সেবামূলক আদর্শের রূপায়ণেই দধীচি দিবসের সার্থকতা

লেখক
প্রভাত খাঁ

আনন্দমার্গের ইতিহাসে জামালপুর, পটনা, রাঁচি, কলকাতা আর আনন্দনগর (পুরুলিয়ার বাগলতা) চিরস্মরণীয় হয়ে আছে ও থাকবে৷ আনন্দনগরের বুকে আনন্দমার্গের প্রবক্তা মার্গগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আনন্দমার্গ দর্শনের বাস্তবায়ন শুরু করেন৷

পৃথিবীর ইতিহাসে কোন মহান আদর্শ বিনা বাধায় প্রতিষ্ঠিত হয় নি৷ এই সত্য কথাটি আনন্দমার্গের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷ পাণ্ডব বর্জিত অখ্যাত গ্রাম পুরুলিয়া জেলার বাগলতা যেখানে দিনে শেয়ালের ডাক শোনা যেত সেই অতি দরিদ্র গ্রামের স্থানীয় কিছু মানুষ উদরের ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্যে এখানে ওখানে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত পশু শিকারের জন্যে বা ঘাসের বীজ সংগ্রহ করত সেই শ্মশান ডাঙ্গায়৷ মার্গগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী শত শত গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী–সন্ন্যাসিনীদ্ নিয়ে ও মার্গের গৃহী অনুগামীদের সহায়তায় বিশ্বের কল্যাণে এক সর্বানুসূ্যত আদর্শ আশ্রম গড়ে তোলেন অতি অল্প কয়েক বছরের মধ্যে আর স্থানটির নামকরণ করলেন ‘আনন্দনগর’৷ যাকে বলা যায় বিশ্বের কল্যাণের চক্রনাভি৷ কিন্তু সেই কল্যাণকামী কর্ম প্রচেষ্টা কিছু দুষ্কৃতীর কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে৷ তারা নব নির্মিত আশ্রমের চরম ক্ষতি সাধনের জন্যে ষড়যন্ত্র করে’ ১৯৬৭ সালের ৫ই মার্চ বেলা ১০টা নাগাদ আনন্দনগর কেন্দ্রীয় কার্যালয় আক্রমণ করে৷ এই ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে ছিল কমিউনিষ্ট দল (সিপিআই, সিপিএম) স্থানীয় বিডিও ও বালিগ্রামের কুখ্যাত ডাকাত দল৷ 

আগের দিন রাত ১টা নাগাদ জনৈক মার্গের সন্ন্যাসী আনন্দনগরের ডাক্তারবাবু প্রয়াত আচার্য শচীনন্দন মহাশয়ের বাসায় এসে সংবাদ দেন যে আগামীকাল আশ্রম আক্রান্ত হতে পারে কারণ পুন্দাগ স্টেশন থেকে আসার সময় স্থানীয় লোকেরা এ ব্যাপারে কানা–ঘুঁষো করছে আর সারা রাত ধরে নিষিদ্ধ দেশী মদ ও মাংসের ভোজের আয়োজন করেছে৷ পরের দিন স্টেশনের অদূরে যে রেল লাইন গেছে সেই লাইনের পাশে ও আশ্রমের সীমানায় দু’চার জন করে লোক জমায়েত হয়ে ওদের ডুগডুগি বাজিয়ে লোক জড়ো করতে দেখা যায়৷

মধ্য আনন্দনগর আশ্রমের কার্যালয়৷ ৫ই মার্চ সকালে সেদিকে তীর–ধনুক, ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একদল লোক চিৎকার করতে করতে এগিয়ে যায়৷ তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারী আচার্য অভেদানন্দ অবধূত তাঁদের আশ্রম এলাকায় চিৎকার করতে নিষেধ করেন৷ তারা অভেদানন্দ, আচার্য সচিদানন্দ অবধূত, আচার্য ভরতকুমার, আচার্য প্রভাস কুমার ও আচার্য অবোধ কুমারকে তীরের দ্বারা আহত করে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে৷ সংঘের সন্ন্যাসীরা হত্যাকারীদের তীরের আঘাতে আহত হন৷ এদিকে আশ্রম আক্রান্ত হওয়ার খবর থানায় দেওয়া হয়৷ অনেক পরে আশ্রমে পুলিশ আসে৷ এদিকে আনন্দনগরের  হাসপাতাল আক্রান্ত হয় ১টা নাগাদ৷ তার আগে ডাক্তারবাবুর পরিবারের সকলে মূল আশ্রমে চলে আসেন৷ কিন্তু ডাক্তারবাবু ডাক্তারখানায় থেকে যান৷ আক্রমণকারীরা এসে ডাক্তারখানা ও তাঁর বাসা লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়৷ তিনি উপায়ন্তর না দেখে মৃত্যু সুনিশ্চিত জেনেও বহু কষ্টে অনেক বাধা অতিক্রম করে ডাক্তার শচীনন্দনবাবু ছুটতে ছুটতে দীর্ঘ কাঁকুড়ে পথ অতিক্রম করে আশ্রমের দ্বারে পৌঁছে অজ্ঞান হয়ে যান৷ আশ্রমের ছোট ছোট পড়ুয়াদের একটি ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছিল যাতে তাদের কোন ক্ষতি না হয়৷

সারাদিন ও রাত্রি এক চরম আতঙ্কের মধ্যে কাটে আশ্রমবাসীদের৷ পরে সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীরা পুন্দাগ স্টেশনে এসে গাড়ি করে রাঁচি আশ্রমে চলে যান৷ এদিকে মার্গগুরু, মার্গমাতা ও তাঁদের শিশুপুত্রকে মোটর যোগে নিয়ে যাওয়া হয় রাঁচি আশ্রমে৷ ডাক্তারবাবু ও তাঁর পরিবারের লোকজনও রাঁচি চলে যান পরের দিন সকালে৷ আশ্রমের পড়ুয়ারা ও অন্যান্যরাও রাঁচিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়৷ নিহত অবধূতদের স্মরণে শোক মিছিল করা হয় রাঁচিতে৷ কিছুদিন পর আবার ধীরে ধীরে সকলে আনন্দনগরে ফিরে এসে আনন্দনগরকে নোতুন করে গড়ে তোলার কাজে মন দেন৷ পুরাণে বর্ণিত উপখ্যান অনুসারে বেত্রাসুরকে নিধন করার জন্যে মহামুনি দধীচি আত্মত্যাগ করেন৷ তাঁর হাড়ে যে বজ্র তৈরী হয় সেই বজ্রেই ইন্দ্র ভয়ঙ্কর অসুরকে  নিধন করেন৷ জগৎ কল্যাণে পাপ শক্তিকে ধবংস করতে ধর্ম ও সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্যে আনন্দনগরের বুকে তরতাজা পাঁচটি লাল গোলাপের মতো পবিত্র সন্ন্যাসী প্রাণ দিয়ে ৫ই মার্চ ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন৷ তাঁরাও সেই মহান দধীচির মত৷ আনন্দমার্গের মহান আদর্শ, মানব ধর্মের বিস্তার ঘটাতে ও আনন্দনগরকে দানবদের হাত থেকে রক্ষা করতে সেদিন ওই পঞ্চ মহান দধীচি দেহত্যাগ করেন৷ আনন্দমার্গের ইতিহাসে ওই দিনটিকে তাই দধীচি দিবস হিসাবেই স্মরণ করা হয়ে থাকে প্রতি বছর৷ সারা পৃথিবীর আনন্দমার্গের সন্ন্যাসী–সন্ন্যাসিনী ও গৃহী অনুগামী ভক্তগণ এদিন সকাল হতে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত কোন খাদ্য ও জল গ্রহণ না করে উপবাসের মধ্য দিয়ে তাঁদের শ্রদ্ধায় স্মরণ করে থাকেন৷ সেই দধীচিদের আত্মত্যাগ সফল হোক, পৃথিবীর বুকে ন্যায়, সত্য ও ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হোক এটাই কাম্য৷ স্মরণে থাকে যে স্থানীয় থানা পাঁচজন সন্ন্যাসীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনার এফ আই আর নেয় নি ও হত্যা মামলা রুজু করে নি৷ আহত প্রত্যক্ষদর্শী সন্ন্যাসীরা মহামান্য আদালতে আবেদন করে মামলা রুজু করেন৷ কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা পুরুলিয়া কোর্টে এই মামলার বিচারে বাধা প্রদান করে৷ তাই এই মামলার ন্যায় বিচারের জন্যে মেদিনীপুর সেসনকোর্টে স্থানান্তরিত করা হয়৷ সেখানে বাগলতার স্থানীয় বিডিও সহ আরও ১৮ জন দুষ্কৃতির বিচারে শাস্তি হয়৷ মহামান্য বিচারপতি আশ্রমে পুলিশী নিষ্ক্রিয়তা ও সরকারী কাজে অবহেলার তীব্র সমালোচনা করেন৷ মহান সন্ন্যাসীরা আদর্শের জন্যে আত্মত্যাগ করে আনন্দনগরের আশ্রমের মহান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে রক্ষা করে জানান দিয়ে যান যে, আনন্দমার্গের অনুগামীরা যেন আনন্দনগরের আশ্রমের জনসেবামূলক কাজকে ত্বরান্বিত করে মার্গগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সার্থক করে জগৎ কল্যাণে ব্রতী হন৷