দ্বিতীয় বার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া ইস্তক একের পর এক হুঙ্কার ছেড়েছেন রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প, যার নবতম সংযোজন হল জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বিলোপ৷ যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে এর উল্লেখ রয়েছে৷ বিশেষজ্ঞদের অবশ্য দাবি, এই নিয়মকে ঠান্ডা ঘরে পাঠাতে হলে সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন৷ সেই জটিল আইনি প্রক্রিয়া সামলানো ট্রাম্পের পক্ষে মোটেই সহজ নয়৷ চলতি বছরের ৮ ডিসেম্বর ‘এনবিসি নিউজ’-এর ক্রিস্টেন ওয়েলকারের সঙ্গে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে যোগ দেন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প৷ সেখানেই আগামী চার বছরের কাজের রূপরেখা তুলে ধরেন তিনি৷ এর মধ্যে ছিল বেআইনি অনুপ্রবেশকারী, অভিবাসীদের অন্য দেশে স্থানান্তর এবং জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব আইনের বিলুপ্তি৷ পাশাপাশি, উন্নত আমেরিকার ‘স্বপ্ণ দেখা’ তথাকথিত অভিবাসীদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ একটি চুক্তি করার কথাও বলেছেন তিনি৷ আমেরিকার সংবিধানে জন্মসূত্রের নাগরিকত্বকে বলা হয় ‘জুস সোলি’৷ এটি প্রকৃতপঙ্েক্ষ একটি ল্যাটিন শব্দ৷ যার অর্থ হল ‘মাটির অধিকার’৷ যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বলা হয়েছে, সেখানে জন্ম নেওয়া প্রতিটা শিশুকে স্বাভাবিক ভাবে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে৷ শিশুটির মা-বাবা অন্য দেশের নাগরিক হলেও সে জন্মসূত্রে আমেরিকার নাগরিকত্ব পাবে৷ ১৮৬৮ সালে ১৪তম সংশোধনীতে এই জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ ওই সময়ে সদ্য গৃহযুদ্ধ কাটিয়ে উঠেছিল আমেরিকা৷ সংশোধনীটিকে ১৮৫৭ সালের ‘ড্রেড স্কট সিদ্ধান্ত’কে পুরোপুরি নস্যাৎ করে দেয়৷ যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে যা ছিল ঐতিহাসিক এবং যুগান্তকারী ঘটনা৷ আফ্রিকা থেকে আসা ড্রেড স্কট ছিলেন একজন ক্রীতদাস৷ আমেরিকার উইসকনসিন এলাকায় স্ত্রী হ্যারিয়েট এবং দুই মেয়ে এলিজা ও লিজির সঙ্গে থাকতেন তিনি৷ নিজে ও পরিবারের সকল সদস্যের স্বাধীনতার জন্য একটা সময়ে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন তিনি৷ যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ওই মামলা ‘ড্রেড স্কট বনাম স্ট্যান্ডফোর্ড’ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে৷
চতুর্দশ সংবিধান সংশোধনে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব চালু হলে আফ্রিকা-সহ বিশ্বের অন্য দেশের অভিবাসীদের সন্তানেরা স্বাভাবিক ভাবে আমেরিকার নাগরিকত্ব পেতে শুরু করে৷ পরবর্তী দশকগুলিতে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট একাধিক বার জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব আইনের উল্লেখ করেছে৷ উদাহরণ হিসাবে ১৮৯৮ সালের আমেরিকা বনাম ওং কিম আর্ক মামলার কথা বলা যেতে পারে৷ রায়ে মা-বাবা অভিবাসী অবস্থান নির্বিশেষে যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারীরা দেশটির নাগরিক হবে বলে স্পষ্ট উল্লেখ করেছিল সে দেশের সর্র্বেচ্চ আদালত৷
এই জটিল নিয়মে আমেরিকার কংগ্রেসে ট্রাম্পের নাগরিককত্ব সংশোধনী আইন পাশ হলেও তা আদালতে চ্যালেঞ্জ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ ১৮৯৮ সালের আর্ক মামলার রায়ে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকারকে মান্যতা দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট৷ ফলে ট্রাম্পের জমানায় তা বাতিল হবে, এমনটা ভাবা খুবই কঠিন৷ তবে শপথ নেওয়ার পর বেআইনি ভাবে অনুপ্রবেশকারীদের দেশছাড়া করতে ট্রাম্প যে উদ্যোগী হবেন, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই৷ অভিবাসীদের একটা বড় অংশকেও দেশত্যাগে বাধ্য করতে পারেন তিনি৷ এই কাজের জন্য কুর্সিতে বসেই ট্রাম্প জরুরি অবস্থা ঘোষণা করবেন বলে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে আতঙ্ক রয়েছে৷ এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘‘এমন অনেক শিশু রয়েছে, যাদের বিভিন্ন ভাবে আমেরিকায় নিয়ে আসা হয়েছে৷ তারা এ দেশেই বড় হয়েছে বা হচ্ছে৷ আমাদের দেশের জন্য ভাল কিছু করার ইচ্ছা রয়েছে তাদের৷ এই নিয়ে স্বপ্ণ দেখছে তারা৷ রিপাবলিকানরা কখনই তাদের পাশ থেকে সরে যাবে না৷’’ চলতি বছরের নভেম্বরে হওয়া আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অন্যতম বড় ইস্যু ছিল অভিবাসী সমস্যা৷ ভোটের প্রচারে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের দেশছাড়া করার প্রতিশ্রুতি দেন ট্রাম্প৷ তাঁদের জন্যেই দেশে মৌলবাদ ছড়াচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি৷ কুর্সি পেয়ে সেই কাজ করতে গিয়ে নাগরিকত্ব আইনে বদল আনতে চান বলে এ বার স্পষ্ট করলেন বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা৷