সুগভীর ষড়যন্ত্রের শিকার বাঙালী

লেখক
মনোজ দেব

দীর্ঘ ৭৫ বছরের স্বদেশী শাসনে বাঙলার সমাজ জীবনের সর্বস্তরে---তার ধর্ম সাধনায়, তার কর্ম সাধনায়, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি অর্থনীতি সর্বস্তরে আজ বহিরাগত অশ্লীল অসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বাঙালীর সমাজ জীবনে অতি নিম্নমানের পরিবর্তন এনেছে৷ তার রুচিতে, তার চালচলনে, আচার-আচরনে, ব্যবহারে তারি প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে৷

আসলে স্বাধীনতার প্রথম ক্ষণ সেই মধ্যরাতের  অন্ধকার  থেকেই বাঙালীর জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্র্ভাগ্য৷ এই দুর্ভাগ্য বাঙালীর স্বরচিত নয়, দেশভাগ, লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সামাজিক অস্থিরতা এর কোনটির জন্যই  বাঙালী দায়ী নয়৷ স্বাধীনতার জন্য যার আত্মত্যাগ সবথেকে  বেশি, সেই বাঙালীকে এই দুর্র্ভাগ্য স্বদেশী শাসক ও পুঁজিপতি শোষকদের দেয়া স্বাধীনতার উপহার৷ বাঙালীকে এই পথে আসতে বাধ্য করেছে বিদেশী ও স্বদেশী শাসক, স্বদেশী পুঁজিপতি গোষ্ঠী ও তাদের অর্থেপুষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো৷ যাদের লক্ষ্য বাঙলার সম্পদে পশ্চিম ভারতকে সমৃদ্ধ করা ও বাঙালী জনগোষ্ঠীকে বিলুপ্ত করা৷

স্বাধীন ভারতে বাঙালী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এ এক সুগভীর ষড়যন্ত্র৷ বাঙালীকে ভাগ করো, দুর্বল করো, তার সম্পদ লুণ্ঠন কর এই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নীতি৷ দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে স্বাধীন ভারতে স্বদেশী শাসক ও স্বদেশী পুঁজিপতি গোষ্ঠী এই ব্রিটিশ নীতি অনুসরণ করে চলেছে৷

১৯৪৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় এই ব্রিটিশ অস্ত্র দিয়েই কংগ্রেসের তৎকালীন নেতৃত্বের ক্ষমতালোভ ও দুর্বল মানসিকতার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতার প্রলোভন দেখিয়ে দেশকে খণ্ডিত করে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারত ছেড়ে চলে যায়৷ দেশভাগের সেই চরম কুফল আজ শুধু বাঙালী জনগোষ্ঠীকেই ভোগ করতে হচ্ছে৷ ব্রিটিশ ভারতে বাঙলার সম্পদ লুন্ঠন হয়ে চলে যেত লণ্ডন, ম্যানচেষ্টারে৷ আজ সেই সম্পদ লুন্ঠন হয়ে যায় মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থানে৷ সেদিন বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন---‘রেজা খাঁ টাকা আদায় করে আর ডেসপ্যাচ লেখে, বাঙালী কাঁদে আর উচ্ছন্নে যায়৷’ আজ  লিখতে হচ্ছে, বাঙালী ভাতৃঘাতী লড়াই করে মরে, আর বাঙলার সম্পদে গুজরাট রাজস্থানের  মরুভূমি শ্যামলী হয়ে ওঠে৷ স্বাধীন ভারতে বাঙালী আজ স্বদেশী শাসক ও শোষকের শোষনে জর্জরিত৷

সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতির পদত্যাগ করার পর বিশ্বকবি সুভাষচন্দ্রকে তাঁর ঐতিহাসিক পত্রে লিখেছিলেন---‘‘সুভাষচন্দ্র, বাঙালী কবি আমি বাঙলাদেশের  হয়ে তোমাকে  দেশনায়কের  পদে বরন করি৷’’ ওই পত্রেই কবি লিখেছেন---‘‘হিংস্র দুঃসময়ের পিঠের ওপর চড়ে বাঙালীকে বিভীষিকার পথ উত্তীর্ণ হতে হবে.. আত্মীয় ও পরের হাতে বাঙালীকে অশেষ লাঞ্ছনা ভোগ করতে হবে৷ সেদিন বাঙলার রাজনৈতিক নেতারা এই পত্রের মর্ম উপলব্ধি করতে পারেন নি৷ তারই মাসুল আজ বাঙালীকে গুনতে হচ্ছে৷

আজ পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতি দুর্নীতি এমন চিৎকার হচ্ছে যেন স্বাধীন ভারতে কোন একটি রাজ্যে এই প্রথম দুর্নীতির সন্ধান  পাওয়া গেল৷ এই অবোধ বালকেরা (বয়সে নয় মানসিকতায়) জানে না স্বাধীন ভারতের জন্মই হয়েছে মধ্যরাতের  অন্ধকারে দুর্নীতির আঁতুড় ঘরে৷ বাঙলার প্রতি স্বদেশী শাসকের শোষণ ও বঞ্চনার শুরু ওই মধ্যরাতের অন্ধকার থেকেই৷ এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রথম কলম ধরেন সেই সময়ের বিখ্যাত সাংবাদিক রঞ্জিত রায় আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর তখনকার ইংরাজি সংকলন হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রবন্ধ লিখে৷ পরবর্তীকালে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়---The agony of West Bengal.‘‘বাংলায় প্রকাশিত হয়---‘‘ধবংসের পথে পশ্চিমবঙ্গ’’৷ এই পুস্তকের ভূমিকায় লেখা হয়েছে৷--- ‘‘ব্রিটিশ আমলে ভারতের অধঃপতনের কারণ অনুসন্ধান করে এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছিলেন---’’ ব্রিটিশরা যে অর্থনৈতিক নীতি প্রয়োগ করেছে তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম ভারতের দারিদ্র্য৷ এই নীতির ফল অন্যপ্রকারের হলে তা হতো অলৌকিক৷ পৃথিবীতে অলৌকিক কিছু ঘটে না৷

ব্রিটিশের অধীনে ভারতের অবনতির যেসব কারণ রমেশচন্দ্র দত্ত দেখিয়েছেন, স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গ তথা পূর্ব ভারতের অবনতির কারণ তার থেকে কিছু স্বতন্ত্র নয়৷  পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি তছনছ হয়ে গেছে৷

তছনছ করে দেয়া হয়েছে৷ পশ্চিম বাঙলার বর্তমান সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক দুর্দশা ও দুর্নীতির মূলে আছে কেন্দ্রীয় শাসকের বাঙালী বিদ্বেষী শাসন নীতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি৷

নেতাজী আতঙ্কে স্বাধীনতার প্রথম দুই দশক দেশের শাসক বিরোধী সব গোষ্ঠী গোপন বোঝাপড়া করে চলেছে৷ কারণ এরা সবাই সেদিন দেশ ও সুভাষচন্দ্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল৷ তাই সুভাষচন্দ্রের দেশে ফেরার আতঙ্কে এরা আতঙ্কিত ছিল৷ আর বাঙলার শাসক গোষ্ঠী দিল্লির প্রতি আনুগত্যের কারণে ও ক্ষমতা হারাবার ভয়ে দিল্লির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি৷

ধবংসের পথে পশ্চিমবঙ্গ পুস্তকে লেখা হয়েছে৷---‘‘স্বাধীনতার প্রথম দিনটিতেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার  আবিষ্কার করে যে পূর্ব-রাত্রে ঘড়িতে বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার পাটজাত পণ্যের রপ্তানি শুল্ক থেকে পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্য অংশ এককোপে ছেঁটে ফেলেছে৷ পশ্চিমবঙ্গের প্রতি দ্বিতীয় আঘাতও হানা হলো সেই রাতেই আয়কর বিভাজ্য তহবিলে পশ্চিমবঙ্গের হিস্যা বিশ শতাংশ থেকে কমিয়ে করে দেয়া হলো ১২ শতাংশ৷ অথচ বোম্বাইয়ের (অবিভক্ত গুজরাট মহারাষ্ট্র)হিসসা কুড়ি শতাংশ থেকে  বৃদ্ধি করা হলো একুশ শতাংশ৷৷ বিধানচন্দ্র রায় মিন মিন  করে কিছু প্রতিবাদ করে নীরব হয়ে গিয়েছিলেন৷ তার কাছে বাঙলার স্বার্থ অপেক্ষা কংগ্রেসের প্রতি ও নেহেরুর প্রতি আনুগত্যই বড় ছিল৷ রঞ্জিত রায় লিখেছেন--- ‘‘বিধানচন্দ্র রায় থাকা সত্ত্বেও ১৯৬২ সালে তার মৃত্যুর বহু পূর্ব থেকেই অবনতি শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে৷’’

আজ যে সব বিরোধী নেতারা পশ্চিমবঙ্গ গেল গেল চিৎকার করছে দশ বছরের তৃণমূলের শাসনে তারা কিন্তু স্বাধীনতার পর এই পশ্চিমবঙ্গে শাসন করেছে ৬৫ বছর৷ রঞ্জিত রায়ের ‘‘ধবংসের পথে পশ্চিমবঙ্গ’’ বিখ্যাত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহর ‘‘ভাবার সময়’’ সেই সময়ের যুগান্তর পত্রিকার সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যের ‘‘বাঙালী কোথায়’’ পুস্তকগুলি পশ্চিমবঙ্গের অবনতির যেসব কারণ তুলে ধরেছেন তার সবটাই ৬৫ বছরের শাসনে৷৷ আজ তারা সুযোগ বুঝে নিজেদের অপদার্থতার ও দিল্লির চাটুকারিতার ইতিহাস ঢাকতে সব দায় বর্তমান শাসক দলের ঘাড়ে চাপিয়েছে৷ তারা ভুলে গেছে, বর্তমান শাসক দল তাদেরই কলম কাটা চারা৷ এই রাম বাম ডান স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেদের বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস আড়াল করতে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষ চন্দ্রের সংগ্রাম ও অবদানের ইতিহাসকেই কৃষ্ণগহ্বরে পাঠিয়ে দিয়েছে৷ তাই শুধু এই দশ বছরের শাসন নয়, ৭৫ বছর ধরে বাঙলাকে তিলে তিলে ধবংস করার ষড়যন্ত্র করে চলেছে দিল্লির শাসক দল৷ আর তাদের উচ্ছিষ্টভোগী বাঙলার নেতারা নীরব থেকেছে, আর নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী রাজনীতি করে চলেছে৷ আসলে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদী আন্তর্জাতিকতাবাদী সবার টিকি বাঁধা আছে ওই বাঙালী বিদ্বেষী দেশীয় পুঁজি প্রতি গোষ্ঠীর হাতে৷ তাই শোষক শাসক ও পুঁজিপতি গোষ্ঠীর সুগভীর ষড়যন্ত্রের শিকার আজ বাংলা ও বাঙালী৷