অর্ধেক  আকাশের যন্ত্রণা

লেখক
সোমা সিনহা

‘আমি নারী আমরা পারি’--- এই ক্যাচ লাইনটির  মধ্যে যে কতখানি না পারার যন্ত্রণাকে আড়াল করা হচ্ছে তার খবর কজন রাখে! যে শিশুকন্যাটি কদিন আগে ভূমিষ্ঠ হল সে কোনদিনই পারবে না তার জন্মদাতা  মা ও বাবার দায়িত্ব নিতে৷ তাই পুত্র সন্তানের জন্য মানত করতে হয় কোনো সিদ্ধিদাত্রী মায়ের কাছে বা কোন গুণিন বা ওঝার নিদান মেনে হয় দিনযাপন নিষ্ঠাবান বাবা-মায়ের৷ হ্যাঁ, ‘কন্যাশ্রী’, রূপশ্রী বা বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও এর জিগির তুলে নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েটি ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ ‘হলেও তার দ্বারা লক্ষ্মী লাভ  তেমন হয় না৷ সে পরিবারের হাল ধরতে পারে না৷ এই দৃঢ় বিশ্বাস একপ্রকার জোর করে প্রোথিত করে দেওয়া হয় অধিকাংশ পরিবারে৷ তাই তার উচ্চশিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয় মানে বৃথা অপচয়৷

এই তো সেদিন একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বি.এ.পাস করা মেয়ের মা, কাতর ভাবে অনুনয় করলেন--- একটা চাকুরীজীবি ভালো পাত্রের সন্ধান করে দাও না মা, মেয়েটিকে পাত্রস্থ করি৷ আমি বললাম---কেন? সে কি আর পড়াশোনা করতে চায়না? চায় বৈ কি--- মায়ের উত্তর ৷ কিন্তু ওর বিয়ের জন্য যে টাকা গচ্ছিত আছে সেটা পড়ার জন্য খরচ করতে চায় না ওর বাবা৷ একটু জোরের সাথে বললাম---কিন্তু ও তো  কিছু একটা নিজের জন্য করে তারপরে বিয়ে করতে পারে৷ ভদ্রমহিলা একটু সময় নিলেন৷ তারপর খানিকটা রুঢ়ভাবে বললেন--- কী হবে চাকরি করে? টাকা রোজগার? তারই বা কি দরকার? যদি স্বামী ভাল রোজগেরে হয়, রাজরানীর মত থাকবে৷ সুখে সংসার করবে৷ আমি থেমে গেলাম৷ আর তর্ক করলাম না৷ বুঝলাম চাকরি করা মানে এঁদের কাছে কেবল টাকা রোজগার৷ চাকরি করা মানে যে এক স্বাধীনতা, এক আত্মবিশ্বাস, সমাজের বুকে নিজের পরিচয় রেখে যাওয়ার অঙ্গীকার, সে অর্থ এঁরা কোনদিনই বুঝবেন না৷

এঁরা শ্বশুরবাড়ির অনুমতি সাপেক্ষে অর্থ ব্যয় করা বা ঘরের বাহির হওয়ার মানেই বোঝেন স্বাধীনতা৷ তাই তো মা গর্ব করে বলেন---মিথ্যে বলবো না আমার বড় মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকেরা বেশ স্বাধীনচেতা৷ তাঁরা মেয়েকে দেখতে চাইলেই পাঠিয়ে দেন আমার কাছে৷ হায়রে বঙ্গ ললনা মনের  শিকলের বাঁধন এত শক্ত হলে পায়ের শিকল লাগে না৷ এমনই বন্দি হয়েছো তুমি আপন  বন্ধনে৷ সে বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার মনের জোর তোমার কোথায়? তুমি তাই পারো না অনেক কিছুই৷

বিশ্বাস করুন আর নাই করুন মেয়েদের কোন নিজের বাড়ি নেই৷ আছে একটি বাপের বাড়ি আর একটি শ্বশুরবাড়ি৷ যেখানে তার নিজের জন্য কোন বরাদ্দ ঘর থাকতে নেই৷ যে ঘরে বসে সে কবিতা লিখতে পারে, ছবি আঁকতে পারে কিংবা এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে রাখতে পারে তার কল্পনাগুলোকে৷ তাই মেয়েরা ডাল পালা মেলার আগেই বনসাই হয়ে যায়৷ সে পারে না কোন মহৎ কিছু সৃষ্টি করতে ৷ কারণ সৃষ্টি সুখের উল্লাস তার কোথায়? তার কবিতা লেখা, আঁকা-জোকা, গান করা সবই চলে দিনগত পাপক্ষয়ের মত৷ উনুনে ভাত চাপিয়ে বা বাচ্চার  দুধ বসিয়ে যখন মেয়েটি লিখতে বসে বা ক্যানভাসে আঁচড় কাটে, তখন সে তাতে সবটুকু ধ্যান দিতে পারে কই? তার সজাগ মস্তিষ্ক রান্না নষ্ট হতে দিতে চায় না যে৷ তাকে  তাই বার বার  উঠে যেতে হয় রান্নাঘরে৷ যাতে রমণীর গুণে সংসার সুখের হয়, সেজন্য পাশে সরিয়ে রেখে যেতে হয় কবিতার খাতা, গানের বই বা ছবির ক্যানভাস৷ তাই তার দ্বারা উন্নতমানের সৃষ্টি হতেই পারে না৷ এই স্থলে কিছু বচনবাগীশ রে রে  করে উঠবেন৷ কেনwomen empowerment এর সুবাদে  কত নারীরাই আজ এভারেষ্টে চড়ছেন, পাইলট হচ্ছেন, আই.এ.এস র‌্যাংকিং এ প্রথম হচ্ছেন৷ বর্তমানে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্ত ক্ষেত্রে স্বগরিমায় বিরাজ করছেন৷ আর কী চাই? হ্যাঁ, তা হচ্ছে  বটে৷ কিন্তু এদের সংখ্যা দুরবীন দিয়ে দেখার মত৷ আর যে কটা দেখা যাচ্ছে তা নিয়ে হইচই বেশি করতে হবে বৈকি৷ তারা যে মেয়ে তাদের গৌরব গাথা তুলে ধরার মধ্যে আসলে রয়েছে আত্মপ্রচার৷ যতটা না শ্রদ্ধা বা  সম্মান তার চেয়ে বেশি প্রকট হয় পুরুষদের নিরিখে নারীরা কতখানি এগিয়ে বা পিছিয়ে তার চুলচেরা বিচার৷ আত্মসম্মানে লাগে না! লাগবেই বা কি করে! সবাই তো অভ্যাসের দাস৷ আধুনিককালের সিনেমা বাgood for nothing  ‘গুড সিরিয়াল গুলিতে কোন মহীয়সী নারীর লড়াইয়ের কাহিনী তুলে ধরার পরিবর্তে তার সাজগোজ, বিয়ে করা, আবার সেই বিয়ে ভাঙ্গার স্বাধীন অভিব্যক্তি বা নারীতে নারীতে গার্হস্থ্য হিংসা ছড়ানোর কাহিনী সংক্রান্ত প্রদর্শনী সবাই গিলছে বেশি৷ আর তাতেই ঘরে ঘরে  নারীরা স্বাধীকার প্রতিষ্ঠা বা আত্মতুষ্টি নামক মারণ রোগে ভুগছে৷ সমাজে আজও মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের  রেজাল্ট ঘোষণার সময় মেয়েদের মধ্যে প্রথম আলাদা করে ঘোষণা করতে হয়৷ কারণ মেয়েরা তো অন্য জাত৷ তারা পুরুষ নয়৷ আবার বুঝি বা মানুষই নয়৷ তারা মেয়ে  তাই তাদের কিছু ‘পারা’ কে হাইলাইট করার মাধ্যমে আসলে না পারার মূর্ছনাই প্রকট হয় বেশি৷

কিন্তু কেন এই বঞ্চনা? কেন এই অসম্মান? যে নারী সভ্যতার  উষালগ্ণ থেকে পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সভ্যতার অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করার জন্য যে কোনো প্রকারের ঝুঁকি নিতে পিছপা হয়নি, যে নারী গার্গী মৈত্রী বা মদালসার মত বৈদুষ্যে, অধ্যাত্ম চেতনায়  মহীয়ান, ঝাঁসির রানীর মত ক্ষুরধার তেজস্বী নারী আদর্শের অনুসারী, সে নারীর জন্য এই অসম্মানের মধ্যে যেমন সমাজের কুচক্রীদের দূরভিসন্ধি লক্ষ্য করা যায় তেমনি নারীদের আত্মবঞ্চনার গন্ধও খানিকটা পাওয়া যায়৷ ভোগবাদের বিশ্বে, কতিপয় সুবিধাবাদী মানুষ আজকের নারীদের পণ্য করছে৷ আর  আশ্চর্যের বিষয় নারীরা বোকার মতো তাকেই নিজেদের ডেভলপমেন্ট তথা এমপাওয়ারমেন্ট বলে ভুল করছে৷ বিপণনের জগতে বিজ্ঞাপন, সেটি সিগারেটের  হোক বা কোল্ড ড্রিংক্স এর, স্বল্পবসনা নারীরা নিজেদের মেলে ধরতে মনে করছে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সোপান৷ আর যে মানুষরা আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ছে তারা নারীদের উপর সমাজকে কলুষিত করার দায়ভার চাপিয়ে নারীদের ‘পারা’র স্বপ্ণ তাই অধরা রয়ে যায়৷

অথচ আমরা যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্ম প্রতিষ্ঠানের  পরিসংখ্যান নিই, তাহলে দেখব সেখানে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রাদের সাফল্য অনেক বেশি৷ বিদ্যালয় ---বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে স্তরে প্রথম সারির পড়ুয়া  ছাত্রারাই৷ আর কর্মক্ষেত্রে নারীরা  পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি কর্মতৎপরতার পরিচয় দিয়ে থাকেন৷ তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা আমার মতে দুটি৷ প্রথম পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষরা কখনোই নারীদের উত্থানকে সহজে মেনে নিতে পারেন না৷ তাই তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেইinferiority Complex এ ভোগেন৷ আর এর থেকেই শুরু হয় অত্যাচার, আক্রমণ, গার্হস্থ্য অশান্তি৷ শারীরিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে চলে অমানবিক দমন পীড়ন৷ আর নারীরা যেহেতু শারীরিকভাবে দুর্বল, তাই তার পরাজয় নিশ্চিত হয়ে পড়ে৷ দ্বিতীয়তঃ নারীদের আত্মশ্লাঘা৷ বা অন্যভাবে বললে নারীরা অল্প প্রাপ্তিতেই নিজেদের ধন্য মনে করে৷ আর সঙ্গে যুক্ত হয় অহংবোধ৷ তাই তাকে প্রশংসার  টোপ ফেলে সহজেই পণ্য করা যায়৷ আর এতেই তার অধঃপতনের  বীজ বপন হয়ে যায়৷

সে ভোগ্যপণ্যকেই জীবনের চরম প্রাপ্তি ধরে নেয়৷ আর ভুলে যায় মানুষের আসল প্রাপ্তি কখনোই দামী শাড়ি গয়না বা আসবাবপত্র নয়৷ চরম তথা পরম প্রাপ্তি যা কিনা চিরকালীন ও স্থায়ী তাকে লাভ করার এসনাই জাগে না মনে বা জাগলেও তাকে ভোগ্যপণ্যের বিলাসিতার  গহ্বরে  বলি দিয়ে দেয়৷ তাই অনেক কিছু পেরেও না পারার  লাঞ্ছনা তাকে  পিছু ছাড়ে না৷ প্রখ্যাত ঔপন্যাসিকCharles নারীদের উচ্চ আসনে বসিয়ে  বললেন A hand that Dickens rocks the cradle rules the universe. ইউনিবার্সRule করাতে কতখানি দক্ষতার পরিচয় নারীরা দিয়েছেন তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেওCradle rocking এর সাফল্য যে একচেটিয়া ভাবে তাঁরই এ ব্যাপারে দ্বিমত থাকার কথা নয়৷ তাছাড়া এই এর বেলায় আত্মত্যাগের কি চরম নিদর্শন একজন মহিলা রেখে যান, তার খবর কজন রাখে? আর রাখবেই বা কেন, মেয়েদের তো জন্মলগ্ণ থেকেই মায়ের জাতে উন্নীত করা হয়৷ আর মায়ের জাত মানে তো আত্মত্যাগী জাত৷ তাঁর আত্মত্যাগ কে সিনেমা-নাটকে মহিমান্বিত করার মাধ্যমে, আসলে পুরুষজাতি তাঁদের দায়িত্ব এড়িয়েছেন কৌশলে৷ নইলে সন্তান জন্ম দেওয়ার দায়ভার কেবল মায়ের থাকলেও  তাকে লালন পালন করার দায়িত্বটা বাবা অনায়াসে নির্বাহ করতে পারতেন৷  কিন্তু কতজন বাবা সেই দায়ভার গ্রহণ করেন? হ্যাঁ, দিন বদলেছে৷ একথা সত্যি একালের  বাবারা হয়তো সন্তান পালনের  দায়িত্ব অনেকাংশে গ্রহণ করেন৷ কিন্তু সে দায়িত্ব পালনের কারণে তাঁর কপালে জোটে আত্মীয় বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে বাহবা৷ আর মায়ের বেলা সে তো কেবল কর্তব্য৷ ঘরে বাইরে সমান দায়িত্ব পালন করেও, অফিসে পুরুস কর্মীটির চেয়ে দ্বিগুণ পরিশ্রম করে বাড়ি ফেরা মহিলাটির জন্য অপেক্ষা করে কেবল অপরাধবোধ---দেরিতে বাড়ি ফেরার জন্য, সন্তানকে সময় না দেওয়ার জন্য, পরিবারকে সঙ্গ না দেওয়ার জন্য৷ তাই সমাজ সংসার বা সন্তানের জন্য  দিনের শেষে ক্লান্ত অবসন্ন হৃদয়ের সবটুকু শক্তি একত্রিত করে তাই চিৎকার  করে আত্মাকে শান্ত করেন এই প্রবোধ বাক্যে যে ‘আমি নারী পারি’৷ তাঁর এই বৃথা আস্ফালনে না আছে প্রশস্তি না  আছে আত্মবিশ্বাস৷ অর্ধেক আকাশের মালিক এর মুক্তির জন্য এক চিলতে আলো জোটে না৷ কেবলই অন্ধকার৷ এ পোড়া দেশের সকল সুবোধ সৃষ্টিশীল মানুষের কাছে  তাই আমার আবেদন---আপনার চারিপাশে ভগিনীরূপে, কন্যারূপে, মাতারূপে বা জায়ারূপে যে নারীকে আপনি দেখছেন তার যোগ্যতা বিচারে একটু উদারচিত্ত হোন৷ একজন সফল নারী একজন সফল পুরুষের থেকে অনেক বেশী শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করে সাফল্যের স্বাদ পেয়েছে৷ তাকে মুক্তির স্বাদ পেতে সাহায্য করুন৷ তার চেতনা চৈতন্যের বিকাশকে অবরুদ্ধ করে, তাকে স্তব্ধ করে দেবেন না৷ এতে সমাজের সুস্থ সন্তুলন বিঘ্নিত হবে৷