আমার সন্তান যেন থাকে  দুধে ভাতে

লেখক
একর্ষি

পূর্ব প্রকাশিতের পর,

২) বিকেন্দ্রিত অর্থব্যবস্থার  দ্বিতীয় নীতি হল---উৎপাদনের  ভিত্তি হবে উপভোগ (কন্‌জাম্পশন্‌), মুনাফা (প্রফিট) নয়৷ কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তা হল মুনাফা ভিত্তিক অর্থনীতি, অর্থাৎ প্রতিটি অর্থনৈতিক ক্ষেত্র চলে মুনাফা লাভের জন্যেই, লক্ষ্য সর্র্বেচ্চ মুনাফা৷--- লক্ষ্যনীয়, মুনাফামুখী উৎপাদন ব্যবস্থায় কয়েকটি দিকের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ (অ) যারা মুনাফামুখী-উৎপাদক তারা সেই দ্রব্যের উৎপাদনকেই অগ্রাধিকার দেবে যার দ্বারা সর্বাধিক মুনাফা অর্জন করা যায়৷ এতে সাধারণ মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজনপূর্তির সুযোগ বা নিশ্চিততা থাকল কি থাকল না, সাধারণ মানুষ মরল না বাঁচল সেটা নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা থাকে না৷ (আ) এই যে সর্বাধিক মুনাফা মুখী বস্তুর উৎপাদন ---তাই নিয়েই উৎপাদকদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা চলে, চলে বাজার দখলেরও লড়াই৷ কার্যত, প্রতিযোগিতার বাজারে, সর্বাধিক মুনাফা পাওয়ার টাগ্‌ অব্‌ ওয়ারে মানুষের সামূহিক-প্রয়োজনপূর্ত্তিমুখী উৎপাদন, সর্বজনীন কল্যাণ উপেক্ষিতই থেকে যায়৷ আবার বাজার দখলের যে লড়াই -সেই লড়াই এর কেন্দ্রটাও ওই লাভের গুড়, অর্থাৎ সর্বোচ্চ মুনাফা৷ সর্বাধিক এই লাভের গুড় খেতে আড়ালে চলে বিকৃত কৃৎ-কৌশল কে কাকে পিছন থেকে ছুরি মেরে--- ল্যাঙ্‌ মেরে এগিয়ে যাবে৷ অর্থাৎ একটা  অসুস্থ প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণে---একছত্র আধিপত্রের বল্গাহীন সুপ্ত ও উপ্ত বাসনা তথা লোল-লালসা৷ ফলে  উৎপাদন-বন্টনের  নিয়ন্ত্রকের লড়াই-এ সেই ডারউইন-ভিউ, বোল্ড আউট সিম্বলিক্যাল ভিউ৷ ফলে মুনাফামুখী প্রতিযোগিতায় কেউ সাফল্যের  শিখরে  উঠে যাচ্ছে৷ যে বা যারা প্রতিযোগিতা হেরে গেল, নেমে গেল, বসে গেল---সে বা তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাথা তুলে দাঁড়াতে  পারে না, প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে এই ভয়ে তাদের উঠে  দাঁড়াতে দেয়া হয় না, তত্ত্বটা সেই আকাশের এক চাঁদের ---‘ও বেশী লাভ করলে বা থাকলে আমার মুনাফা কমে যাবে, অস্তিত্ব বিপন্ন হবে--- তাই এটা হতে দেয়া যায় না,  প্রতিপক্ষকে যেন কোনভাবে বসিয়ে দিতে হবে৷ ---নূ্যনতম প্রয়োজনে সবার সামূহিক উপভোগেই যে সামগ্রিক কল্যাণ---এখানে সে ঈপ্সা নেই৷ বলাবাহুল্য, ব্যষ্টি বা গোষ্ঠীর সংকীর্ণ স্বার্থের  কেন্দ্রীভূতকরণই বড় কথা৷ বিকেন্দ্রিত অর্থব্যবস্থায় তাই বোধ হয় একটা কথার চল আছে--- ‘লক্ষ্মী বড় চঞ্চলা’৷ লক্ষ্মী কখন যে কার ঘরে যায়, বোঝা বড় দায়৷ অথচ প্রচলিত তথা সব ধরণের  অর্থব্যবস্থাতেই ‘প্রতিযোগিতা’কে--- সাধারণভাবে  ভোগ্যদ্রব্যের গুণগত মানবৃদ্ধি, কর্মে দক্ষতা বৃদ্ধি ও উন্নয়নের  বড় উন্নয়নের বড় উদ্দীপক বা কৌশল হিসেবে স্বীকার করা হয়৷ তবে সে প্রতিযোগিতাকে হতে হবে  অবশ্যই মিত্রসুলভ সহযোগিতামূলক, ঈর্ষান্ধ---শত্রুভাবাপন্ন নয়৷

পক্ষান্তরে, বিকেন্দ্রিত অর্থব্যবস্থায় উৎপাদক ও উপভোক্তা উভয়পক্ষের  আর্থিক নিরাপত্তা ও নিশ্চিততা আসে এই ভাবে ---‘উৎপাদন ও বন্টন’ সর্বস্তরের মানুষের  উপভোগের জন্যেই হওয়ায়, অর্থাৎ উপভোগমুখী উৎপাদন ব্যবস্থায় ---যে কোন সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চলেরই সামূহিক-উপভোগমুখী উৎপাদিত দ্রব্য স্থানীয় বাজারেই বিক্রী হয়ে যাবে, অসুস্থ প্রতিযোগিতার কোন জায়গা প্রায় থাকবে না৷ চাহিদা-যোগানের এই হয়ে যাবে অসুস্থ প্রতিযোগিতার  কোন জায়গা প্রায় থাকবে না৷ চাহিদা-যোগানের এই ভারসাম্য পরিস্থিতির নীট ফল হচ্ছে---(ক) স্থানীয় মানুষের তথা উপভোক্তা ও উৎপাদকের আর্থিক জীবনে কোন অনিশ্চিতা থাকবে না৷ কারণ, ভোক্তা নিশ্চিন্তে থাকবে যে তার প্রয়োজন অনুযায়ী দ্রব্য স্থানীয় বাজারেই পাওয়া যাবে৷ আবার উৎপাদক ও দুশ্চিন্তা থাকবে না---স্থানীয় বাজারেই তার বা তাদের সব মাল বিক্রী হয়ে যাবে, অবিক্রিত থাকবে না৷ (খ) সবচেয়ে বড় কথা স্থানীয় বাজারেই অর্থ সচল থাকবে, আর এই  কারণে স্থানীয় মূলধনের বহিঃস্রোতও বন্ধ হয়ে যাবে৷ (গ) এতে স্থানীয় অর্থনীতিতে আর্থিক বিপর্যের সুম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে৷  বরং জনসাধারণের আয় উধর্বমুখী হতে থাকবে, তাদের ক্রয়ক্ষমতাও ক্রমাগত বাড়তে থাকবে৷

বাস্তবে এটা ফলপ্রসূ হবে কয়েকটি  ব্যবস্থার সামবায়িক-পারস্পরিক  প্রভাবে৷ যেমন---(১) বিকেন্দ্রিত অর্থব্যবস্থায় খরা-বন্যা-ভূমিকম্প-অতিমার্যা দি বিপর্যয়ের কথা মাথায় রেখে বিশেষজ্ঞ সংসদের (কালেকটিভ বডি) তত্ত্বাবধানে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সামূহিক চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন ও যোগানের ব্যবস্থা, সব সময় চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য বজায় রাখার সতর্ক দৃষ্টি ও আশু  ও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ৷ ২) স্থানীয় প্রাকৃতিক -সামাজিক -মনস্তত্বকে মান্যতা দিয়ে স্থানীয় উপকরণে তৈরী সামগ্রী দিয়ে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় তথা নূ্যনতম প্রয়োজনপূর্তিক ব্যবস্থা৷ আর এজন্য বিশেষ বিশেষ নামমাত্র ক্ষেত্র ও সময় ছাড়া স্থানীয় বাজারে বাইরের পণ্য সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধকরণ ও স্থানীয় মানুষদের এই ব্যবস্থা মনে প্রাণে মেনে নেয়া ও গ্রহণ করা৷ (‘বিদেশী জিনিস টেকসই, স্বাদে বা গুণে মানে ভাল, লোকাল মাল পাওয়া যাচ্ছে না--- তাই বাইরের জিনিস নিচ্ছি---এই ভাবনাটারই বদল, ও এই সঙ্গে---‘মরে গেলেও বাইরের জিনিস  কিনব না, ব্যবহার করব না’---এই জিদ চাই৷ ৩) স্থানীয় মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ, নিরাপত্তা ও নিশ্চিততা বিষয়ে সতর্ক সচেতনতা৷ (ক্রমশঃ)