আনন্দনগর, ১লা জুন ঃ আনন্দমার্গের প্রবক্তা ও প্রবর্তক শ্রীশ্রীআনন্দমুর্ত্তিত্ব্ ৯৮-তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে গত ২৬শে মে থেকে ২৮শে মে পর্যন্ত পুরুলিয়ার আনন্দনগরে আনন্দমার্গের ধর্মমহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হ’ল৷ মার্গগুরুদেবের প্রতিনিধি রূপে ধর্মমহাসম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংঘের পুরোধা প্রমুখ আচার্য কিংশুকরঞ্জন সরকার৷ এই ধর্মমহাসম্মেলনে পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে ও অসম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, বিহার সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আনন্দমার্গীরা যোগ দিয়েছিলেন৷ বহির্ভারতের বেশ কিছু দেশ থেকেও আনন্দমার্গের অনুগামীরা এই ধর্মমহাসম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন৷
ধর্মমহাসম্মেলনে পুরোধা প্রমুখ দাদা তাঁর প্রবচনে বলেন ঃ যারা ধর্মের পথে চলে তাদের ধার্মিক বলে থাকি৷ এখন প্রশ্ণ সমাজ আমাদের ধার্মিক বলে জানবে কী রূপে? বলা হয় ‘আচরণাৎ ধর্মঃ’ --- আচরণের মাধ্যমে তা চেনা যায়৷ অনেকে অশিক্ষিত কিন্তু তার আচরণ মানবোচিত, ধর্মসম্মত ৷ আবার অনেকে শিক্ষিত এম এ পাশ বিদ্বান কিন্তু আচরণ ঠিক নেই তাকে ধার্মিক বলা যায় না৷ অনেক বিদ্বান মানুষ পড়াশুনা করেছে কিন্তু লক্ষ্যটা হলো জড়ভোগ বাসনা --- তাকে সঠিক বিদ্বান বলা যায় না, যারা বিদ্বান হবেন তাদের লক্ষ্যটা হবে কী --- সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে৷ বিদ্যা তাই হবে যা বিমুক্তির পথে নিয়ে যাবে৷ যা স্থায়ী মুক্তি এনে দেবে তাই হলো বিমুক্তি৷ আবার জ্ঞান সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে---Subjectivisation & objectivity৷ অর্র্থৎ বিষয়কে আত্মস্থীকরণ হলো জ্ঞান ৷ যে জ্ঞান ভেদাভেদ সৃষ্টি করে তা মানুষকে বিমুক্তির পথে নিয়ে যাবে না৷ তাই জ্ঞান বা শিক্ষা হবে নব্যমানবতা ভিত্তিক৷ যদি বিদ্বানরা নব্যভাবনার দ্বারা প্রেষিত হয় চলে তবে সে প্রকৃত বিজ্ঞান হবে না৷
আবার কেবল নিজে ধর্মের পথে চলছে কিন্তু পরিবেশটা অন্যায়কারীদের বা অধার্মিকদের দ্বারা প্রভাবিত৷ তা হলে চলবে না৷ অন্যদেরও ধর্মের পথে ধার্মিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে৷ তবে নিজেরও ধর্মপথে এনে ঠিকভাবে চলা যাবে৷ পরিবারে যদি স্বামী ধর্মের পথে চলছে স্ত্রী ওই আদর্শের পথে বা ঠিক তার উল্টোটা তবে পরস্পরের মধ্যে সংঘাত ঘটবে ৷ তাই আমাদের চরম নির্দেশে বলা হয়েছে অন্যকে সৎপথের নির্দেশনা দেওয়া সাধনারই অঙ্গ৷ মার্গগুরুদেব আমাদের কত উন্নত আচরণ বিধি দিয়ে গেছেন, তা নিজেরা যদি ঠিকমতো পালন না করি তবে অন্যদের ধর্মের পথে আনব কি করে? চরম নির্দেশের যম-নিয়ম ঠিকমত পালন করে চলতে হবে৷ নাহলে প্রলোভনের মোহে পড়ে সাধনার অর্জিত যা কিছু ভাল নষ্ট হয়ে যাবে৷ আমরা যদি আচরণ বিধি যম নিয়ম ঠিকমত মেনে চলি তবে সমাজের কাছে আমরা মহান ব্যষ্টি বলে পরিচিত হব, আর আমাদের জয় জয় কার হবে৷ আর আমরা যদি কথায় এক আর আচরণে যদি উল্টো হই তবে লোকে আমাদের নিন্দা করবে৷ তাই ভাবনায়, কাজে, কর্মে, আচরণে আমাদের এক হতে হবে৷ এখন ধর্মের পথে চলার পথটা কেমন হবে? তা হবে সংশ্লেষণের পথ৷ বিশ্লেষণের পথ নয়৷ ছোট ছোট অণুদের সংযোজন করে বড় আকারের সিনথেটিক দ্রব্য তৈরী করি৷ যেমন পলিথিন৷ অনেক ইথিলিন অণুগুলোকে সংযোজন করে বড় আকারের যৌগ তৈরী করা হয় তাই হলো পলিথিন৷ আবার রক্তের অণু ভেঙ্গে ই.সি.জি, হিমোগ্লোবিন, শ্বেত কণা ইত্যাদির পরিমাণ বের করা হয় বিশ্লেষণ বা এ্যানালিসিস এর মাধ্যমে৷ এখন ধার্মিকদের সংশ্লেষণের পথকে অনুসরণ করে চলতে হবে৷ অনেক রাজনৈতিক নেতা, গোষ্ঠী সেন্টিমেন্ট জাত-পাতের সেন্টিমেন্টকে উস্কিয়ে দিয়ে নিজের কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করে ৷ তবে এদের মধ্যে কেউ কেউ না জেনে এমন করে চলে আর অনেকে জেনে বুঝে করে চলে স্বার্থপূর্ত্তির উদ্দেশ্যে৷ অনেকে জেনে শুণেই গোষ্ঠী জাত-পাতের সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে নিজের স্বার্থপূর্ত্তি করাকে অভ্যাসে পরিণত করে নিয়েছে৷ এরা হল খুবই ধূর্ত প্রকৃতির মানুষ৷ এটা মানবজাতির মধ্যে বিভেদকামী তত্ত্ব৷ বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য আনাই হল ধার্মিকদের কাজ ৷ আর নিজেকে ধার্মিক বললে হবে না সমাজ তাকে ধার্মিক বলে মান্যতা দিবে, তবেই তো৷ ধার্মিক মানুষদের সঠিক মানসিকতার মাপকাঠি হলো --- ‘‘মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্য’’ এই মানসিকতা৷ যদি আমরা গোষ্ঠী মানসিকতা, জাত-পাতের সেন্টিমেন্ট গায়ের রঙ সম্প্রদায়াদি নিয়ে চলি তবে সমাজ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে--- সমাজ ধবংসের দিকে চলে যাবে৷ এই বিশ্লেষণের পথ ধরে নেতারা তাদের স্বার্থ পূর্ত্তির জন্যে শোষণ চালিয়ে যায়৷ সংশ্লেষণের পথ হলো সেবা মানসিকতার পথ, আর বিশ্লেষণের পথ হলো কায়েমী স্বার্থ পূর্ত্তির পথ৷ আমাদের ‘প্রাউট’ দর্শন সেবার মাধ্যমে দেশ গড়তে চায়৷
প্রাউটের কাজ হলো সেবা মনোভাব নিয়ে৷ আমাদের আনন্দমার্গ ইউনিবার্সাল রিলিফ টিমের কাজ হলো সেবার দ্বারা মানুষের ত্রাণ করা৷ যেখানে এমার্টের লোক সেবা প্রদান করবে সেখানে প্রাউটিষ্টরাও তাদের সহযোগিতা করবে৷ বাবা সেবার উপর খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন৷ সেবায় মন পবিত্র হয় ও নির্মল হয়৷ সেবার মুখ্য উদ্দেশ্যে হলো নিজের কষ্টকে সহ্য করে অন্যের কষ্টকে কিভাবে দূর করা যায়৷ একে বলা হয় তপঃ যা সাধনার একটি অঙ্গ৷
সাধক সাধনাতে মনকে একাগ্র করার চেষ্টা করে৷ কিন্তু প্রথমে এ চিন্তা ও চিন্তার দিকে ভাগতে থাকে৷ হয়ত পরিবারের চিন্তা বা ছেলেমেয়ের পড়াশুনা বা কোন সমস্যার চিন্তা৷ এমন চিন্তা যদি আসে এতে ঘাবড়ানোর কিছুই নেই৷ কিন্তু চিন্তাটা কেমন হয় সাবধানতাটা সেখানেই বেশি দরকার৷ মন পশুপ্রবৃত্তির দিকে বা নোংরা চিন্তাতে মন ডুবে যাচ্ছে না তো৷ এখন সবসময় যদি সেবার মনোভাব নিয়ে থাকি তাহলে সাধনায় প্রথমে সেবার ভাবনাই আসবে, এক্ষেত্রে মন পরোক্ষে পরমপুরুষের ভাবনাতে চলে যাচ্ছে৷ সাধনা ও সেবা অঙ্গাঙ্গি জডিত৷ পরমপুরুষকে যেহেতু লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছি তো সেবার ভাবনাতেই পরমপুরুষের ভাবনা এসে যাবে৷ যেখানে লক্ষ্য পরমপুরুষ নেই সেখানে প্রকৃত সেবাভাব আসতে পারে না, বরং ব্যবসায়ী মনোভাব আসবে৷
আগেই বলেছি সেবার দ্বারা মন নির্মল হয়৷ নির্মল হৃদয়ে তে পরমপুরুষ ধরা দেন৷ তখন সাধকের জীবনে জয় জয় কার নেমে আসে৷ সাধকের সাধনা সাফল্যলাভ করে৷