবে জোড়াতালি দিয়ে–কিছু কিছু অণুদান দিয়ে, ২–টাকা কেজি চাল বা এই ধরণের কিছু দয়াদাক্ষিণের মাধ্যমে কর্ষকদের তথা গ্রামবাসীদের প্রকৃত আর্থিক উন্নয়ন সম্ভব নয়৷ চাই কৃষিনীতি ও গ্রামোন্নয়ন নীতির আমূল পরিবর্তন যার মধ্যে রয়েছে ধাপে ধাপে কৃষিকে সমবায়ের আওতায় আনা, সমবায়ের ভিত্তিতে গ্রামে গ্রামে ব্যাপক কৃষিভিত্তিক শিল্প ও কৃষি সহায়ক শিল্পের প্রসার উৎপাদক সমবায়ের সঙ্গে সঙ্গে উপভোক্তা সমবায়ের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া৷ একমাত্র এরই মধ্যে রয়েছে কর্ষক সমাজের ও গ্রামোন্নয়নের চাবিকাঠি৷