প্রভাতী

দশাননের মুণ্ডুপাত

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

আমি যেখানকার কথা বলছি সেখানে যাত্রাগানের পালা ছিল ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’৷ যাত্রাদলের বিবেকের কাজ হচ্ছে গানের মাধ্যমে যে ঘটনা হচ্ছে বা হতে চলেছে তার একটা আভাস দেওয়া৷ কিন্তু এখানকার বিবেক সে পথ না মাড়িয়ে রাবণের বিরুদ্ধে জমিদারৰাৰুকে চটিয়ে দিয়ে বখশিসের ব্যবস্থা করতে চাইল৷

          ‘‘রাবণ আসিল জুদ্দে পইর্যা ৰুট জুতা,

          হনুমান মারে তারে লাতি–সর–গুতা৷

          সর কাইয়া রাবণ রাজা জায় গরাগরি,

          হনুমান বলে, ‘‘তোরে মাইরাসি সাপরি৷৷

          সাপর মারিনি তোরে মাইরাসি সাপরি’’৷

          সাপর মারিলে তুই জইতিস জমের বারি’’৷৷

জমিদারৰাৰু মহা খুশী৷ তিনি সঙ্গে সঙ্গে খাজাঞ্চিকে ডেকে বললেন–‘‘বিবেকডারে দশডা টাহা বক্শিস দাও৷’’ রাবণের ভূমিকায় যে নেৰেছে সে নিষ্ঠার সঙ্গে পার্ট করে চলেছে৷ অস্ত্রের ঝনৎকার....পৌরুষের চরম অভিব্যক্তি৷ রাম একেবারে কোণঠাসা৷ ভয়ে ভাবনায় দুশ্চিন্তায় রামের মুখে কথা সরে না৷ সে এক অসহনীয় পরিস্থিতি! জমিদারৰাৰুর তা সহ্য হ’ল না৷ তিনি বললেন–‘‘রাবণডার এ্যাকডা মুণ্ডু কাইট্যা ফ্যালাইয়া দাও৷ আস্পর্দা কত! দশানন! দশানন! আজ তাইক্যা নয়ানন অইয়া গেল৷’’

তোমরা জানো, নাটকের রাবণের একটা আসল মুণ্ডু থাকে আর বাকী নয়টা নকল মুণ্ডু৷ জমিদারের পাইক–বরকন্দাজরা একটা নকল মুণ্ডুকেটে দিলে৷ রাবণ লক্ষ্মণের ওপর চরম আঘাত হেনেছে...লক্ষ্মণের শক্তিশেল৷

হনুমান ছুটেছে মৃতসঞ্জীবনীর খোঁজে... বিশল্যকরণীর খোঁজে৷ রাক্ষসদের শিবিরে আনন্দের গুঞ্জরণ, রামের শিবিরে শোকের রোল, ক্রন্দনের আর্ত্তনাদ৷ জমিদারৰাৰু আর সহ্য করতে পারলেন না৷ তিনি বললেন–‘‘হারামজাদাডার অহনও আক্কেল অয় নাই৷ ওর আর্যাকডা মুণ্ডু কাইট্যা লও৷ দশানন! দশানন! আজ তাইক্যা আটানন অইয়া গেল৷’’

এর পরের দৃশ্য ঃ চাকা ঘুরে গেছে৷ লড়াইয়ে রাবণের হার হয়ে চলেছে৷ রাবণ কাতরভাবে শিবের উদ্দেশ্যে বলছেন–শিব, তুমি আশুতোষ৷ যত পাপই করে থাকি না কেন, আমি তোমার সন্তান৷ তুমি কৃপাদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাও৷ তোমার কৃপা ছাড়া আমার জয়ের তো কোনো পথই নেই, বাঁচবারও কোনো পথ নেই৷

রাবণ কাতরস্বরে বলে চলেছেন আর অঝোরে কেঁদে চলেছেন৷ দৃশ্য দেখে জমিদারৰাৰুর মনে দয়া হ’ল৷ তিনি বললেন–‘‘রাবণডার দুঃখু দেইখ্যা মন–প্রাণ বিগলিত অইয়া জায়৷ আহাহা, আহাহা! ওর মুণ্ডু দুইডা আবার জোড়া লাগাইয়া দাও৷ আবার ওরে দশানন কইর্যা দাও৷’’

শরণ

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

তোমার চরণছাড়া ধরার কিছুই নাইগো---

ওই চরণে শরণ নিতে চাই গো৷

ধরবো কারে কেউ তো নেই দাঁড়িয়ে

তুমিই কেবল হাতটি আছো বাড়িয়ে৷

মাথায় রেখো ওই হাত সদাই গো

তোমার চরণ ছাড়া ধরার কিছুই নাই গো৷

 

আমি মাতবো না আর হেলা ফেলার খেলাতে

ঘুরবো না আর হট্টগোলের মেলাতে৷

সকল কাজে তোমারি মান রাখবো,

সরবো না আর, তোমায় ঘিরেই থাকবো

তোমার পানেই চাই শুধু আজ চাই গো

তোমার চরণছাড়া ধরার কিছুই নাইগো৷৷

কাণ্ড

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

গোপনে কাউকে উপদেশ–নির্দেশ দেওয়াকেও ‘কাণ্ড’ বলা হয়ে থাকে৷ সবাইকে সদুপদেশ সকলের সামনে দেওয়া যায় না৷ এই যে ব্যষ্টিগতভাবে কাউকে উপদেশ দেওয়া, একেও বলা হয় ‘কাণ্ড’৷

গোপনে পরামর্শ দেওয়া বলতে একটা ছোট্ট গপ্প মনে পড়ে গেল৷ তোমরা পা ছড়িয়ে বসে মুড়ি–আলুর চপ খেতে খেতে গপ্পটা শোনো৷

এক ছিল বামুণ ........ এক ছিল বামণী৷ বামণী ছিল বড় দজ্জাল৷ বামুণকে সব সময় জ্বালা দিত৷ বামুণ যখন যেটি বলত বামণী তাতে তাকে খেঁকিয়ে তো উঠতই আর করত তার উল্টোটা৷ একবার বামুণ বামণীকে বললে, ‘‘দেখ বামণী, এই আসছে হপ্তায় আমার পিতাঠাকুরের বাৎসরিক শ্রাদ্ধ৷ শ্রাদ্ধটা তো করতেই হবে৷ তাই সব ব্যবস্থা–ট্যাবস্থা করে রাখ’’৷

বামণী বললে, ‘‘কী! কার শ্রাদ্ধ! ওসব শ্রাদ্ধ–টাদ্ধ কোন ভুতের হতে দোব না’’৷

বামুণ বললে, ‘‘ভুতের নয়, আমার পিতাঠাকুরের’’৷

বামণী বললে, ‘‘তোমার পিতাঠাকুর কি এখন জলজ্যান্ত রয়েছে! ভুত নয় তো কী! ওই শ্রাদ্ধ–পিণ্ডি–টিণ্ডি আমি এ বাড়ীতে হতে দোব না .......... দোব না...... দোব না – এই বলে রাখলুম, তুমি নিকে রেখে দাও’’৷

বামুণ দেখলে বেগতিক৷ বামুণ তখন জয়–মা–কালী বলে সেখান থেকে পিঠ–টান দিলে৷ গিয়ে পৌঁছুল সোজা তার গুরুর খিড়কি–দোরের সামনে৷ গুরুঠাকুর তাকে দেখে শুধোলেন, ‘‘হ্যাঁ গা, এই বে–টাইমে ছুটতে ছুটতে এসেছ কেন কী হয়েছে’’

বামুণ তার দুঃখের কথা সবিস্তারে গুরুকে নিবেদন করলে৷

গুরুঠাকুর বললেন, ‘‘হ্যাঁ, এটা একটা ভাববার মত কথা’’৷

তারপর গুরু বামুণের কাণে কাণে একান্তে একটা গোপন মন্ত্র দিয়ে দিলেন৷ বামুণ সেই মন্ত্র জপ করতে করতে ঘরে ফিরে এল৷ বামুণ ফিরে এসে দেখে – বামণী একথালা ভাত আর সাতাশ ব্যঞ্জনের বাটি নিয়ে পা ছড়িয়ে বসে বসে খাচ্ছে আর তারিয়ে তারিয়ে শোজনের ডাঁটা চিবোচ্ছে৷ বাঁ–হাতে চেপে ধরে রেখেছে জল–ভর্ত্তি একটা প্রকাণ্ড খাগড়াই কাঁসার ঘটি৷

বামুণের আর তর সইল না৷ মন্ত্রের ফলাফল দেখবার জন্যে সে বামণীর কাছে এসে বললে, ‘‘দেখ বামণী, তোর কথাটাই রাখলুম৷ এ বৎসর আর পিতাঠাকুরের শ্রাদ্ধ করব না’’৷

বামণী বললে, ‘‘কী! কার এত বড় আস্পর্দ্ধা যে বলে শ্বশুরঠাকুরের শ্রাদ্ধ করব না৷ শ্বশুরঠাকুরের শ্রাদ্ধ করতেই হবে৷’’

বামুণ বললে, ‘‘যদি করতেই হয় তাহলে গঙ্গার ঘাটে একটা সস্তার পুরুৎ ডেকে এনে নমোনমঃ করে সারব’’৷

বামণী বললে, ‘‘এ্যাঁ, সে কী কথা! আমার বাড়ীর সম্মান নেই! ভাল ভট্চায্–পুরুৎকে দিয়ে শ্রাদ্ধ করাতে হবে৷’’

বামুণ বললে, ‘‘তা না হয় হ’ল, কিন্তু এবার আমার পয়সার টানাটানি৷ যজমান বাড়ী থেকে তেমন কিছু পাই নি৷ আলুর চাষ এবার মার খেয়েছে৷ তাই হয় গোণাগুণতি পাঁচটি বামুণকে খাওয়াব, না হয় একটা ভুজ্যি দিয়ে দোব’’৷

বামণী বললে, ‘‘ছিঃ! এ কী লজ্জার কথা! অন্ততঃ পাঁচশ’ লোককে খাওয়াতে হবে৷ টাকার অভাব থাকলে আমি আমার এই দশ ভরির পাটিহার ছড়াটাকে বেচেও টাকার ব্যবস্থা করে দোব৷’’

সব কাজ ঠিকঠাক চলছিল৷ বামুণ মহা খুশী৷ গুরু–ঠাকুরের মন্ত্র ঠিক ঠিক ফল দিয়ে চলেছে৷ এমন সময় বামুণ আনন্দে অধীর হয়ে মন্ত্রটাই ভুলে গেল৷ গুরুর দেওয়া গোপন মন্ত্র বিস্মৃতিতে চলে গেল৷ সপিণ্ডকরণের পর বামুণ বামণীকে বললে, ‘‘দেখ বামণী, এই আলো–চাল, তিল আর শ্রাদ্ধের অন্যান্য উপকরণগুলো – যা, গঙ্গার জলে বিসর্জন দিয়ে আয়৷’’

বামণী বললে, ‘‘কী, এত বড় আস্পর্দ্ধা! এইসব আজে বাজে জিনিস আমি গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে আসব! এই সবগুলো আমি নালীতে ফেলব..... ফেলব.... ফেলব..... ফেলব৷’’

বামুণ তো থ’৷ মন্ত্রের গোপনীয়তা হয়তো ছিল কিন্তু মন্ত্রের মূল্যজ্ঞান ও মাত্রাজ্ঞান বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছল৷ তাই না এই ফ্যাসাদ হল৷

তা তোমরা বুঝলে, গুরুঠাকুর বামুণকে যে গোপন নির্দেশ দিয়েছিলেন তাকেও ‘কাণ্ড’ বলা হয়৷

আর্তি

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

হে আচার্য, আজ আমারো কাণে মন্ত্র দাও দিকি---

আমি ও কবি হব---যেমন হয়েছিলেন বাল্মিকি

রাম নাম মন্ত্রে৷

আজ আমাকেও দীক্ষিত করো তন্ত্রে৷

আমিও লিখবো এক মহাজীবনের কথা---

যে-জীবন কখনো নীলকন্ঠ, কখনো কারাবাস---

তবু ও যে জীবন হয়নি স্তব্ধ,

হয়নি রাষ্ট্রীয় ত্রাসের দাস৷

আমি যে দেখেছি তাঁকে, কল্পলোকে নয়,

এই মাটির পৃথিবীতে

দুই নয়নের মুগ্দ দৃষ্টিতে৷

আমি যে দেখেছি তাঁকে অস্থি-মাংস সহ,

ক্ষণে ক্ষণে স্মরণে তাই মনে জাগে বিরহ দুঃসহ৷

সহধর্মীনীর অসহযোগে তিনি তো হননি বিহ্বল,

তাঁর কর্মযোগী, ত্যাগব্রতী গৈরিক ভক্তরা যখন

অগ্ণি-দহনে করছিল মরণকে বরণ,

তখনো তাঁর আদর্শের দীপশিখা হয়নি নির্বাপিত,

বরঞ্চ ঘাতকের পাতকের দল

জন-মানস থেকে হয়েছে নির্বাসিত৷

আজ তারা বিধবস্ত ধিকৃত, হেয়---

যেন খেদানো রাস্তার সারমেয়৷

 

হে আচার্য, আজ আমারো কাণে মন্ত্র দাও দিকি---

আমিও কবি হব--- যেমন হয়েছিলেন বাল্মিকী৷

আজ আমি করেছি মনোস্থির ---

সেই মহাজীবনের কথায় গড়ে তুলবো

আমার কাব্যের শরীর৷

বর্ণের বন্ধনী ছিন্ন করে

কাব্যের অক্ষরে অক্ষরে উৎসারিত

মুখরিত হবে তাঁর জীবনের অমৃতবাণী,

পঠনে মননে শ্রবণে অপসৃত হবে আত্মগ্লাণি৷

 

হে পাঠক, একথা সত্য, নই আমি

কবি-যশ-প্রার্থী-

আমার কাব্যে প্রচারিত হবে

সেই মহাজীবনের কথা---

এই আমার আর্তি৷

 

হে পাঠক, কাব্যে আমার থাকবে পাতা

তাঁরই আসন,

শুণবে তোমরা কাণে কাণে

তারই ভাষণ

এসে গেছে সেই শুভক্ষণ,

কর-জোড়ে করি তাই নিবেদন---

হে আচার্য, আজ আমারো কাণে মন্ত্র দাও দিকি---

আমিও কবি হব--- যেমন হয়েছিলেন বাল্মীকি৷

সৌরজগতে দোল

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

প্রাচীনকাল থেকে ভারতে নানা নামে, নানা পদ্ধতিতে সূর্যপূজা ও সূর্যের প্রতীক উপাসনা হয়ে আসছে৷ আমাদের দোলযাত্রার ধর্মীয় রীতিতেও সৌরজগতের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়৷

ফাল্গুনী পূর্ণিমার দোল হচ্ছে বিষ্ণুর দোল৷ যেসব অঞ্চলে বিষ্ণু মন্দির আছে সেখানে মন্দিরের অনতিদূরে একটি মণ্ডপ তৈরি করা হয়৷ মণ্ডপের চতুর্দিক থাকে অনাচ্ছাদিত৷ চারকোণে চারটি খুঁটি৷ শুধু মাথার ওপর থাকে একটি চাঁদোয়া৷ মণ্ডপে বেদী তৈরি করে বিষ্ণুর রূপক শালগ্রাম শিলা স্থাপিত হয়৷ সন্ধ্যার আগে মন্দির থেকে বিষ্ণুর বিগ্রহ মণ্ডপে এনে বেদীতে বসিয়ে তাঁর পূজা ও হোমসম্পন্ন হয়৷ তারপর বিগ্রহের সিংহাসন তিনবার উত্তর-দক্ষিণে দোলানো হয়৷ বিষ্ণুকে এই দোলানোর মধ্যেই নিহিত আছে দোলযাত্রার উৎস৷ বিষ্ণু শব্দের অর্থসূর্য৷ বিষ্ণু হচ্ছে চালনী শক্তি যা সূর্যে নিহিত আছে৷ সূর্যতাপ ও আলোক বিকিরণ করেন বলেই প্রাণী ও উদ্ভিদ বেঁচে আছে৷ গুণ কর্মের বিশ্লেষণে বিষ্ণু ও সূর্য, অভিন্ন৷ সূর্যের দক্ষিণায়ন ও উত্তরায়নের দিকে তাকিয়েই ‘যাত্রা’ শব্দটি প্রযুক্ত হয়েছে৷ ‘অয়ন’ মানে গতি৷ সূর্যের দক্ষিণাগমন আর উত্তরাগমনের জন্যই বলা হয়েছে দোলযাত্রা৷ ‘যাত্রা’ মানে ও তো গমন৷ বিষ্ণুর দোলন আর বিষ্ণুরূপ সূর্যের উত্তর দক্ষিণযাত্রা--- দুই নিয়ে দোলযাত্রা৷

বিগ্রহের সিংহাসন তিনবার উত্তর-দক্ষিণে দোলানোর মধ্য দিয়ে বিষ্ণুর ত্রিপদক্ষেপের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়৷ সূর্যের উত্তর দক্ষিণে গমনাগমনে বিষ্ণুর তিনটি পদক্ষেপ-স্থান পাওয়া যায়৷ কর্কটক্রান্তি, মকরক্রান্তি ও বিষুবরেখা৷ দক্ষিণায়ন শুরুর পরদিন অর্থাৎ ২২ জুন সূর্যের অবস্থান বিষ্ণুর একটি পদক্ষেপ, দ্বিতীয় পদক্ষেপ ২৩ সেপ্ঢেম্বর, শরতে বিষুব রেখায় সূর্যের অবস্থান ও ২২ ডিসেম্বর দক্ষিণায়নের শেষ দিনে সূর্যের অবস্থান তৃতীয় পদক্ষেপ রূপে কল্পিত হয়৷ বিষ্ণুর এই ত্রিবিক্রম হচ্ছে সূর্যের বার্ষিক গতি৷

দোলনপর্ব সাঙ্গ হলে বিষ্ণুমূর্ত্তির অঙ্গে ফাগ স্পর্শ করে তা প্রসাদে রূপান্তরিত করা হয়৷ সেই ফাগ সকলে কপালে মাখেন৷ দোলের সময় লাল ফাগ দিয়ে শালগ্রামরূপী সবিতার অঙ্গ ভূষিত হয়৷ সূর্যেরই আরেক নাম সবিতা, সবিতা হিরণ্যময়৷ শীতকালে শিশুরবিকে লোহিত বর্ণ দেখায়৷ তাই বুঝি লালসূর্যকে লাল আবীর দিয়ে বন্দনা করা হয়৷ বিষ্ণুকে বলা হয় সহস্রশিরা৷ বিষ্ণুর সহস্র শির হচ্ছে সূর্যের অসংখ্য রশ্মি৷ পিচকারির সাহায্যে যে তরলরঙের ধারা নিক্ষিপ্ত হয় তা ও বিচ্ছুরিত সূর্য রশ্মিরই প্রতীক৷

নব সাজে ধরা

শুষ্ক কাঠিন্য রিক্ততা জীর্ণ

কঙ্কালসার অরণ্য-উদ্যান,

 শীতের যবনিকা পতন,

 বসন্তের উত্থান৷

পাতা ঝরা রুক্ষ বন

 ভূলে অভিমান,

আমন্ত্রণ করেছে গ্রহণ

 সবুজের আহ্বান৷

 

বিবর্ণ কানন বীথি ক্রমে

 কচি কিশলয়ে ভরে

 সবুজ শ্যামলিমা,

রূপ-মুগ্দ কবিদের ভাষায়

 ‘রূপে অনুপমা’৷

বঙ্গ প্রকৃতির ঋতু রঙ্গশালায়

 তার বাৎসরিক পরিক্রমা!

 

নাম------ বসন্ত,

কাঙ্খিত উপস্থিতি উভয় বঙ্গে

শিমুল-পলাশ-কৃষ্ণচূড়া সঙ্গে,

 মৃদু মলয় কত কথা কয়

শিস দিয়ে দিবানিশি

 বহে অন্ত্যোদয়!

ধান ক্ষেতে ঢেউ খেলে

 নৃত্যের বিভঙ্গে!

কোকিলের ‘কুহু’ সুরে

                    সুখ-নিদ্রা ভঙ্গে,

হালকা শিশির সিক্ত ঘাষে ঘাষে

ঋতুরাজের রাজকীয় আবির্ভাব,

সবুজের সমারোহ---

নবরূপে সজ্জিত প্রকৃতি

 নাই কোনো অভাব!

 

নব পল্লবে মুকুলিত আম্র কানন,

সবুজে সবুজ ভরা অবুঝের মন!

বকুল-সুরভী ভরা শাখায় শাখায়,

মধুপ গুঞ্জরণে কি গান শোনায়?

 

নির্মোঘ গগনে দখিনা পবনে

কুজ্ঝটিকা সরে যায়

 সূর্যের কিরণে৷

দু’হাতে কুসুম ছড়ায়ে

 ঋতুরাজকে বরণ,

আশার আলোয় ভরা

 উদ্ভাসিত জীবন৷

তাঁহার স্নেহের পরশে

 শুধু নয় ফুলবন,

মনোবন ছুঁয়ে গেছে

 হিন্দোলিত শিহরণ!

মোসাহেৰ

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

কথায় বলা হয়, খোসামদে পাহাড়ও গলে মাখন হয়ে যায়৷ খোসামদে দুর্বাসা মুনিও গলে যান৷ সেই খোসামদের জন্যে ‘কাণ্ড’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়৷ ‘খোসামদ’ শব্দটি এসেছে ফার্সী ‘খুসামদ’ থেকে৷ অনেকে ‘খুসামদ’–কে মার্জিত রূপ দেবার জন্যে ‘তোষামোদ’ ৰলে থাকেন৷ না, ‘তোষামোদ’ ৰলে কোনো শব্দ নেই৷ শাস্ত্রে ৰলেছে, খোসামদকারীর প্রতি মুহূর্তেই প্রতি পদবিক্ষেপেই অধোগতি হয়, কারণ সে প্রতি মুহূর্তে, প্রতি পদবিক্ষেপে কেবল স্বার্থচেতনায় অস্বাভাবিক কাজ করে থাকে৷ আগেকার দিনে রাজাদের বা অবস্থাপন্ন লোকেদের বেতনভুক খোসামদকারী থাকত৷ তাদের ৰলা হত মোসাহেৰ–যারা সৰ সময় নিজেদের কর্ত্তাকে ‘সাহেৰ’, ‘সাহেৰ’ ৰলে তুষ্ট রাখবার চেষ্টা করে৷ আরৰী ব্যাকরণ অনুযায়ী ওই ‘সাহিৰ’ শব্দটির আদিতে ‘মু’ সংযুক্ত করে তাদের ৰলা হয় মুসাহিৰ বা মোসাহেৰ৷ এইভাবে বিভিন্ন গুণের সঙ্গে ব্যষ্টির সংযোগ সাধন করে ক্রিয়া বা বিশেষ্যের আদিতে ‘মু’ যোগ করে আরৰীতে বিভিন্ন শব্দ সৃষ্ট হয়ে থাকে৷ যেমন মুয়াল্লিন, মুয়াজ্জিন (যিনি আজান দেন), মুজাহিদ (যিনি জেহাদ বা ক্রুসেডে অংশগ্রহণ করেন), মুহাজির (যিনি অন্য দেশ থেকে এসে হাজির হয়েছেন অর্থাৎ রেফিউজী), মুসাফির (যিনি সফর বা ভ্রমণ করে চলেছেন) প্রভৃতি৷ সেই যে মোসাহেৰের একটা গল্প আছে না!

রাজামশায়ের একজন মোসাহেৰ চাই৷ তিনি খৰরের কাগজে যথাৰিধি কর্মখালির বিজ্ঞাপন দিলেন৷ জানিয়েও দিলেন, ‘‘আবেদনকারীকে দরখাস্তের সঙ্গে ৫০০ টাকার ক্রশ চেক দিতে হৰে যা প্রত্যর্পণযোগ্য নহে৷ হাজারে হাজারে দরখাস্ত এল৷ লিখিত পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষা চলছে৷ রাজামশায় বসে রয়েছেন৷ তাঁর সিংহাসনের বাঁ হাতলটা ধরে ঘাড় বেঁকিয়ে মন্ত্রীমশায় একটু কেতরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন৷ এক একজন কর্মপ্রার্থী আসছেন ইন্টারভিউ (সংজ্ঞ–প্রতীতি) দিতে৷

রাজামশায় প্রথম জনকে জিজ্ঞেস করলেন–‘‘তুমি কি মোসাহেৰের কাজ পারৰে’’

সে ৰললে–‘‘নিশ্চয় পারব, জাঁহাপনা৷’’

রাজামশায় তার নাম খারিজ করে দিলেন৷ দ্বিতীয় কর্মপ্রার্থী এলেন–একজন চালাক–চতুর যুবক.......চোখে মুখে খই ফুটছে৷

রাজামশায় তাকে ৰললেন–‘‘মোসাহেৰের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরু দায়িত্ব! তুমি কি এ কাজ পারৰে’’

কর্মপ্রার্থী ৰললে–‘‘একবার চান্স দিয়ে দেখুন শাহানশাহ্, আমি নিশ্চয় পারৰ৷’’ রাজা তাকেও না–পসীন্দ*(*শব্দটা ফার্সী৷ তাই ‘না–পছন্দ’ না ৰলে ‘না–পসীন্দ’ ৰলাই ৰেশী ভাল৷ তবে এর ৰাংলা রূপ হিসেৰে ‘না–পছন্দ’ও চলতে পারে’৷) করলেন৷ ৰলা বাহুল্য, এরও চাকরী হ’ল না৷

পরের কর্মপ্রার্থীটি খুৰই শিক্ষিত কিন্তু ইন্টারভিউ কেমন হৰে তাই ভেৰে সে পৌষের শীতেও ঘেমে গেছল........রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে সে রাজার সামনে এসে দাঁড়াল৷

রাজামশায় তাকে শুধোলেন–‘‘মোসাহেৰের এই মহান কর্ত্তব্যে তুমি কি সমর্থ’’

উৎসাহের অগ্ণিতে প্রদীপ্ত হয়ে কর্মপ্রার্থীটি ৰললে–‘‘নিশ্চয়ই পারৰ৷ একশ’ বার পারৰ, স্যার......কথা দিচ্ছি স্যার....কেবল একবার একটা চান্স দিন স্যার.... just a chance please’’

রাজামশায় তাকেও বাতিল করে দিলেন৷ এবার যে ছেলেটি এল তার চোখে–মুখে বুদ্ধির ঝলক ছিল কিন্তু প্রজ্ঞার গভীরতা ছিল না৷

রাজামশায় তাকে শুধোলেন–‘‘খোসামদের কাজটা তুমি কি পারৰে’’

সে বললে–‘‘সত্যিই রাজাসাহেৰ, খোসামদের কাজটা আমি কি পারৰ!’’

রাজামশায় ৰললেন–‘‘হ্যাঁ, তবে চেষ্টা করে দেখতে পারো৷’’

সে ৰললে–‘‘হঁ্যাঁ, তবে চেষ্টা করে দেখতে পারি৷’’

রাজামশায় আড়চোখে মন্ত্রীর দিকে চাইলেন৷ মন্ত্রী ৰললেন–‘‘মহারাজ, ইনিই সর্ৰগুণান্বিত, এঁকেই ৰহাল করুন৷ আজকের দিনে ইনিই বিশ্বমানবতার প্রতিভূ......জয়মাল্য পাবার ইনিই অধিকারী৷’’

রাজামশায় প্রার্থীকে ৰললেন–‘‘ৰুঝলে হে, আজ থেকে তোমার চাকরী হল৷’’

তাহলে ৰুঝলে ‘কাণ্ড’ ৰলতে এই খোসামদকে ৰোঝায়৷ সংস্কৃতে কিন্তু মোসাহেৰকে ৰলা হয় ‘বিদুষক’৷ ‘মোসাহেৰ’ অর্থে সীমিত ক্ষেত্রে সংস্কৃতে ‘ভাণ্ড’ শব্দটিও চলত যার থেকে ৰাংলার ‘ভাঁড়’ শব্দটি এসেছে (যেমন–গোপাল ভাঁড়)৷ তবে ‘ভাঁড়’ ৰলতে ক্লাউনকেও ৰোঝায়৷ ‘‘আর ‘ভাঁড়ামি’ করতে হবে না’’–এমন কথা যখন আমরা বলে থাকি তখন কিন্তু সেটা ‘ভাণ্ড’ বা ‘ভাঁড়’ থেকে আসছে না, আসছে ‘ভণ্ড’ থেকে অর্থাৎ ভণ্ডামি অর্থে ‘ভাঁড়ামি’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷

নাছোড়বান্দা চাটুকার

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

পৃথিবীর সব দেশেই, এমনকি সব শহরেই কিছু সংখ্যক খুশামুদে ও উন্নত মানের অনারারী

          মুসাহিৰ আছে৷ মাইনে পাওয়া মুসাহিৰদের চেয়েও অনারারী মুসাহিৰেরা আরও ৰেশী মুসাহিৰী করে থাকে৷ একটা গল্প বলি শোনো–

সে আজ প্রায় ৪০–৪৫ বছর আগেকার কথা৷ আমাদের শহরে একজন নামজাদা ডাক্তার ছিলেন৷ ধরো, তাঁর নাম অরুণ বাঁড় জ্জে৷ ডাঃ বাঁড় জ্জের যেমন ছিল হাত–যশ, তেমনি ছিল পসার৷ রোজগার করতেন দু’হাতে, দান–ধ্যানও করতেন দু’হাতে৷ এই অমায়িক পরোপকারী মানুষটির দরজা থেকে কোনো অভাবী মানুষকেই কখনও নিরাশ হয়ে ফিরতে হত না৷ স্বাভাবিক নিয়মেই তাঁকে ঘিরে তৈরী হয়েছিল একটি খুশামুদে–চক্র৷ তিনি পসন্দ না করলেও এই খুশামুদেদের মধ্যেও কয়েকজন ৰেশ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও দক্ষ মুসাহিৰ ছিলেন৷

ডাঃ বাঁড় জ্জে ছিলেন খুবই মাতৃভক্ত৷ শিশুপুত্রকে নিয়ে বিধবা হয়ে তাঁর মা কায়ক্লেশে পুত্রকে মানুষ করে তুলেছিলেন৷ একথা ডাঃ বাঁড় জ্জে সবাইকে বলতেন৷

ডাঃ বাঁড় জ্জের মায়ের বাড়াবাড়ি অসুখ৷ ডাক্তারেরা জৰাব দিয়ে গেছেন৷ তাঁরা বলেছেন–রোগিণী ৰড় জোর আর দিন দু’য়েক বাঁচতে পারেন৷ ডাঃ বাঁড় জ্জে সেবা–যত্নের কোনো ত্রুটি করছেন না৷

কাগে–কোকিলে মুসাহিৰদের কানে খবরটা তুলে দিলে৷ তারা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়তে দৌড়তে ডাঃ বাঁড় জ্জের বাড়ী ঘিরে ভীড় জমাতে লাগল৷ কেউ বললে–মাসীমা এমন ভাবে আমাদের ফেলে চলে যাবেন এ আমরা স্বপ্ণেও ভাবিনি৷ কেউ বললে–মাসীমা আমাদের মায়া কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন এ যে দুর্বিষহ৷ ডাঃ বাঁড় জ্জে আস্তে আস্তে বললেন–আমার মা’কে আগে মরতে দিন৷ কেউ বা কোমরে গামছা ৰেঁধে, হাতে বাঁশ–কাটারি–দড়ি নিয়ে উপস্থিত হয়ে বললে–মাসীমা ছিলেন সত্যিই পুণ্যশ্লোকা৷ এরকম মহীয়সী মহিলার কথা আমরা কোনো বইয়েই পড়িনি, আর কখনও কারো মুখেও শুনিনি৷ ডাঃ বাঁড় জ্জে আবার আস্তে আস্তে বললেন–আমার মা’কে আগে মরতে দিন৷ যেসব মুসাহিৰ একটু পেছিয়ে পড়েছিল অর্থাৎ একটু বিলম্বে খবর পেয়েছিল তারা তাদের আফশোষ পুরো করে নিতে কসুর করলে না৷ কেউ বললে– মাসীমা যেমন ছিলেন তাতে তাঁর গতি শিবলোকেই হবে৷ কেউ কেউ উৎসাহের আধিক্যে বলে ফেললে–গত মাসের ৪০টা দিনই আমি তাঁকে একাদশী করতে দেখেছি৷ কেউ বা বললে–তাঁর গতি অবশ্যই বৈকুণ্ঠে৷ শিবলোকে গিয়ে তিনি হৰিষ্যি খেতে যাবেন কোন্ দুঃখে! বৈকুণ্ঠে গিয়ে পোলাও–কালিয়া খাবেন৷ কেউ বা বললে–একজন জ্যোতিষী আমাকে বলেছিলেন, মাসীমার জন্যে গোলোকধামে একটা স্থান নির্দিষ্ট করে রাখা আছে৷

ডাঃ বাঁড়ুজ্জে আর সহ্য করতে পারছিলেন না৷ তিনি বললেন–আপনারা কথাবার্ত্তা বলুন, আমি এক্ষুনি আসছি৷ মুসাহিৰদের দল হাঁ হাঁ করে উঠে বললে–সে কী কথা! সে কী কথা! আপনি কোথায় যাবেন! যাবার জন্যে তো আমরা তৈরী হয়েই এসেছি৷ ডাক্তারবাবু ওদের কবল থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে বললেন–আপনারা কথাবার্ত্তা বলুন, আমি একটু বাথরুম থেকে আসছি৷ মুসাহিৰের দল সমস্বরে বলে উঠল–সে কী কথা! সে কী কথা! আপনার এখন মাতৃদায়– মাতৃশোক৷ আপনি কোথায় যাবেন! বাথরুমে যেতে হয় আমরা যাব, আমরা যাচ্ছি৷

ডাঃ বাঁড়ুজ্জে হতাশ হয়ে ধপাস করে বসে পড়লেন৷ তখন তাঁর আর করবার কিছুই রইল না৷

মাতৃভাষার মানরক্ষা

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

যখনকার কথা আমি বলছি তখন আমাদের দেশ পরাধীন লোকের মুখে তখনো স্বদেশিকতার উন্মেষ ঘটেনি৷ শিক্ষিত, বাঙালীমাত্রই ইংরেজ-ভক্ত হয়ে উঠতেন৷ বাংলাভাষাকে তারা ভাষা বলেই জ্ঞান করতেন না ইংরেজদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং ইংরেজী ভাষার প্রতি অন্ধ আনুগত্য দেখানো এবং তাদের চালচলন, হাবভাবের চাটুকারিতাসুলভ অনুকরণে অনেক বাঙালী সেদিন গর্ব অনুভব করতেন৷ স্বদেশের ভাষা, সভ্যতা, শিক্ষা, ঐতিহ্যকে তাঁরা হেয় জ্ঞান করতেন৷

তাঁদেরই মধ্যে কয়েকজন বাঙালী সেদিন বিভিন্নভাবে রুগণ্‌ বঙ্গজননীর সেবাশ্রশ্রূষায় ছিলেন অতন্দ্র৷ বাংলার অনাদৃত অবহেলিত সম্পদ্‌ তাঁরা অতল গহ্বর থেকে উদ্ধার করার কাজে ছিলেন ব্রতী৷ ‘বাংলার সম্মান প্রতিষ্ঠায় ছিলেন একনিষ্ঠ প্রয়াসী ৷ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদেরই একজন৷

বাংলাভাষাকে তিনি ভালবেসেছিলেন শুধু মুখের কথাতেই নয় ভালবেসেছিলেন অন্তর দিয়ে--হৃদয়ের অকৃত্রিম দরদ দিয়ে৷ তিনি যথার্থ বুঝেছিলেন, বাংলা বাঙালীর মাতৃভাষা৷ মাতৃভাষাকে মর্যাদা দেওয়া প্রতিটি বাঙালীর অবশ্য কর্তব্য৷ পরের ভাষায় জ্ঞানের বিকাশ সম্পূর্ণ এবং সহজ হয় না৷ প্রত্যেক জাতির পক্ষে তার মাতৃভাষাই অগ্রগতির সহায়ক৷

একদিন দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর দেবেন্দ্রনাথ বৈঠকখানায় বসে বিশ্রাম করছেন এমন সময় পিওন এসে একটা চিঠি দিয়ে গেল৷ চিঠিটা ছিল তাঁর এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের৷ চিঠিটা হাতে পেয়েই কিন্ত তার মুখ হয়ে গেল গম্ভীর ৷ বিরক্তি আর রাগে কপালের চামড়ায় ভাঁজ পড়লো৷’’

ব্যাপারটা কি? তোমরা হয়তো ভাবছো কোন মৃত্যুসংবাদ---তাই না? না, আসলে তা নয়৷ আত্মীয়টি তাঁকে ইংরেজীতে চিঠি লিখেছেন৷

কেন, বাংলায় লিখলে কি মান যেতো ? নীরব গর্জন করলেন দেবেন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে চিঠিটা না পড়েই ফেরত পাঠিয়ে দিলেন আত্মীয়ের কাছে৷ লিখে দিলেন আমি বাঙালী, আপনিও বাঙালী---

অতএব উচিত ছিল বাংলাতেই চিঠি লেখা৷

পঞ্চ দধীচি স্মরণে

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

সেদিনও হয়েছিল সূর্যোদয়,

 নির্মেঘ বসন্তের গগন৷

ঈশান কোণে অপ্রত্যাশিত মেঘ

বুঝতে পারেনি আসন্ন মহারণ৷

 

 পাঁচই মার্চ, মহাবেদনার স্মৃতি,

বিক্ষত করে নিবিড় ভ্রাতৃ-প্রীতি৷

 ধর্মের তরে পঞ্চ দধীচি যারা

আজও অম্লান প্রাতঃস্মরনীয় তারা৷

 

দূরাচারীর অস্ত্র যখন

 নিঠুর খেলায় মাতে,

সাধু জনের পরিত্রাণে আসেন

 পরমপিতা সাথে৷

জড়বাদী মন মানেনা কখনো

 তাই পাপাচারে লিপ্ত,

কোন বিরোধীতা শুৃনিতে নারাজ

 শুনিলেই হয় ক্ষিপ্ত৷

 

নিজ সঙ্কল্প রূপায়ণে দধীচিরা আসে ভূবনে,

হাসিমুখে তাঁদের মরণ বরণ

আপন কর্তব্য সাধনে৷

ক্ষমতাবৃত্তে দিশাহারা হয়ে

 দুঃশাসনের বংশ,

অত্যাচারের অস্ত্র বানায়

 শিশুপাল আর কংস!

 

অহংবোধের উন্মাদনায়

 লঙ্ঘিত মহামানবের বাণী,

 ষড়যন্ত্রীর চক্র রচিছে

 নিভৃতে চক্রপাণি!

 

আজ সেই কুখ্যাত দিন----

ব্যাথিত হদয়ে স্মরণ করি

 কেমনে শুধিব ঋণ!

তাঁদের দেখানো পথ অনুসরণে

 সুদৃঢ় করি মন,

কল্যাণকর কর্ম রূপায়ণে

 হোক মানবিক জাগরণ৷