প্রভাতী

ভাঙে তো মচকায় না

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

সেই যে গল্প আছে না, একজন বাঙলাভাষী জমিদারের সখ হয়েছিল ঊর্দুভাষী সাজবার৷ থাকতেন তিনি গ্রামে৷ গ্রামের লোককে তিনি বোঝাবার চেষ্টা করতেন যে তাঁর পূর্বপুরুষেরা আসলে উর্দুভাষী ছিলেন৷ বাঙলায় আসার পরে ভাষাতে কিছুটা বাংলা প্রভাব পড়ে গেছে, আসলে তাঁরা উর্দুভাষীই৷

গ্রামের লোকেরা ভয়ে ভক্তিতে সামনে কিছু বলত না৷ আড়ালে বলাবলি করত, এরা চৌদ্দ পুরুষ ধরে তো এখানকারই লোক, বাইরে থেকে আবার এল কবে! ভদ্রলোক শেষে হালে পানী না পেয়ে তাঁর ঊর্দু বনেদীপনা দেখাবার জন্যে শহরে একটা বাড়ী কিনলেন৷ শহরের প্রতিবেশীদের বোঝাবার চেষ্টা করলেন তাঁরা পশ্চিমদেশীয় অর্থাৎ উর্দুভাষী, তবে বাংলা ভী থোড়া–ৰহুৎ জানেন৷ শহরের লোকেরা ভাবলে, হয়তো বা কথাটা সত্যি৷ এমন সময় একদিন জমিদার সাহবের বাড়ীতে একটা শোকাবহ ঘটনা ঘটে যাওয়ায় বাড়ীর মেয়েরা চীৎকার করে মড়াকান্না জুড়ে দিলে৷ জমিদার সাহেবের আশায় গুড়ে বালি পড়ল৷ মেয়েরা কান্না জুড়ে দিয়েছে বাংলা ভাষায়৷

পাড়ার লোকেরা এসে বললে–জমিদার সাহেব, আপনি তো উর্দুভাষী, তবে আপনার বাড়ীর মেয়েরা বাংলা ভাষায় কাঁদছেন কেন

জমিদার সাহেব বললেন–হ্যাঁ, তারা মন্দ কাঁদছে না! গোড়ার দিকে উর্দুতেই কাঁদছিল৷ আমি বললুম তোমরা যদি উর্দুতে কাঁদো বংগাল মুলুকের লোকেরা ভাববে তোমরা উর্দুতে সাদীর গান গাইছো৷ তাই বাংলায় কী করে মড়াকান্না কাঁদতে হয় আমি ওদের শিখিয়ে দিয়ে এলুম৷ তা মন্দ কাঁদছে না, শুণে মনে হবে কোন বংগালীন ঔরৎ কাঁদছে৷ আমার বাড়ীর নোকরানী গফুরের আম্মা যেমন ভাবে কাঁদে, এরাও প্রায় তেমনি ভাবেই কাঁদছে৷

পাড়ার লোক তো শুণে থ’৷ তারা বুঝে নিল জমিদার সাহেব একটি আস্ত মজনতালি সরকার৷ তোমরা মজনতালি সরকারের গল্প জান তো!

মজনতালি সরকার ছিল একটি বেড়াল৷ তার সখ গেল, বনেদীয়ানা দেখিয়ে বনের রাজা হবে৷ একদিন রাত্রি তৃতীয় প্রহরে বনের জীবজন্তুরা সবাই বসেছে বন–উন্নয়ন পর্ষদের বিশেষ মীটিংয়ে৷ প্রধান আলোচ্য বিষয়, বনে পানীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থা কীভাবে আরও ভাল করা যায় তাই নিয়ে৷ কুকুর, ছাগল, বাঘ, ভাল্লুক, সবাই আছে৷ সবাই নিজের নিজের বক্তব্য বলে যাচ্ছে৷ সভাপতির চেয়ারটি খালি রয়েছে৷ সিংহ আসতে একটু দেরী করছে কি না৷ এমন সময় মজনতালি সরকার সভাপতির চেয়ারে এসে বসে পড়ল৷ দু’তিন বার ম্যাঁও ম্যাঁও করে শরীর ফুলিয়ে দিলে৷ বন্য জন্তুরা দেখলে, আরে শরীরটাকে বেশ ফোলায় কমায় তো!

সবাই বললে–জাহাঁপনা, আপনি কে জাহাঁপনা

সে বললে–আমি মজনতালি সরকার৷ আমি বনের রাজা৷ এই যে বাঘ দেখছ ও আমার ভাগ্ণে৷ শাস্ত্রে আছে ‘নরাণাং মাতুলক্রমঃ’৷ পুরুষ মানুষকে দেখতে হয় মামার মত, আর মেয়েদের দেখতে হয় পিসির মত৷ তা চেয়ে দেখ না, বাঘের চেহারা কতকটা আমার সঙ্গে মিলেছে কি না আমি মামা কি না!

সবাই দেখলে, সত্যিই তো রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারটা দেখতে অনেকটা মজনতালি সরকারের মতন৷ সবাই মজনতালি সরকারকে রাজা বলে মেনে নিলে৷ লেট লতিফ* সিংহকে আর রাজা বলে মানছি না৷

মজনতালি সরকারের সভাপতিত্বে বন উন্নয়ন পর্ষদের মীটিং ভাল ভাবেই হল৷ ঠিক করা হ’ল, দশ কোটি নূতন বৃক্ষ লাগানো হবে৷ আগামী বৎসর ওই দশ কোটির মধ্যে যে ন’ কোটি গাছ মরে যাবে সেই শূন্যতা পূরণের জন্যে যাদের কণ্ট্র্যাক্ট দেওয়া হবে তারাই বিনা মূল্যে পানীয় জল সরবরাহ করবে৷ এরপর মজনতালি সরকার বললে–তোরা দেখছি সবাই ছোট ছোট জানোয়ার৷ আমার চাপরাশি আর্দালীর কাজের জন্যে দু’একটা বড় জানোয়ার দরকার৷

সবাই বললে–আমাদের জঙ্গলে ঐরাবত হচ্ছে সব চেয়ে বড় জানোয়ার৷ দু’চারটা ঐরাবত আপনার কাছে পাঠিয়ে দোব৷

মজনতালি সরকার বললে–দেখব সে কত বড় জানোয়ার৷ বনের জানোয়ারা ক্যানেস্তারা টিন পেটাতে লাগল৷ আওয়াজ শুনে হাতীরা ছুটোছুটি শুরু করে দিলে৷ একটা প্রকাণ্ড ঐরাবতকে ছুটে আসতে দেখে মজনতালি সরকারের আর গাছের ওপর থাকতে ভরসা হল না যদি ঐরাবতের প্রচণ্ড ধাক্কায় গাছটা পড়ে যায় তবে মজনতালি সরকারের সঙ্গে সঙ্গে ভূমিসমাধি হবে৷ মজনতালি সরকার তখন একটা বট গাছের শিকড়ের তলে আশ্রয় নিলে৷ ঐরাবতের পা বড়বি তো পড় শিকড়ের ওপর পড়ল৷ হাতীর পায়ের চাপে শিকড়টা মজনতালি সরকারের পেট চেপ্টে দিলে৷ মজনতালি সরকারের পেট ফেটে গেল৷ তার তখন শেষ অবস্থা৷

এদিকে বনের জানোয়াররা তাদের রাজাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে৷ কোথায় রাজাবাহাদূর, কোথায় রাজাবাহাদূর! শেষ পর্যন্ত তারা রাজা–বাহাদূরকে খুঁজে বের করলে৷ রাজ্য বাহাদূরের তখন অন্তিম দশা৷ তারা কাঁদতে কাঁদতে মজনতালি সরকারকে বললে ‘রাজা–বাহাদূর, আপনার এ দশা কে করলে’

খাবি খেতে খেতে মজনতালি সরকার বললে– তোদের আমি কী অর্ডার করেছিলুম আমি বলেছিলুম একটা বড় জানোয়ার আনতে৷ আর তোরা কি না পাঠালি ঐরাবতের মত একটা ছোট্ট জানোয়ারকে৷ প্রথমে তো তাকে দেখে বড় রাগ হ’ল৷ পরে এত হাসি পেল যে হাসতে হাসতে আমার পেট ফেটে গেল৷ মজনতালি সরকার মরে গেল৷

* স্বভাবগত ভাবে যে মানুষ কোথাও পৌঁছুতে বিলম্ব করে ভারতীয় ইংরেজীতে তাকে বলে ‘লেট লতিফ’৷

স্বভাব যায় না ম’লে

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

(‘কথামালা’ অবলম্বনে রচিত)

এক যে ছিল চাষী

এবার তবে তার কথাতেই আসি৷

শীতের ভোরে চাষের কাজে

যাচ্ছিল সে ক্ষেতে,

পথে যেতে যেতে

দেখতে পেলো প্রকাণ্ড এক সাপ

তিড়িং করে লাফিয়ে উঠলো---

ওরে বাপরে বাপ!

 

সাপটা ছিল মরো মরো

হিমেতে আচ্ছন্ন

চাষীর মনে জাগলো মায়া

তাই সাপটার জন্য৷

বাড়িতে এনে আগুনে সেঁকে

খাইয়ে কিছু খাবার

যত্নে তাকে আগের মতো

করলো চাঙা আবার৷

 

চাষীর ঘরে যত্ন-আত্যির

ছিল না কোন অভাব,

তবুও সাপের বদলালো না স্বভাব৷

চাষীভায়ার ছোট্ট ছেলে

খেলছিল দাওয়ায়,

দেখেই তাকে ফণা তুলে

ছোবল মারতে যায়৷

 

তাই না দেখে চাষী হলেন

ক্রদ্ধ অতিশয়---

‘ওরে কৃতঘ্ন, হিংস্র ক্রর

তোকে আর দয়া নয়৷’

কুপিত চাষী কুঠার দিয়ে

মারলো এক ঘা---

এক ঘায়েতেই বেরিয়ে গেল

সাপের প্রাণটা৷

 

সেবা পেয়েও চাষীকে সাপ

দিল না প্রতিদান,

অকৃতজ্ঞ কর্মদোষে

হারালো তাই প্রাণ৷

তাই তো বলি,

সাধে কি লোকে বলে

স্বভাব যায় না মলে

শৈশবের স্বপ্ণ

লেখক
আচার্য গুরুদত্তানন্দ অবধূত

গুরুকুলে যাবো

কত কি শিখবো,

গুরুজনে করি সেবা

সোজা পথে চলবো৷

 

গুরুকুলে যাবো

মিলে মিশে থাকবো

দৃঢ় পায়ে চলি পথ

শুভপথ ধরবো৷

 

গুরুকুলে যাবো

খেলাধূলা করবো,

সবারে ভালবেসে

নিজেরে গড়বো৷

ৰামুনদিদির বিপত্তি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

আমার ছোটবেলায় শ্যামবাজারে আমার মামার বাড়িতে এক রাঁধুনী ছিলেন৷ রান্নায় তাঁর হাত ছিল ৰেশ পাকা–যেন একেবারে সৈরিন্ধ্রী৷ আমরা তাঁকে ৰামুনদিদি বলে ডাকতুম৷ নুন–ঝাল–মশলার হিসেব ছিল তাঁর চমৎকার৷ একবার বাড়িতে কিছু লোককে নেমন্তন্ন করা হয়েছিল৷ খাবার পর অতিথিরা মুক্তকণ্ঠে ৰামুন–দিদির প্রশংসা করতে লাগলেন৷ সবাই বললেন–যা রেঁধেছ ৰামুন–দিদি, অমৃত, অমৃত! ত্রিভুবনে এর তুলনা মেলা ভার!

নিজের প্রশংসা শুনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে ৰামুনদিদি উচ্ছ্বসিত ভাষায় বলে উঠলেন– আমি বালো পাক করুম না তো করৰো ক্যাডা

খানিক বাদে নিমন্ত্রিতরা চলে গেলেন৷ অতিথিরা চলে যাবার পরে আমার ফুল মাসিমা ৰামুনদিদিকে ডেকে বললেন–ৰামুনদিদি, নিজের মুখে নিজের প্রশংসা করতে নেই৷

ৰামুনদিদি জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকিয়ে রইলেন৷ বললেন–তবে কী ক রুম

ফুল মাসিমা–যখন কেউ তোমার প্রশংসা করবে তখন প্রথমতঃ মুখ আর চোখ নীচের দিকে করে দাঁড়িয়ে থাকবে দ্বিতীয়তঃ মিটিমিটি হাসবে তৃতীয়তঃ হাত কচলাতে থাকবে চতুর্থতঃ উৎকর্ণ হয়ে অর্থাৎ কান খাড়া করে নিজের প্রশংসা শুনতে থাকবে ও আনন্দ পেতে থাকবে৷ ৰুঝেছ

ৰামুনদিদি–হ, ৰুস্সি৷

তার কিছুদিন পরেকার কথা৷ আবার কিছু লোককে নেমন্তন্ন করা হয়েছে৷ অতিথিরা খেয়ে একেবারে ভাবতন্ময় হয়ে গেছেন৷ তাঁরা ৰামুনদিদিকে ঘিরে প্রশংসা করে চলেছেন আর বলছেন–কী বলব ৰামুনদিদি, যা রেঁধেছ অমৃত........ অমৃত! স্বর্গের ইন্দ্রলোকের বাবুর্চি –খানসামারাও এমন রাঁধতে পারে না৷ সত্যি কথা বলতে কী, ৰামুনদিদি যা খেলুম তা মুখে লেগে রইল৷ আর প্রত্যাশায় রইলুম কবে আবার ডাক পড়বে৷

ৰামুনদিদির আগেকার দিনের কথা মনে ছিল৷ তিনি বসেছিলেন৷ হঠাৎ তড়াং করে উঠে দাঁড়ালেন৷ মুখ আর চোখ নীচের দিকে করলেন..........হাত দু’টি কচলাতে লাগলেন.....মিটিমিটি হাসতে লাগলেন.........কান খাড়া করে নিজের প্রশংসা শুনতে লাগলেন আর আনন্দপেতে থাকলেন৷ কিন্তু ৰামুনদিদি এদিনও শেষ রক্ষা করতে পারলেন না৷ সব কিছু ঠিকভাবে করার পরে ৰামুনদিদি পরিশিষ্ট হিসেবে কিছুটা অতিজল্পন (বিতর্ক) যোগ করে বিনয়ের পরাকাষ্ঠা দেখাতে গিয়ে বললেন–কী আর পাক করসি, কী আর পাক করসি, এ্যাই মশলা দিয়া কানিকডা পসা গোবর পাক করসি৷

নিমন্ত্রিতরা একসঙ্গে ঃ থু.......থু...........থু............!

নবান্নের আহ্বান

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

এসেছিলে যদি থাকো কিছুক্ষণ

 কিছু কথা যাও বলে,

কিছু শুনে যাও অবুঝ সবুজ

 না বলে যেওনা চলে৷

 

জমা কথা আজ হবে বিনিময়

 সবার সাথে হবে পরিচয়

চায়ের আসরে সব সমাধান

ভিডিও রেকর্ডে রইবে প্রমাণ৷

 

 বর যাত্রীর বাস এসেছিল

তারা এসে তবে কোথা চলে গেল

আমি একা বসে বাসর সাজায়ে

 শূণ্য রাজমহলে !

 

বরযাত্রীর গোঁসা হয়েছে

 বুঝতে পারেনি পিসি,

তাদের দাবি লাইভ স্ট্রীমিং

 দেখুক বঙ্গবাসী৷

 

রাজমহলে যাবেনা সবাই

যাবেতো বিশেষ অতিথি,

দূর থেকে যদি সবাই দেখে

হাসি ফুটিয়েছে সম্প্রীতি!

সুকুমার রায়ের কবিতা

আসছে শরৎ আকাশে বাতাসে ভেসে

নৃত্যের ছন্দে তালে তালে নবীন বেশে

বন বনানী খুশীতে দোলায় আপন শাখায়

রঞ্জিত শ্যামল শোভা স্বাগত জানায়

বাসনা ভরা বিলাসী মন চঞ্চল পবনে

শারদপ্রাতে সোনালী আভা

                   লেগেছে প্রাণে৷

খুশীর আলোয় মনে

           দেয় দোলা শীতলবায়

সদা মন ছুটে মুক্ত গগনে

                   কার যে আশায়৷৷

ঈশ্বরচন্দ্র

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

জীবে প্রেম মানে ঈশ্বর সেবা

বুঝেছিলে বটে মর্মে,

মেতেছিলে তাই সারাটা জীবন

মানব সেবার ধর্মে৷

মেথর বাগদী চণ্ডাল মুচি

ভাবো নি কারেও ঘৃণ্য,

অন্তর হতে অন্ত্যজ জ্ঞানে

রাখোনি কারেও ভিন্ন৷

পরের দুঃখ পীড়নে সদাই

অশ্রু ঝরতো চক্ষে---

ছিলে অন্ধের ষষ্টির মতো

নির্যাতিতের পক্ষে৷

দারিদ্র্যভারে যারা ছিল শুধু

হতাশায় নিরানন্দ

চক্ষু থেকে ও অশিক্ষা আর

অজ্ঞানে ছিল অন্ধ---

তাদের বাঁচাতে করেছ কত না

অতন্দ্র শুভ চেষ্টা

তাইতো তোমায় প্রণাম জানায়

শ্রদ্ধায় গোটা দেশটা৷

সততার সাধক

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের নাম তোমরা সকলেই শুনেছো---তাই না? তিনি একটি পত্রিকা পরিচালনা করতেন৷ পত্রিকাটির নাম ‘নারায়ণ’৷ তাতে লিখতেন তৎকালীন বড় বড় নামজাদা লেখকরা৷ একবার এক খ্যাতনামা উপন্যাসিকও সেই পত্রিকায় কয়েকটি মূল্যবান প্রবন্ধ লিখলেন৷ প্রবন্ধগুলোর বিষয়বস্তু ছিল রাজনৈতিক৷ যেমন ‘শিক্ষার বিরোধ’, ‘মহাত্মাজী’ ইত্যাদি৷

‘নারায়ণ’-পত্রিকায় যারা লিখতেন দেশবন্ধু তাদের প্রত্যেককেই টাকা দিতেন৷ কিন্তু সেই উপন্যাসিককে টাকা দিতে গিয়ে তিনি মহামুশকিলে পড়লেন৷ অতোগুলো শক্তিশালী লেখার জন্য ঠিক কত টাকা দেওয়া উচিত তা তিনি স্থির করতে পারলেন না৷ কিছুদিন ভেবেচিন্তে অবশেষে তিনি এক অদ্ভুত কাজ করে বসলেন৷ টাকার ঘরটা শূন্য রেখে গোটা চেকটাই পাঠিয়ে দিলেন উপন্যাসিকের কাছে৷ উপন্যাসিক এবার ইচ্ছামতো টাকার অঙ্ক বসিয়ে নিতে পারেন৷

চেকখানি হাতে পেয়ে যৎপরোনাস্তি বিস্মিত হলেন উপন্যাসিক৷ কত সরল মনে, মানুষের প্রতি কতখানি বিশ্বাস নিয়ে দেশবন্ধু এ কাজ করেছেন তা ভেবে তিনি সত্যিই মুগ্ধ হলেন৷ পরমূহূর্তে আবার ভাবলেন, এটাই তো স্বাভাবিক, মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করবে না তো কি পশুকে করবে?

যাইহোক, নির্দিষ্ট দিনে চেকে টাকার ঘরে ন্যায্য সংখ্যা বসিয়ে ব্যাঙ্কে গেলেন৷ চেক ভাঙবার সময় দেখা হলো এখ বন্ধুর সাথে৷ বন্ধু সব শুনে জিজ্ঞেস করলেন, তা চেকে তুমি কত লিখেছো?

উপন্যাসিক বললেন, একশ টাকা৷ ‘মাত্র! ঠোঁট বেঁকিয়ে বন্ধুটি বললেন, তুমি দেখছি নিতান্তই বেকুব৷ আরে দেশবন্ধুর কি টাকার অভাব? কম করে পাঁচশ’ লেখা উচিত ছিল৷’

উপন্যাসিক এবার একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন৷ বললেন, ‘দেখো, পাঁচশ লিখলে চিত্তবাবুর থলির ওয়েট বিশেষ কিছুই কমতোনা জানি এবং তার চিত্তেও এতটুকু আঁচড় পড়তোনা, কিন্তু তাতে করে আমার চিত্তে যে কালি পড়তো তা মুছবার উপায় তুমি আমায় বাৎলে দিতে পারো’?

বন্ধুটি নীরব৷ লজ্জায় মাথা হেঁট৷ কিছুক্ষণ পরে আমতা আমতা করে অন্য প্রসংগ তুলে পালিয়ে গেলেন৷ বলতো কে এই উপন্যাসিকটি? উপন্যাসিকই হলেন আমাদের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ তাঁর জীবনী পড়ে তাঁর যে জিনিসটি দেখে আমি মুগ্দ হয়েছি তা হলো তাঁর সততার সাধনা৷ তোমরা কি পারবে না এইরকম সততার পরিচয় দিতে?

শ্রদ্ধার্ঘ্য

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

সভ্যতার আলোকবর্তিকা

 যাঁরা পৃথিবীকে দেখায়,

তাঁর মধ্যে অন্যতম শিক্ষক৷

 তাঁরা শিক্ষক, তাঁরা পরীক্ষক,

ছাত্র তথা সমাজের

 চিরন্তন অভিভাবক৷

একটি মানুষ সমাজের এক একক,

উপযুক্ত পরিচর্যায় হয় পথ প্রদর্শক৷

একাধিক মানুষ নিয়ে

                   গড়ে ওঠে সমাজ,

সু-শিক্ষা ও সংস্কৃতি

                   সেথা করুক বিরাজ৷

শিক্ষায়, দীক্ষায়,

          সংস্কৃতিতে হলে অগ্রগণ্য,

সমাজ ও দেশ হয় ধন্য ধন্য!

শিক্ষকের নাই কোনো দেশ-কাল-পাত্র,

সবাইতো একান্ত অনুগত ছাত্র৷

তা’কোনো বিদ্যা-মন্দির হোক,

 সমাজ কিম্বা দেশ,

শিক্ষক সৃষ্টি করেন শিক্ষার পরিবেশ৷

 সর্বত্র সকলের মঙ্গলার্থে পথ নির্দেশ,

যুগ-যুগান্তরে এই স্বতঃস্ফূর্ত

সেবার নাই কোনো শেষ৷

সার্থক হয় শিক্ষকের নিঃস্বার্থ শিক্ষাদান,

যুবসমাজের লক্ষ্য হোক

 দেশের কল্যান,

আজ শুভদিনে শ্রদ্ধা নিবেদনে

 তাঁদের বিনম্র প্রনাম৷

কবরেজ মশায় ৰাঁচিয়ে দিলেন

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

সত্যিকারের ক্লান্তিচ্ছেদ করতে গেলে খুব সতর্ক হয়ে কথা ৰলতে হয়৷ মনে করো কোন একটি ছেলে পরীক্ষায় ফেল করেছে৷ কারও সঙ্গে কথা ৰলছে না৷ তিন মুণ্ডু এক করে ৰসে আছে (দু’হাটু আর মুণ্ডু তিনে নিয়ে তিন মুণ্ডু) খেতে চাইছে না, শুতে চাইছে না৷ ৰাড়ীর লোকের ভয় ছেলেটা হয়তো পুকুরে ডুবৰে .....হয়ত বা রেলে গলা দেৰে৷ গ্রামের ৰুড়ো কবরেজ মশায় খবর শুণে ছুটে এলেন৷ আহা! ছেলেটা যদি মরে ৰড় দুঃখের হৰে৷ এই সতর ৰছর বয়সে সীতার ভূমিকায় যা অভিনয় করে তা এককথায় অনবদ্য৷ কৰরেজ মশায় রামভক্ত, তাই সীতা মরে যাবে ভেবে তার প্রাণটা খাঁ খাঁ করে উঠল৷ আৰার কিছুদিন আগে কেষ্টযাত্রায় রাধিকার ভূমিকায় ছেলেটা এমন প্রাণ সঞ্চার করেছিল যে বৃন্দাবন কেন, টুণ্ডুলা ইষ্টিশানও কেঁপে উঠেছিল......যমুনার জল সরে নীচেরটা একেৰারে ফুটিফাটা হয়ে গেছল৷

কৰরেজ মশায় পরম বৈষ্ণব৷ তিনি সীতাকেও মরতে দিতে পারেন না.....রাধিকাকেও মরতে দিতে পারেন না৷ তাই তিনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন৷ ডান পায়ের খড়মটা ঠিকই ছিল, বাঁ পায়ের খড়মটা বাঁশঝাড়ে আটকে সেখানেই পড়ে রইল৷ তিনি এসে ছেলেটাকে শুধোলেন–‘‘হাঁ রে, ওই রকম তিন মুণ্ডু হয়ে ৰসে আছিস ক্যানে এবার তোদের যা অভিনয় হইয়েছিল যারা দেখেছে তারা জীবনেও ভুলৰ্যে না৷ এখন কোন নাটকের রিহার্সাল দিচিস’’

ছেলেটার মনমেজাজ তখন ভীষণ খারাপ৷ সে মুখ ওপরে না তুলে ৰললে, ‘‘ওই নাটক করতে গিয়েই তো এই দশা হয়েছে৷ আর নাটক–টাটক নয়’’৷

কৰরেজ মশায় শুধোলেন–‘‘এখন এই ইস্কুলে পড়বি না অন্য ইস্কুলে যাব্যি’’

সে কান্নায় ফুঁপিয়ে উঠে ৰললে, ‘‘এবার যমের ইস্কুলে পড়তে যাৰ’’৷

কৰরেজ মশায় ৰললেন, ‘‘তুই কতবার ফেল্ করেছিস’’

ছেলেটা ৰললে–‘‘এই নিয়ে পাঁচবার’’৷

কৰরেজ মশায় ৰললেন–তবে ওতো আমার কাছে নস্যি রে৷ আমি প্রতিটি ক্লাসে একবার ফেল করেছি, পরের বার পাশ করেছি৷ আর ক্লাস টেনে রগড়েছি আট বার৷ ন–ৰারের ৰেলায় একেৰারে ফার্ষ্ট ডিবিশনে সংস্কৃতে লেটার পেয়ে পাশ করেছি৷ আজ দেখ আমি একজন নামজাদা কৰরেজ৷ বদ্দমান জেলার মানকড়ের, শ্রীখণ্ডের, কোগ্রামের (কুমুদগ্রাম) সব জায়গার তাগড়া তাগড়া বদ্যিরা আমাকে ডাকসাইটে বদ্যি ৰলে সম্মান করে৷ নাড়ি ছোঁবার আগেই নিদান দিয়ে দি’৷ আর তুই তিন মুণ্ডু হয়ে দামী সময় নষ্ট করছিস্৷ এখ্খুনি উঠে পড়ত্যে ৰোস৷ এই ইস্কুলেই পড়বি, কারণ এই ইস্কুলের শিক্ষকদের ঘাঁত–ঘোঁত সৰই তোর জানা৷ হাঁ, হাঁ, আমিই একটা ভুল করনুম৷ আগে চাট্টি গুড় মুড়ি খেয়ে নে, তারপরে পড়ত্যে ৰোস৷ হ্যাঁ, এর পর যে নাটকটার রির্হার্স্যাল দিৰি আমাকে আগে থাকতে জানাৰি৷ অভিনয়ের দিন আমিও গ্রীণরুমে গিয়ে ৰসে থাকৰ’’৷

এটাই হ’ল সত্যিকারের ক্লান্তিচ্ছেদ...........ৰুঝলে৷                      (শব্দ চয়নিকা, ১১/২১৪)