প্রকৃত আদিবাসী বা ভূমিপূত্র কারা?

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

বিগত শতকের প্রায় মধ্যভাগ থেকেই এরাজ্যে ‘আদিবাসী’  ‘ ভূমিপুত্র, ‘ইন্ডিজেনাম’ আর ‘উদ্বাস্তু বা রিফিউজি’, ‘বিদেশী’ বা ‘ফরেনার’ অনুপ্রবেশকারী বা ‘ঘুষ পেটিয়া,‘আশ্রিত’‘শরণার্থী’--- ইত্যাদি বিশেষণগুলো নিয়ে জল এতটাই ঘোলা হয়ে চলেছে যে, সেই ঘোলা জলরাশি যদি সবটাই রাজ্যের নদী-ছড়ায় বাহিত হয়ে গিয়ে  বঙ্গোপসাগরে তো বটেই, এমনকি ভারত মহাসাগরেও গিয়ে ঠাঁই নিত, তাহলেও বোধ হয়, উপসাগর কিংবা মহাসাগরের জলের রঙবদলও ঘটে যেতে পারত৷ আসলে, বর্ণহীন জল সে বরফগলা জলই হোক কিংবা বৃষ্টির জল, মাটিতে নেমে আসার পর গলিত মাটির ছোঁয়া লেগেই রঙধারণে বাধ্য হয়ে পড়ে৷ আর রঙযোগানো জলরাশির কিছুটা বাষ্পাকারে বায়ুতে উঠে যায় আর কিছুটা তলানিরূপে থেকে যায় বলেই হয়ত সাগর মহা সাগরের জলের রঙের বিকৃতি ঘটে না৷ প্রকৃত বিচারে ত্রিপুরার জল, পঃবাঙলা তথা ভারতের জল আর পাকিস্তান বা বাঙলাদেশের জল আর আরবের জল--- সব জায়গার জলরাশিই গিয়ে  যখন সমুদ্রে একসাথে মিশে যায় তখন সেটা সাগর,উপসাগর বা মহাসাগরের নামে নামাংকিত হয়ে পড়ে৷ কিন্তু একথাও ততোধিক যুক্তিসঙ্গত যে উপসাগর, সাগর ও মহাসাগর ইত্যাদি সমস্ত পৃথিবীরই জলরাশি একইসূত্রে গাঁথা---প্রতিটির সঙ্গে প্রত্যেকটি অচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত রয়েছে আর তার একটাই পরিচিতবোধক সঙ্গত নাম--- জল৷

তদ্রূপ, বাঙলার মানুষ, ত্রিপুরার মানুষ, ভারতের মানুস ইংল্যাণ্ডের, জাপানের,ইরানের কিংবা গ্রীণল্যাণ্ডের আয়ারল্যাণ্ডের ইত্যাদি পৃথিবীর সমগ্র মানুষ প্রজাতির একটাই সাধারণ পরিচিতি ও জ্ঞাপক নাম--- মানুষ৷ বাংলার কবি আমাদের শিখিয়েছেন---

‘‘জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে

সে জাতির নাম মানুষজাতি’’

তাই, দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের রচিত সামাজিক-অর্থনৈতিক তত্ত্ব ‘প্রাউট’-এ দৃষ্টিতে ‘মানুষ মানুষ ভাই-ভাই উঁচু-নীচু  বিভেদ নাই৷’ এজন্যেই প্রাউটিষ্টরা সরব প্রচার চালান---সব মানুষের এক জাত’ ওসব মানুষের ধর্ম এক’৷ আবার, প্রাউট প্রবক্তার দর্শনেও তাই বলা রয়েছে৷ ‘মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্য৷

প্রাকৃতিক কারণে যতই তারতম্য দেখা যাক না কেন একথাও অনস্বীকার্য যে মূলতঃই মানুষের অজ্ঞতা, কূপমন্ডুকতা আর বুদ্ধি বিচারশক্তির দুর্বলতার কারণে সমাজেরই মুষ্টিমেয় অথচ ক্ষমতাশালী কায়েমী স্বার্থবাদী,ভোগবাদী,---পুঁজিবাদী ও জড়বাদীদেরই অদৃশ্য কারসাজিতে একমাত্র তাদেরই সমাজ শোষণের স্বার্থ বজায় রাখতে অচ্ছেদ্য বন্ধনে সম্পর্কিত মানুষে-মানুষে ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত অশিক্ষিত, সভ্য-অসভ্য, শাদা-কালো, পাহাড়বাসী-সমতলবাসী, জাতি-উপজাতি ইত্যাদি বিভাজন করে রাখা হয়েছে৷

বিগত কয়েক দশক ধরে ত্রিপুরা সহ উঃপূঃ ভারতে জাতি-উপজাতি সেন্টিমেন্টাল ভিত্তিতে আর দ্বিতীয়তঃ মূল অধিবাসী আর ‘বহিরাগত বা বিদেশী অথবা ইন্ডিজেনাশ বা আদিবাসী তথা ভূমিপূত্র আর বহিরাগত বা অনুপ্রবেশকারী--- ইত্যাদি নানারকমের স্পর্শকাতর ও অবজ্ঞাসূচক আর সুড়সুড়ি-দায়ক সেন্টিমেন্টের সহায়তায় মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে৷ তবে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ণ এসে যাচ্ছে--- কেন এই বিভাজন আর কারাই বা রয়েছে এর পেছনে৷ এক্ষেত্রে কেন বিভাজন? এই প্রশ্ণের উত্তর খুঁজে পেলে অতি সহজেই বোধ্যগম্য হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায় ‘কারা পেছনে?’’ ওই প্রশ্ণটির সঠিক জবাব অবশ্যই প্রকাশ পেয়ে যাবে৷ তাই উক্ত প্রশ্ণটির সঠিক উত্তরের জন্যে আমাদের একটু পেছনে তাকাতেই হচ্ছে৷

ইতিহাসে সাক্ষ্য মজুত রাখে যে, অতীতে ইউরোপীয় বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীদেরই সহ বেশ কিছু লুটেরা, শোষক  দস্যু-তস্কর ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী অশুভ শক্তিরা বাঙলার পথ ধরেই ভারতে প্রবেশের পথ খুঁজে পেয়েছিল৷  তাদেরও মধ্যে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোং-এর বণিকরা তাদেরই সেয়ানা গিরির দ্বারা বুঝে নিতে পেরেছিল সারা ভারতে বাঙালীরাই মস্তিষ্ক চালনায় অন্যান্যদের পেছনে ফেলে রেখেছে৷ অবশ্যই এর পেছনে যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান রয়েছে৷ সেসব নৃতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক কারণসমূহ এখানে আলোচ্য নয় বলে আপাততঃ সেগুলো ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না৷ ভারতে গান্ধীজির রাজনৈতিক গুরু মিঃ গোপালকৃষ্ণ গোখলেও এই সত্যটুকু বুঝতে পেরেই একবার মন্তব্য করেছিলেন ---‘‘বাঙালীরা আজ যে চিন্তাটা করছে, ভারতবর্ষ সেটি ভাবতে পারছে আগামীকাল আর গোটা পৃথিবীর লোকেরা তাও ভাবতে সক্ষম তারও পরের দিন’’--- এই বলে যা হোক সেয়ানা ব্রিটিশরা ভারতে  ইষ্ট ইন্ডিয়া কোং -এর মাধ্যমে বণিক সেজে এসে প্রধানতঃ বাঙলা বই পড়ে অবশেষে ‘বাইন্যাগিরি’ ছেড়ে অর্থাৎ নিছক লুটতরাজের কারবারের বদলে শোষনের সাম্রাজ্য-বিস্তারের মতলবে শাসনদণ্ডই হাতিয়ে নিতে পেরেছিলেন ১৭৫৭ সালে৷ তারপর ১৮৩৫ সাল নাগাদ লর্ড মেকলে নামক জনৈক সাদা সাহেবকে লন্ডন থেকে ভারতে পাঠানো হয়েছিল সরেজমিনে তদন্ত করে রিপোর্ট পাঠাতে এইমর্মে যে ভারতে ব্রিটিশ প্রভুত্ব কায়েম ও  নিষ্কন্টক রাখতে হলে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন৷ মেকলে তখন তিনটে সুপারিশ করেছিলেন যে (১) বাঙালীর শিক্ষা ও সংস্কৃতিককে ধবংস করে দিতে হবে৷ (২) বাঙালীর দেশপ্রেম ও সংহতি চেতনাকে ধূলিসাৎ করে দিতে তাদের আধ্যাত্মিক অনুশীলনকে বিনষ্ট করে দিতে হবে৷  (৩) বাঙালীর ঐক্যবোধকে গুঁড়িয়ে দিতে হবে বস্তুতঃ এই রিপোর্টমূলেই --- (ক) ব্রিটিশ শাসকদের ‘ডিভাইড এ্যাণ্ড রুল পলিশি’ (খ) ১৯০৫ সালে বঙ্গ বিভাগ (গ) ভারতের বুকে জাত-পাত বিচারের মূলে বাড়তি ইন্ধন যোগানো ও বিশেষ করে হিন্দু-মুসলিম কম্যুনাল ফীলিং ইত্যাদি ব্যবস্থাপনা চালু হয়েছিল৷ একই উদ্দেশ্যে বঙ্গদেশের দেহ-ব্যবচ্ছেদ ও অবশেষে ভারত-বিভাজন ঘটানো হয়েছিল, যার পরিণতি স্বরূপ আজ বাঙালীরা ভারতের বুকে ‘বিদেশী’ রিফ্যুজি, ডি-বোটার, ‘লাঞ্চিত’, ‘অপমানিত’ , ‘অচ্ছুৎ’, ও ‘ব্রাত্য’ বলেই নানাভাবে নির্যাতিত হয়ে চলেছেন৷ এর পেছনে বর্তমানে অন্যতম দায়ী বাঙালীর ঐক্য-চেতনা আর আত্মমর্যাদাবোধের নিদারুণ অভাব৷ এছাড়াও, বাঙালীদের নৈতিক মেরুদণ্ড দুর্বল হয়ে গেছে ও এই জনগোষ্ঠী তামসিকতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে বলেইে এত অবজ্ঞা, অবহেলা, শোষণ, নিপীড়ণ নির্বিবাদে সয়ে যেতে পারছ৷ তাইতো, আজ প্রশ্ণ উঠতেও পারছে---ত্রিপুরায় তথা উঃপূঃ ভারতের  মাটিতে  ‘আদিবাসী’ বা ‘ভূমিপুত্র’ কারা ইত্যাদি নিয়ে৷ সুতরাং এসব প্রশ্ণের সঠিক জবাব দিতে হলে প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিমান ও বিচারশীল মানুষমাত্রেরই ‘প্রধান কর্ত্তব্য’ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত প্রকৃত ইতিহাসকে জেনে নেওয়া ও সত্যের সন্ধানে নিজেদের অনুপ্রাণিত  করে তোলা৷          

  (পরবর্তী অংশ ৫ই ফেব্রুয়ারী---২০২১)