শোষণ যখন চরম বিন্দুতে গিয়ে পৌঁছায়, সমাজের গতিশীলতা ও গতিবেগও তখন প্রায় শূন্যাঙ্কে পৌঁছে যায়৷ এমন পরিস্থিতিতে, শোষণের সেই চরমাবস্থায় সমাজের বুকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিস্ফোরণ সংঘটিত হয়৷ ভৌতিক জগতের ক্ষেত্রে এই বিস্ফোরণটা হয় জড়াত্মক, আর মানসিক অধিক্ষেত্রে বিস্ফোরণটা হয় মানসিক বা ভাবাত্মক৷ এ ভাবেই অবস্থাভেদে বিস্ফোরণগুলি ঘটে চলে৷ এই যে মন্দা এটা আসলে সমাজের বুকে শোষণ বা দমন–প্রদমন–ব ফলশ্রুতি৷ সমাজতান্ত্রিক দেশ বা পুঁজিবাদী দেশ উভয় রাষ্ট্রেরই অর্থনৈতিক পরিভূতে মন্দা আসতে বাধ্য–কারণ উভয় দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেই অন্তর্নিহিত রয়েছে এক গভীর জড়তা৷
সমাজের সংসৃক্তি–জীবনেও দমন–প্রদমন–ব ফলে একই ধরণের মন্দা দেখা দিতে পারে৷ ফলস্বরূপ, মানুষের সাংসৃক্তিক জীবন বিকৃত হয়ে উঠতে পারে৷ সত্যি কথা বলতে কি, এমন একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সংসৃক্তির বিভিন্ন ধারা–উপধারাগুলিতেও বিকৃতি এসে পড়ে৷ সে কারণে আমরা দেখতে পাই বাজারে বিকৃত সাহিত্যের ভীড়, বিকৃত গান–নাচের রমরমা৷ এমন কি চিত্রাঙ্কন ও বাস্তুবিদ্যাতেও এসে যায় এই বিকারের কাল ছায়া৷ সামাজিক ও অর্থনৈতিক–উভয় ক্ষেত্রে এই মন্দা হয়ে ওঠে অসহনীয়৷ এমনই ধরণের ভয়াবহ মন্দা একবার সংঘটিত হয়েছিল ১৯২৯ ও ১৯৩১ সালে৷
অতীতের মন্দা ও ভবিষ্যতের অনাগত মন্দার মধ্যে কিন্তু থাকবে এক মূলগত তফাৎ৷ পূর্বে সংঘটিত মন্দাগুলির সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি যুক্ত ছিল সামান্য হারে, কিন্তু ভবিষ্যতে যে মন্দা ঘটতে যাচ্ছে তাতে মুদ্রাস্ফীতি হবে তীব্রতর৷ তাই এ মন্দা মানুষের জীবনের সর্বাঙ্গীন বিকাশের পক্ষে হবে আরও অনেক বেশী ক্ষতিকারক৷
আজ এমনই মন্দার এক ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া ঘটবার মত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে৷ এই মন্দা ঘটবে বাণিজ্যিক অর্থনীতির শিল্পোগত উপকাঠামোয়৷ আর তার ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে গোটা মানব সমাজে৷ তাই এই মন্দার সময়কালটা যাতে কমিয়ে আনা যায় তার প্রয়াস চালান আজ অত্যাবশক৷ মন্দার চরম বিপর্যয় দেখা দেবার পূর্বেই, চেষ্টা করলে তাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব, সেই সঙ্গে সমাজের গতিতেও দ্রুতি আনা সম্ভব৷ প্রাউটের মাধ্যমে গোটা সমাজের বুকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংসৃক্তিক এক স্পন্দন উত্থিত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হতে পারে৷ সমাজের সংকোচবিকাশী ধারায় তরঙ্গের অবোহ স্তরে, অথবা বিকাশাত্মক বিরতির পরেই এই স্পন্দনটা তৈরী করতে হবে৷ আজ আরও বেশী চেষ্টাশীল হয়ে এ ধরণের স্পন্দন সমাজের বুকে গড়ে’ তুলতে হবে৷ যদি আমাদের এই স্পন্দন সৃষ্টি, আর সমাজের আসন্ন বিস্ফোরণ–দুটোই একই সময়ে হয় তবে তার ফল হবে আরও ভাল৷
মন্দার কারণ ঃ অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেবার কারণ প্রধাণতঃ দু’টি৷ প্রথমটি হ’ল সম্পদের অতি সঞ্চয় বা অতিকেন্দ্রীকরণ, আর দ্বিতীয় কারণ হ’ল টাকার চক্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করা৷ মূলধন যদি মুষ্টিমেয় কিছু ব্যষ্টি বা রাষ্টের হাতে সঞ্চিত হয়, তবে জনগণের বৃহদংশ অল্প কিছু ব্যষ্টির দ্বারা শোষিত হতে থাকে৷ এ ধরণের তীব্র শোষণের ধারায় দেখা দেয় এক বিস্ফোরণ৷ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই বিস্ফোরণকে বলা হয় মন্দা স্তুন্দ্বহ্মব্জন্দ্বব্দ৷ ধনের কেন্দ্রীকরণ, আরও ভালভাবে বলতে গেলে মূল্যগত বিচারে ধনের কেন্দ্রীকরণই হ’ল মন্দার মূল ও প্রধান কারণ৷
মন্দার দ্বিতীয় কারণটি হ’ল, ব্যষ্টি বা রাষ্ট্রের হাতে ধনের অতি সঞ্চয়৷ তারা মূলধন আটকে রেখে দেয় এই কারণে যে, তারা ভাবে তাদের টাকা যদি স্বাধীনভাবে বাজারে খাটতে দেওয়া হয়, তবে হয়তো সাধারণ মানুষের জন্যে কিছু স্বস্তি আসবে ঠিকই, কিন্তু তাদের নিজেদের মুনাফার পরিমাণটা যাবে কমে৷ পুঁজিপতিদের মনস্তত্ত্বটা হ’ল, টাকা খাটিয়ে যত বেশী সম্ভব মুনাফা তুলে নেওয়া৷ যখন তারা বুঝতে পারে, টাকা খাটিয়ে এখন আর মুনাফা করা সম্ভব হবে না, তখন তারা নিজেদের সঞ্চিত টাকা বাজারে ছাড়া বন্ধ করে’ দেয়৷ ফলে, নানাভাবে মূলধনকে তারা অচল স্থিতিতে রুদ্ধ করে’ ফেলে৷ যেহেতু বাজারে মূলধনের চলাচল তখন বন্ধ হয়ে যায়, ফলে বিনিয়োগও সে পরিস্থিতিতে বন্ধ হয়ে পড়ে৷ উৎপাদন আর বাড়তে পারে না, আয়ও বাড়ে না৷ তার ফলে জণগণের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায় অস্বাভাবিক হারে৷ এভাবে পরিস্থিতি এত বেশী ঘোরাল হয়ে ওঠে যে, তখন বাজারে দ্রব্য সামগ্রী ক্রয় করতে খুব কম ক্রেতাকেই পাওয়া যায়৷ যদি কোথাও উৎপাদনে ঘাটতি ও উদ্বৃত–শ্রম থাকে সেখানে মন্দার প্রভাব তীব্র হয়ে ওঠে৷ ফলে এইসব জায়গায়, মন্দার সময়ে বেশীর ভাগ ব্যবসা–বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়৷ যখন উদ্বৃত শ্রম এলাকায় মজুরীর হার কমতে থাকে তখন শ্রমিকরা কর্মের সন্ধানে ঘাটতি শ্রম এলাকায় ধাওয়া করে–যা সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে৷
এমত অবস্থায় একটা সামাজিক–র্থনৈতিক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে খাদ্যদ্রব্য স্থানান্তরিত করার ওপর বাধা দিলে ওই অঞ্চলে দারুণ অভাব দেখা দেয়, তার ফলে ঘাটতি এলাকায় কোনো নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ আরোপ করা উচিত নয়৷ ফলে দেশে মন্দার সময় যেখানে উদ্বৃত্ত ফসল হয় এমন অঞ্চল, ও ঘাটতি শ্রম এলাকা কম অসুবিধা ভোগ করবে৷
মন্দা জিনিসটা কোন স্বাভাবিক ঘটনা নয়৷ সাময়িক বিরতি হ’ল প্রাকৃতিক ঘটনা৷ প্রাউট–র্থনৈতিক–ব্য্ সাময়িক বিরতি আসতে পারে, কিন্তু মন্দা কখনই আসবে না৷ মন্দার হাত থেকে সমাজকে বাঁচাতে প্রাউট উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটিয়ে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে বাড়িয়ে, ধনবৈষম্যকে কমিয়ে, অর্থের চলমানতাকে অক্ষুণ্ণ রাখার ওপর জোর দেয়৷ অন্তঃসারশূন্য শ্লোগানে কিছুই হয় না৷ উৎপাদন বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করতে হবে৷
ধনতান্ত্রিক ও কম্যুনিষ্ট দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ৷ ধনতান্ত্রিক দেশে পরিচালক মণ্ডলীর স্বার্থে শ্রমিকরা ভালো কাজ করে না৷ পরিচালকমণ্ডলীও সম্পদ কেন্দ্রীভূত করার জন্যে অর্থকে সচল রাখতে চায় না৷ কম্যুনিষ্ট দেশে শ্রমিকরা কোন কাজই নিজের বলে’ ভাবে না৷ তার ফলে সেখানে উৎপাদন ব্যবস্থা মন্থর হয়ে ওঠে প্রাউটের সমবায়িক উৎপাদন ব্যবস্থা উভয়বিধ ত্রুটি থেকে মুক্ত৷
প্রাউট মানুষের আদর্শ ও সেণ্ঢিমেণ্ঢের সুস্থ সমন্বয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত৷ কিন্তু অন্যান্য সামাজিক–র্থনৈতিক ব্যবস্থা মানুষের সার্বিক বিকাশ ও অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে পূর্ণ পরিপন্থী৷