মীরজাফর যুগে যুগে

লেখক
এইচ.এন.মাহাত

বাঙালী জাতিসত্তাকে ধবংস করে দিতে চায় এমনি একটি দলের সঙ্গে গিয়ে সদ্য ভিড় করেছেন বাঙালীর এক নব্য মীরজাফর৷ তিনি সেই দলে নাম লিখিয়ে বলছেন--- আগে আমি ভারতীয় তারপর বাঙালী৷ খুব ভালো কথা, আপনি আপনার জন্মদাত্রী মাতাকে একটু জিজ্ঞেস করুন না--- তাঁর মাতৃভাষা কী ভারতীয়? ভারতীয় বলে এদেশে কোন ভাষা কী আছে? ভারতবর্ষ তো বহু ভাষা ও মতের দেশ৷ তাই কোন নির্দিষ্ট ভাসাকে ভারতীয় ভাষা বলা যাবে না৷ পৃথিবীর সকল মা যে ভাষাতে কথা বলে সেটাই তাঁর মাতৃভাষা, যেখানে সে  জন্মেছে সেটাই তাঁর জন্মভূমি, সেটাই তাঁর জন্মস্থানের পরিচয়৷ মহামান্য ভারত দরদী মহাশয় তৃণমূল ত্যাগের পূর্বে সতীশ সামন্তের মতো মহান বিপ্লবীদের নাম করে আপনি বলেছিলেন---আমি বাঙালী ও বাঙলার জন্যে সব কিছু করবো! আজ হঠাৎ ভারত দরদী হয়ে কী প্রমাণ করতে চাইছেন?

নতুবা দলে যোগ দেওয়ার পর আপনি বলেছেন ‘আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পার্টিতে যোগ দিলাম৷ জাতীয়তাবাদ, বহুত্ববাদ, দেশপ্রেমে বিশ্বাস করে এই দল(!)৷ বসুধৈব কুটুম্বকম, বহুজন হিতায় বহুজন সুখায় আদর্শ মেনে চলে (!)৷ প্রায় ২০ বছর পর হঠাৎ কী করে  এই কথাগুলোর বোধদয় হোলো আপনার? এখন আপনি বুঝতে পারলেন পৃথিবীর এক কোনে বাঙলার একটি খুব ছোট্ট দলের সঙ্গে ছিলেন৷ আর বহুজন হিতায় করবেন বলেছেন৷ আপনি এক সময় বলেছিলেন গত সাত বছরে বিজেপি বাঙলাকে শুধু বঞ্চনাই করেছে৷ রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রজেক্টের টাকা বা প্রাকৃতিক দুর্র্যেগের কোন প্রকারের আর্থিক সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি৷ এখন আপনি কীভাবে ভাবলেন বাঙলা ও বাঙালী বিদ্বেষী দলটির হাত ধরে বাঙলার জন্য বিরাট কিছু করবেন? আপনি বলেছেন ওই দলটি নাকি  জাতীয়বাদ, বহুত্ববাদী ও দেশপ্রেমে বিশ্বাস করে (!) জাতীয়তাবাদ ভারতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কিন্তু উল্লেখিত দলটিকে পিছনে কল কাঠি নেড়ে পরিচালনা করছে আর এস এস নামে একটি সংঘটন৷ তাঁরা সংকীর্ণ ধর্মীয় মতবাদের আড়ালে বার বার দেশের মাটিকে রক্তাক্ত করেছে ও এখনো কুঠারাঘাত করে চলেছে৷ ভারত মানেই যেখানে যত ভাষা, যত মত, যত পরিধান, বহুধা খাদ্য ইত্যাদি সেখানে তাদের মূল স্লোগান হলো হিন্দি, হিন্দুস হিন্দুস্তান৷ সবাইকে নাকি এখন হিন্দি শিখতে হবে৷ এখন দেশপ্রেম যেন এই দলটিতে উথলে উঠছে যার প্রমাণ মেলে কোন ভোট এলেই এরা পাকিস্তান বা চীনের সঙ্গে লড়াইয়ের পরিস্থিতি তৈরী করে ভোট ভিক্ষা করেন৷ জানেন কী স্বাধীনতার লড়াই থেকে আজ অবধি বিভিন্ন যুদ্ধে গুজরাটের কত জন নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে? সংখ্যাটি প্রায় শূন্য? এরা এখন বোঝাতে চাইছে তাঁরা-ই ভারতের একমাত্র দেশভক্ত আর সকলেই পাকিস্তান পন্থী৷ এসব জেনে বুঝে ও বাঙলা মায়ের স্তনপান করে অথবা বাঙলার মায়ের স্নেহমমতায় লালিত পালিত হয়ে আপনি হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের স্তুতি করছেন? ইতিহাস ভুলে যাবেন না৷ মীরজাফর, মিরমদনের শেষ পরিণতি কী ভয়াবহ হয়ে ছিলো৷ জানেন তো বর্তমানে আপনি যে দলে ভিড়েছেন তাঁরা বাঙলা ও বাঙালীর প্রতি কত বিদ্বেষ পরায়ণ? অতীতের কথা বাদ দিলেও নজির হিসাবে বলছি  ত্রিপুরাতে যে বাঙালী নেতার কঠোর পরিশ্রম ও পরিকল্পনায় রাজ্যটি তাঁরা জয় করেছে ব্যবহারের পর তাকেই তারা এখন ছোবড়ার মত ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে৷ আপনার জন্য সেই পরিণতি অপেক্ষা করছে কী না তা নিয়েই আমরা ভাবিত৷

আপনি হয়তো এখন থেকে হিন্দি ভাষায় ও আদব কায়দায় মাষ্টার হবেন, ওইভাবে নিজেকে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে মানিয়েও নেবেন৷ আপনি জানেন কী পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ও মাধুর্যপূর্ণ ধ্রপদী ভাষার অন্যতম ভাষা হলো বাংলা৷ আর সেই বাংলা ভাষাকে বর্তমান সরকার উপযুক্ত মর্যাদা না দিয়ে মুছে ফেলতে চাইছে৷ অথচ অল্প সংখ্যক মানুষের গুজরাটি ভাষাকে ওইস্থান দিয়েছে৷ এরজন্য বাঙালীরা কুন্ঠিত নয়৷ কারণ বাঙালী জাতি বরাবর উদার মনা৷ তাঁরা অপরের সুখে সুখী ও দুঃখে দুঃখী হয়ে পাশে থাকতে চায় আমাদের দুর্র্ভগ্য আপনার মতো বিচক্ষণ (!) মানবদরদী (!) মানুষ কীভাবে নরখাদক হায়নাদের দলে ঢুকে নিজেকে কালিমা লিপ্ত করলেন৷ এটাও ঠিক, যে দলটিতে ছিলেন তারাও কিন্তু হিন্দি আগ্রাসন থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করার চেষ্টা করেনি৷ বরং হিন্দি  অসংস্কৃতিক আমাদের উপর চাপাতে সাহায্য করেছে৷ আপনি তো কখনো কোনোদিন বাধা দেননি৷ তার মানেই আপনিও (বক্তব্যে বলেছেন ২০১৪ সাল থেকে মানসিকভাবে যুক্ত) হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী প্রতিনিধি হয়ে কাজ করছেন৷

যে দলটি ক্ষমতা দখলের নামে শুধুমাত্র টাকার দ্বারা সবকিছুর মূল্য নির্ধারণ করে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যাদের একবিন্দু অবদান  ছিলো না, ব্রিটিশ আমলে বাঙলার বিপ্লবীদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যাদের জুড়ি মেলা ভার, আপনার মতো মানুষ তাদের দলে ভিড়েছেন?

শুধু তাই নয়৷ বর্তমানে আপনার পছন্দের কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক ভুল নীতির জন্যে ভারতের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবর্ণের মানুষের বেঁচে থাকার সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে৷ ভারতের লাভজনক রেল, ভেল, ইসকো, ডাক-তার, এল.আই.সি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে এরা এখন জলের দরে দেশী ও বিদেশী পুঁজিবাদী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে শুরু করে দিয়েছে৷ নোটবন্দি, জি.এস.টি, এন.আর.সি, নাগরিক আইন, কৃষি আইনের মতো একের পর এক জন বিরোধী কাজ করে সাধারণ নাগরিকের বেঁচে থাকার অধিকারটুকু পর্যন্ত কেড়ে নিচ্ছেন৷ কংগ্রেস মুক্ত ভারত করতে গিয়ে এরা টাকার  বিনিময়ে ছাগল গরুর মত এম.এল.এ,/এম.পি কিনতে হাজার কোটি টাকা জলের মতো খরচ করেছে৷ অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানের খাতে ব্যয়ের কোনো সীমা নেই৷ আজ টাকা-পয়সা ছড়িয়ে ভোট কুড়িয়ে বাঙলা জয়ের স্বপ্ণ দেখছেন৷ অথচ সাধারণ নাগরিকদের জন্যে স্থায়ীভাবে কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা করেনি৷ একটা কথা মনে রাখবেন---সিরাজউদ্দৌলার উশৃঙ্খলতায় একসময় মুর্শিদাবাদের মেয়েরা ঘরের বাইরে  বের হতে ভয় পেত৷ আর জাফর আলী খাঁ (মীরজাফর) নিষ্ঠাবান মুসলিম ছিলেন৷ তবু ইতিহাসের পাতায় সিরাজের আসন গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকায় উজ্জ্বল, আর মীরজাফরকে  মানুষ আজও ঘৃণা করে৷ কেন জানেন? সিরাজ দেশ ও বাঙালী জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি, বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন মীরজাফর৷