অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের দাবীতে ঐক্যবদ্ধ গণ আন্দোলন চাই

লেখক
প্রভাত খাঁ

ভারতবর্ষের মাটিতে পশ্চিমী বণিকগণ ব্যবসা বাণিজ্য করতে আসেন সেই প্রাচীনকালে মুঘল আমলে৷ তারা এদেশে এসে বুঝে ছিল৷ যে এদেশের মুসলমান শাসকগণ যতটা না দক্ষ শাসক তার চেয়ে বেশী ব্যষ্টিগত ভোগ বিলাসে মত্ত ছিলেন আর রাজকর্মচারীরা ছিলেন শাসকদের স্তাবক৷ তাঁদের হাত করতে পারলে শাসকগণকে পরোক্ষভাবে হাত করা যায়৷ তাই পশ্চিমী বণিকগণ বিশেষ করে ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানী খুবই ধূর্ত্তের সঙ্গে এদেশে ব্যবসা বাণিজ্য চালিয়ে যায় ও রাজশক্তি কব্জা করার কূটচালে নেমে পড়ে ধীরে ধীরে৷ তাই রাজপরিবারের যাঁরা প্রভাবশালী কর্মচারী তাঁদের হাত করে রাজশক্তি অধিকার করতে কাজে নেমে পড়ে৷ তাই দেখা গেল ইংরেজ বণিকগণ ফরাসী বণিকদের চেয়ে অধিকতর ছলচাতুরীতে এগিয়ে যায় রাজশক্তি কব্জা করতে৷ সেটা প্রধানতঃ ফলপ্রসূ হয় এই অখণ্ড বাংলাদেশে৷ মীরজাফর এর মতো বিশ্বাসঘাতক সিপাহীসলারকে রবাট ক্লাইভের মতো কোম্পানীর কর্মচারীগণ সিংহাসনের লোভ দেখিয়ে ১৭৫৭ সালে জুন মাসে পলাশীর  আম্রকুঞ্জেও যুদ্ধের প্রহসন করে অতি তরুন বয়সের নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাহ্‌কে পরাজিত করে বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরকে সিংহাসনে বসিয়ে ইংরেজ কোম্পানি নিজেদের ব্যবসাবানিজ্য নিজেদের মতো করে চালাতে থাকে৷ রবার্ট ক্লাইভ্‌ হয়ে যায়                                         ‘‘লর্ডক্লাইভ! বণিকদের মানদণ্ড দেখা দিল

                                    পোহালে শর্বরী রাজদণ্ডরূপে৷’’ ---রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷

ধীরে ধীরে এই বণিকরাই সারা ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য বিস্তার করে তারপর সারা পৃথিবীতে এই ভারতবর্ষের লোকবল ও সম্পদের সাহায্যে সারা পৃথিবীতে সাম্রাজ্য এমনভাবে বাড়ায় যার দরুণ বলা হতো  পৃথিবীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যতে সূর্য্য অস্ত যায় না৷ প্রায় একশ বছর  পরে ১৮৫৭ সালে মহারাণী ভিক্টোরিয়া কোম্পানীর হাত থেকে ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞী হিসাবে ভারতবর্ষের শাসনভার হাতে নেন৷ কিন্তু  পরবর্তীকালে পৃথিবীতে বিজ্ঞানের উন্নতি হওয়াতে ও সারা পৃথিবীতে শিক্ষাবিস্তারের ফলে ও সারা পৃথিবী যেন একটি বৃহৎ মানব সমাজরূপে সচেতন হওয়াতে রাষ্ট্রগুলির ঔপনিবেশিক আক্রমণে পর পর দুটি বিশ্বযুদ্ধে একদিকে যেমন সারা পৃথিবীর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঠিক তেমনই ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলির চরমভাবে শক্তি ও সাম্রাজ্যের ক্ষতি হওয়াতে সারা বিশ্বে স্বাধীনতার জন্য এক জাগরণ ঘটে৷  রাষ্ট্রশক্তি শাসকদের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়৷ তাতে ধীরে ধীরে  পরাধীন দেশগুলি স্বাধীন হতে থাকে৷ ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয় শোষক ইংরেজ সরকারকে বিতাড়ণের জন্য এই অখণ্ড বাংলা থেকেই যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতবর্ষে৷ সেই আন্দোলন শুধু হয় সহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে৷ পরে ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস দল পত্তন হয় ব্যারিষ্টার উমেশচন্দ্র (ব্যানার্জী সভাপতিত্বে)৷ পরে গান্ধীজী নেতৃত্ব দেন এই দলের৷ তিনি অহিংস পথে আন্দোলনের ডাক দেন৷ অসহযোগ আন্দোলন সারা ভারতে একটা বিশেষ রূপ নেয়৷ এই বাঙলায় স্যার সুরেন্দ্রনাথ  বন্দ্যোপাধ্যায়, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস পরে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস যোগদান করেন, বালগঙ্গাধর তিলক, বিপিনচন্দ্র পাল আরো  অনেকে আসেন, ঋষি অরবিন্দ, সূর্য সেন, বাঘা যতিন, ক্ষুদিরাম, বিনয়, বাদল, দীনেশ, মহান বিপ্লবী রাসবিহারী বসু এঁরা সহিংস পথে  বিদেশী শোষকদের বিতাড়নের আন্দোলন করেন৷ মোদ্দাকথা আন্দোলন হয় সহিংস ও অহিংস পথে৷ কংগ্রেস দল এতে নরমপন্থী মিলিতভাবেই ছিলেন৷ ইংরেজ সাম্প্রদায়িকতাকে উষ্কে দিতে হাতিয়ার হিসাবে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহকে সামনে এনে ৭০ হাজার পাউন্ড দিয়ে একটা দল তৈরী করে যার নাম মুসলীম লীগ৷ এদিকে হিন্দুদের ও একটি দল হয় হিন্দু মহাসভা, ডাঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ঘটন করেন মুসলীম লীগকে পাল্লা দিতে ও ইংরেজের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে উপযুক্ত জবাব দিতে৷ ধুরন্দর রাজনীতিজ্ঞ হিসাবে তিনি এটা বুঝেছিলেন৷ অখণ্ড ভারতবর্ষের  স্বার্থে এটি ঘটন করেন৷ এটি কিন্তু  রাজনৈতিক দল ছিল না৷ এটি অরাজনৈতিক  দল হিসাবে  স্বীকৃত ছিল৷  অনেকে  এ ব্যাপারে  পরবর্তীকালে নানাভাবে  হিন্দু মহাসভাকে কালিমালিপ্ত করে থাকে৷ ডঃ শ্যামাপ্রসাদ ভারতবর্ষের  একজন স্মরণীয় দেশনেতা যাঁকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রেই অভিশপ্ত কশ্মীরে আত্মবলিদান দিতে হয়৷ যাঁর এযাবৎ কোন তদন্ত হয়নি! ঠিক নেতাজী সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান রহস্য উদঘাটনের গণ্ডাখানেক তদন্ত কমিশন হয়, তা সত্ত্বেও অদ্যাবধি সত্য উদঘাটন হয়৷ সরকারের কারচুপীতেই৷ মাননীয় ব্যরিষ্টার জয়দীপ মুখপাধ্যায় সুপ্রীমকোর্টের আইনজ্ঞদের সম্পাদক সম্প্রতি দাবী জানিয়েছেন নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্যের উদঘাটনের বর্ত্তমান শাসকদের বিশ্বাসঘাতকতাই দায়ী৷ তাঁরা অনেককিছু ঢাকতেই এটা করছেন না৷ মহান দেশ নেতা-নেতাজী কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হয়ে বুঝেছিলেন একটা কথা তা হলো এদেশের রাজনৈতিক নেতারা অখণ্ড ভারতবর্ষের পূর্ণস্বাধীনতা লাভ হোক নরমপন্থী দল কোনদিন চাননি৷ তাই তিনি (সুভাষচন্দ্র) কংগ্রেস ত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি দেন৷ মহান বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর আই.এন.এ বাহিনীর সর্বাধিনায়করূপে নেতাজীকে বরণ করেন৷ নেতাজী দিল্লি চলো ডাক দেন৷ ভারতের মাটিতে তিনি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন৷ মহান যোদ্ধা সর্বত্যাগী সুভাষচন্দ্র ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের  মানসপুত্র৷ দেশের মুক্তি তাঁর স্বপ্ণ ছিল৷  তাঁর এই মহান কাজে  সারা দেশ উদ্বুদ্ধ হয়৷ এমনকি সুভাষ চন্দ্রের  প্রেরণাতেই নৌবিদ্রোহ ঘটে৷ বিচলিত হয়ে পড়ে সারা ভারতবর্ষের জনগণের স্বাধীনতা স্পৃহা দেখে৷ তাই তাড়াতাড়ি সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে খণ্ডিত করে নরমপন্থী কংগ্রেস নেতা জহরলাল নেহেরু ও মুসলীম লীগের মিঃ জিন্নার সঙ্গে  আলাপ করে ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতা হিংস্র দাঙ্গার সৃষ্টি করে লক্ষ লক্ষ অমুসলমান উদ্বাস্তু তৈরী করে ইংরেজ সরকার একরাঙ্গামূলো স্বরূপ নিছক রাজনৈতিক স্বাধীনতা দেয়৷ সেটাতে আহ্লাদে আটখানা হয়ে কংগ্রেস ও মুসলীম লীগ দেশের শাসনভার  গ্রহণ করে৷ তারা নিজেদের মতো করেই দেশের শাসনভার গ্রহণ করে৷ সুভাষচন্দ্র বার বার দেশের নেতাদের বাহির হতে বেতারে  অনুরোধ  করে দেশ ভাগ করে  স্বাধীনতা গ্রহণ না করতে৷ এঁরা তাঁর অনুরোধ শোনেন নি৷ বরং জহরলাল হুমকী দেন এই বলে সুভাষ এদেশে এলে তাঁকে তিনি তরবারির দ্বারাই আহ্বান করবেন৷ দেশীয় সরকার যুদ্ধ অপরাধী হিসাবেই তাঁকে গ্রহণ করেন৷ তিনি অখণ্ড ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী করতেন৷ শোনাযায় গান্ধীজী দেশ ভাগ চাননি৷ এ সম্বন্ধে  নানা মত আছে৷

তবে দীর্ঘ ৭৩ বছর বিভিন্ন দল দলাদলি করে যেভাবে দেশ শাসন করে চলেছে তাতে কোটি কোটি দেশবাসীর জীবনে কোন উন্নতিই হয়নি৷ দলগুলো শাসনে থেকে নিজেদের আখের গুছুচ্ছে৷ আর ধনীরা ধনবান হয়ে চলেছে৷ দেশের ৭০ শতাংশ সম্পদ ১ শতাংশ ধনীদের কুক্ষীগত, আর ৯৯ শতাংশ নাগরিকদের হাতে মাত্র ৩০ শতাংশ সম্পদ৷ বর্তমান দেশের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা শোচনীয়৷ চরম বেকার সমস্যায় দেশ ক্ষতবিক্ষত, নিরাপত্তাহীনতায় দেশে আতঙ্কগ্রস্ত৷ দুর্নীতিতে দেশ শীর্ষ স্থান অধিকার করেছে৷

নেতাজী বলেন--- ভারতকে যদি প্রকৃতই স্বাধীন হইতে হয় তবে আমাদের শুধু রাজনৈতিক গণতন্ত্র পাইলেই চলিবে না, সামাজিক গণতন্ত্র চাই, অর্থনৈতিক গণতন্ত্রও চাই৷ এদেশের কংগ্রেস ও মুসলীমলীগ নিছক গদী স্বার্থেই ইংরেজের দেওয়া রাজনৈতিক  স্বাধীনতা লাভ করেও  কমনওয়েলথের সদস্য হয়ে এদেশের দেশীয় ও বিদেশীর ধনীদের অনুগত হয়ে সেবাদাসে পরিণত হয়েই বসেছে৷ আর জনগণকে পিষে মারছে৷ তাই অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের জন্য লড়াই  এর জন্য দেশকে শোষণমুক্তির আন্দোলন করতেই হবে৷ মেকী গণতন্ত্রের শোষণমুক্তি নির্ভর করে ঐক্যবদ্ধ দলহীন গণতন্ত্রের তীব্র আন্দোলন৷ যা গড়ে উঠবে, জাতপাতহীন সমাজের  ঐক্যবদ্ধ মানুষের নিরলস সার্বিক শোষণমুক্তির বিক্ষোভেরই মাধ্যমে৷ নেতাজী এটাই  দাবী করেন আজও৷