সমাজ বাস্তবতা ও প্রাউট

লেখক
সুকুমার সরকার

(এক)

সমাজ এক গতিশীল বিষয়৷  এই গতি সতত পরিবর্তন শীল ও ক্রমোন্নতির দিকেই ধাবিত হয়৷ তবে সেই ধাবমানতার  পিছনে  সর্বদা কোনো  একজন বা অনেক দার্শনিকের  দর্শন দিশার অবদান থাকে৷ দর্শন দিশাও যদি প্রগতিশীল না হয় সেই সমাজও হাজারো কুসংস্কারের শৈবাল দামে বাঁধা পড়তে থাকে৷ আর তাতে জন্ম নেয় পঙ্কিল আবর্ত৷ সমাজে নেমে আসে শোষণ,ত্রাষণ৷ সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে ওঠে ওষ্ঠাগত প্রাণ৷ আজ পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র ভারতবর্ষে চাকরি দুর্নীতি সব এই যে এতো কেলেঙ্কারি,এই যে এতো শোষণের চিত্র এসব তারই বিষফল৷ এই বিষফল নিয়ে আমরা নির্র্বেধরা চায়ের আড্ডায় মেতে আছি৷ অফিস-আদালতে কাজকর্ম শিকেয়  তুলে এই বিষফলের চর্চা করছি৷ টিভির পর্দায় বুলবুলির লড়াই  করছি৷ কিন্তু প্রতিকারের জন্য কেউ এগিয়ে আসছি না৷ কিংবা এটাও বুঝতে পারছি না এই বিষফল আসলে ভুল রাষ্ট্রদর্শনের  বিষবৃক্ষ থেকে উৎপন্ন৷ আমাদের ভুল চিন্তার ফসল৷ সুতরাং আমাদের চিন্তা ও রাষ্ট্রদর্শন বদলাতে হবে৷ এ ব্যাপারে অকারণ তত্ত্বের কচকচানি করে লাভ নেই৷ সমাজবাস্তবতা আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে প্রগতিশীল কোনো রাষ্ট্রদর্শনের সহায়তা ছাড়া মানুষের মুক্তির অন্য কোনো পথ নেই৷ সমাজ বাস্তবতায় বর্তমানে আমরা বাস করছি পুঁজিবাদী সহায়ক বিরাট এক  ডিজিটাল সরীসৃপ দানবের পেটে৷ আমাদের প্রগতিমুখী সকল সমাজ আন্দোলনকে সেই ডিজিটাল দানব গিলে খেয়ে বসে আছে৷ আমাদের সকল চলা বলা এখন সেই ডিজিটাল সরীসৃপ দানবের পেটের ভেতর৷ আমরা চাইলেই খুব সহজে সেই ডিজিটাল সরীসৃপ দানবের পেটের ভিতর থেকে  বেরিয়ে আসতে পারবো না৷ কেননা, এই ডিজিটাল সরীসৃপ দানবও আসলে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রদর্শনের ফসল৷

এখন, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রদর্শনের বিপরীতে একসময় যে সাম্যবাদী রাষ্ট্রদর্শন এসেছিল সেই সাম্যবাদী রাষ্ট্রদর্শনের তত্ত্বগত কিছু ভুল ও প্রায়োগিক কিছু ভুলের জন্য দাঁড়াতে পারেনি৷ পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী থাবার কাছে তা বিলুপ্তির পথে৷ কিন্তু সাধারণ মানুষের সার্বিক কল্যাণ করতে গেলে সমাজ-রাষ্ট্রকে তো সমাজতন্ত্র সহায়ক কোনো না কোনো প্রগতিশীল রাষ্ট্রদর্শনের  সহায়তা নিতেই হবে ৷ এর বিকল্প কিছু নেই৷ এর বিকল্প সমস্ত চিন্তা হাজারো পার্থ অনুব্রতদের জন্ম দেবে, নরেন্দ্র মোদী  মেহুল চোক্সিদের জন্ম দেবে৷ আদানি আম্বানিদের টাকার পাহাড় জমবে৷  সেই হিসেব  কষে রাষ্ট্র নেতারা বাহবা কুড়াবেন৷ আর  সাধারণ মানুষের জন্য জুটবে দু’টাকা কিলো ভিক্ষার অন্ন, আর সংরক্ষণের চরণামৃত৷ ভিক্ষার সেই অন্ন আর সংরক্ষণের চরণামৃত পান করে সাধারণ মানুষ বেহুস হয়ে পড়ে থাকবেন৷ আর আমাদের মতো বোকা বুদ্ধিজীবীরা তত্ত্বের কচকচানি করতে  থাকবো৷ প্রতিকারের জন্য নোতুন কোনো প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের খোঁজ করে সমাজ-রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কথা কেউ বলবো না৷ আসলে আমরা নিজেরাও পুঁজিবাদীদের ওই ডিজিটাল সরীসৃপ দানবের পেটের মধ্যে ঢুকে গেছি৷ বেরিয়ে আসার জন্য সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক সাধনার পথ বেছে না নিয়ে স্থূল ও পরস্পর বিরোধী প্রথা-পদ্ধতি নিয়ে মেতে আছি৷ এর থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে৷ একজন সাধারণ কলমচি হিসেবে একুশ শতকের নোতুন পৃথিবীর জন্য আগত নোতুন সেই প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বের দর্শন দিশার কথাটিও বলে যেতে চাই৷ প্রগতিশীল সেই উপযোগ তত্ত্বেরই সংক্ষিপ্ত নাম প্রাউট৷ বর্তমান সময়ের সমাজ বাস্তবতার সকল অচলবস্থা দূর করতে পারে এই প্রাউট দর্শন৷ প্রাউট PROUT) কথাটির পুরো অর্থ হলো প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব Progressive Utilization Theory)৷ প্রাউট একুশ শতকের নোতুন পৃথিবীর জন্য নব্যফলিত ও সর্বানুসূ্যত একটি জীবনাদর্শ৷ এই দর্শনের প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম তিনি এই প্রাউট দর্শন দেন তাঁর ‘‘আইডিয়া এণ্ড আইডোলজি’’ গ্রন্থে৷  ব্যাষ্টিক পুঁজিবাদ Capitalism) ও রাষ্ট্রীক পুঁজিবাদCommunism) এর বিপরীতে তাঁর ‘‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’’(Progressive Utilization Theory) একটি সমসমাজ তত্ত্ব Progressive Socialism) নামে পরিচিত হতে থাকে৷ পরবর্তীকালে তিনি তাঁর ‘‘আনন্দসূত্রম’’ গ্রন্থে পাঁচটি মূল সিদ্ধান্তের  ওপর এই দর্শনকে  দাঁড় করান৷ বিশ্বের সকল সম্পদের  সর্র্বধিক  উপযোগ গ্রহণ ও তার যুক্তিসঙ্গত বন্টন ‘‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’’-এর মূল লক্ষ্য৷ এই তত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে পাঁচটি মূল সিদ্ধান্তের ওপর৷  সিদ্ধান্তগুলি হলো

এক--- কোনো ব্যষ্টিই সমবায়িক সংস্থার Collective body) সুস্পষ্ট অনুমোদন ছাড়া ভৌতিক সম্পদ সঞ্চয় করতে পারবে না৷

দুই---বিশ্বের যাতীয় জাগতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করতে হবে ও যুক্তিসঙ্গত বন্টন করতে হবে৷

তিন--- মানব সমাজের মধ্যে ব্যষ্টিগত ও সমষ্টিগতভাবে  যে আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদ মজুদ আছে তার সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ কপতে হবে৷

চার--- এই জাগতিক , মানসিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদ সমূহের মধ্যে যথাযথ সন্তুলন থাকা অবশ্য প্রয়োজনীয়৷

পাঁচ--- দেশ, কাল ও পাত্রের পরিবর্তন অনুযায়ী সমগ্র উপযোগনীতির পরিবর্তন হতে পারে, আর তা উপযোগ হবে প্রগতিশীল স্বভাবের ৷ (ক্রমশঃ)