অগ্ণিযুগের ঐতিহাসিক চিঠি

সংবাদদাতা
পথিক বর
সময়

অদৃষ্টের পরিহাস ভূপেনবাবু! আমার রিভালবার ঠিকমত সাড়া দিলে আমাকে আজ এখানে এ অবস্থায় দেখতে পেতেন না৷ কাহিনী তাহলে অন্যরকম হ’ত’৷ কথাগুলি বলেছিলেন পরাধীন ভারতবর্ষের  অগ্ণিযুগের বাঙলার দামাল ছেলে প্রদ্যুৎ কুমার ভট্টাচার্য---বিদেশী ব্রিটিশ শাসকের স্বদেশী দালাল ভূপেন দাড়োগাকে৷ ১২ই জানুয়ারী ১৯৩৩ প্রদ্যুতের ফাঁসী হয়েছিল মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ডগলাস হত্যার অপরাধে৷ সবে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন আঠের বছরের তরুণ প্রদ্যুৎ৷ পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন এগুলিও গুলে খেয়েছিলেন এই বয়সেই৷ আজ বাঙলায় প্রদ্যুতের মত আদর্শপ্রাণ, আত্মত্যাগী তরুণের খুব একটা দেখা না পাওয়া গেলেও ভূপেন দারোগার মত দালাল রাজনীতির অঙ্গনে অনেক আছে৷ ফাঁসীর পূর্বে তরুণ প্রদ্যুৎ তাঁর মায়ের প্রতি অন্তহীন শ্রদ্ধার নির্দশন রেখে যায় একটি ঐতিহাসিক পত্রে৷ এই পত্রটি তিনি লিখেছিলেন মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে সাম্রাজ্যবাদী শাসকের বিচারের প্রহসনে প্রাণদণ্ডের আদেশ পাওয়ার পর৷

মাগো,

আমি যে আজ মরণের পথে আমার যাত্রা শুরু করেছি তার জন্য কোন শোক কোরো না৷ আর আমার ভাইদের বোলো যে, আমি আমার অসমাপ্ত কাজের ভেতর আমার হৃদয় রেখে গেলাম৷ আমার জন্য দু’দিন চোখের জল ফেলে ভুলে যাওয়ার চেয়ে আমার সেই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে চেষ্টা করলে আমার ঢের বেশী তর্পন করা হবে এবং  আমার আত্মাও বেশী পরিতৃপ্ত হবে৷ আজ যদি কোন ব্যারামে আমায় মরতে হোত তবে কি আপশোষই না থাকত সকলের মনে! কিন্তু আজ একটা আদর্শের জন্য প্রাণ বিসর্জন করছি৷ তাতে আনন্দ আমার মনের কানায় কানায় ভরে’ উঠেছে, মন খুশীতে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে৷ ফাঁসীর কাঠটা আমার কাছে ইংরেজের রসিকতা বলে মনে হচ্ছে৷ আমার এই অন্তরের কথাটা তোমারই অন্তরের প্রতিধবনী৷ .....আমি চিরদিনই জানি যে, আমি বাঙালী আর তুমি বাঙলা৷ একই পদার্থ কোনদিন আলাদা করে ভেবে উঠতে পারি নি৷ তাই কোন বিপদাশঙ্কাই আজ আমাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি৷ যুগ যুগ ধরে তুমি যে অপমান, লাঞ্ছনা ও নির্যাতন সহ্য করে এসেছো, মাটিতে মুখ থুবড়ে বোবা গোরুর মত মার খেয়েছো, তারই বিরুদ্ধে  তোমার মনে যে বিদ্রোহের ধারা অন্তঃসলিলা ফল্গুর মত বয়ে যাচ্ছিল, সেই পুঞ্জীভূত বিদ্রোহ-ই আমি৷  সেই বিপ্লব আজ যদি আত্মপ্রকাশ করে, তবে তার জন্য চোখের জল ফেলবে কেন? .... মানুষকে আমরা খুন করিনা, মানুষকে আমরা বাঁচাই৷ একথা বাঙলাদেশে এখনো বোঝানো হয়নি৷ বাঙলার বিপ্লবের ইতিহাস ক’দিনেরই বা! তাই আমাদের আদর্শ এখনও সাধারণ্যে প্রচারিত হয়নি৷ .....আমরা আজ যে আদর্শের সন্ধানে চলেছি তা অহিংসবাদীদের কল্পনারও অতীত৷ মানবের হিংস্রতা থেকে মানবকে রক্ষার করার জন্যেই আমাদের এই প্রয়াস৷ বাঙলার বিপ্লবের ইতিহাসটা প্রায় পঁচিশ বছরেরর শিশু৷ এখনো ভাল করে কথা বলতে শেখেনি৷ কিন্তু আজ এই শিশু কণ্ঠ হতে যে পাঞ্চজন্য শঙ্খ বেজে উঠেছে, তা শীগ্‌গিরই জগৎকে বিস্ময়ে স্তম্ভিত করে দেবে৷ .... বিপ্লব জিনিসটা কিছু আমাদের নয় কিন্তু মানবজাতিকে ধবংসের হাত হতে বাঁচানোর জন্য যুগে যুগে এটার প্রয়োজন হয়েছে৷ .... জীবনে অনেক আশাই ছিল যে, দেশের মধ্যেই আমার আদর্শটাকে অন্ত্রে অন্ত্রে ছড়িয়ে যাব, নবযুগের কুসংস্কারমুক্ত ভাব নিয়ে জাতিকে ও সমাজকে নব রূপ দেব, একেবারে আমূল সংস্কার করে একটা নব জাতি গড়ে রেখে যাব, সমস্ত আবর্জনা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে দিয়ে যাব৷ কিন্তু আশ্চর্য মানুষের জীবন! হঠাৎ একটা ডাক এল, আমাকে যেতে হ’ল৷  একথা মনেও স্থান দিও না মা, আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত চিন্তা বা আশাও লোপ পেয়ে গেল৷ সব রয়ে গেল আমার বাঙলার ছেলেমেয়েদের মনে আর আমার বাঙলার মায়েদের অন্তরে৷ বাঙলার ভূমি এত উর্বরা যে তার ফসল উপচে পড়ছে৷ এবৎসরে অঘ্রাণে যে ফসল অঙ্কুর হতে না হতেই শুকিয়ে গেল, আসছে  হেমন্তে সে দ্বিগুন হয়ে ফলে উঠবে৷ পরের ফসল দেশের মধ্যে সোনা ছড়িয়ে দেবে৷ তোমার কাছ থেকে বিদায় নেবার কিছুই নেই---এইটুকু শুধু বলছি, বড় হলে আরও ভাল করে বলতে পারতাম৷  কিন্তু আর কেউ এই একটু ‘মুখের কথা’ বলুক বা নাই বলুক তুমি কিন্তু সম্যকরূপে বুঝবে৷ কেননা, এটা তো তোমারই অন্তরের কথা৷ মা, তোমার প্রদ্যুৎ কি কখনো মরতে পারে! আজ চারিদিকে চেয়ে দেখ লক্ষ লক্ষ প্রদ্যুৎ তোমার দিকে চেয়ে হাসছে৷ আমি বেঁচেই রইলাম মা অক্ষয় অমর হয়ে৷ বন্দেমাতরম্‌!