স্বাধীনোত্তর ভারত৷ ১৯৫৬ সাল৷ ২০শে এপ্রিল পুরুলিয়া জেলার পুঞ্ঝা থানান্তর্গত পাকবিড়রা গ্রাম থেকে শুরু হয়েছিল ৩০০কিলোমিটার ব্যাপী এক বিশাল শোভাযাত্রা৷ এতে যোগ দিয়েছিলেন ১০ মহিলাসহ ১০০৫ জন পদযাত্রী৷ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লোকসেবক সংঘের সভাপতি শ্রী অতুল চন্দ্র ঘোষ৷ ১০ মহিলাকে উৎসাহিত করে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন অতুলচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের সহধর্মীণী ‘শ্রীমতী লাবণ্যপ্রভা ঘোষ’৷ মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনে লাবণ্যপ্রভার অতুলনীয় যোগদান অবিস্মরণীয়৷ মানভূমের সহজ সরল মানুষ শ্রদ্ধা সহকারে লাবণ্যপ্রভা দেবীকে মা বলে ডাকতেন৷ তাঁর মাতৃসুলভ ব্যবহার মানভূমের মানুষকে আপন করে নিয়েছিল৷ মানভূমের মানুষের সুখে দুঃখে তিনি ছিলেন তাদের সত্যিকারের আপনজন৷ তাই তাঁকে বলা হতো মানভূম-জননী৷
গান্ধীবাদী লাবণ্যপ্রভা দেবী ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের এক প্রতিভাশালী মহিলা৷ স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে তিনি ছিলেন প্রকৃত সমাজসেবী৷ জীবনের শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত মানভূমের সহজ সরল মানুষের সেবায় সংলগ্ণ ছিলেন৷ সেবাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত৷ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ছিল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ৷ স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেত্রী লাবণ্যপ্রভা স্বাভাবিকভাবেই ছিলেন সংগ্রামী ভাবাপন্ন৷ তাই স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর তৎকালীন বিহার সরকারের অন্যায় আদেশের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন৷ ১৯৪৮ সালে বিহার সরকার দ্বারা ঘোষিত হিন্দীকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন ও ১৯৫৬ পর্যন্ত অবিরাম চালিয়ে যান সেই আন্দোলন৷ বাংলা ভাষার অবদমনের বিরুদ্ধে আট বছর ব্যাপী লড়াইয়ে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন৷ তাঁরই প্রতিবাদের ফসল--- পুরুলিয়া জেলা আজও তাঁর সাক্ষী বহন করে চলেছে৷
ঋষি নিবারণ চন্দ্র দাশগুপ্ত ছিলেন---পুরুলিয়া জেলা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক৷ তাঁরই ঘর আলো করে ১৮৯৭ সালের ১৪ই অগাষ্ট জন্ম নিয়েছিলেন মানভূমের মহতী ভাষা যোদ্ধিনী লাবণ্যপ্রভা৷ তৎকালীন পরম্পরার বিরুদ্ধে লাবণ্যপ্রভাও কোনদিন স্কুলে যাননি৷ সুতরাং তিনি আনুষ্ঠানিক শিক্ষাও পাননি৷ কিন্তু শিক্ষক পিতার তত্বাবধানে ভালোভাবেই পড়াশোনা করেছিলেন৷ আবার তৎকালীন পরম্পরা অনুসারে মাত্র এগারো বছর বয়সে সপ্তবিংশতি বর্ষীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্রী অতুলচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের সঙ্গে শুভ পরিণয়৷ তারপর থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে হাতে খড়ি৷ দুই পরিবারের পারম্পারিকতায় অতি অল্প বয়সেই উপ্ত হয়েছিল--- স্বাধীনতার বীজ৷ ফুলে-ফলে ভরে উঠেছিল পরবর্তী জীবনে৷ লাবণ্যপ্রভার মন থেকে সংগ্রামী ভাবাপন্নতা তাঁর জীবনে কোনদিন মুছে যায় নি৷ তাই স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরেও তিনি লড়াই করে গেছেন অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে৷
লাবণ্য প্রভা দেবীর পিতা মহা মহিম শ্রী নিবারণ চন্দ্র দাশগুপ্ত মহাশয় শিক্ষকতার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামেও যথেষ্ট সময় দিতেন৷ তিনি ‘মুক্তি’ নামক একটি দ্বি-সাপ্তাহিক পত্রিকারও প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন৷ পরবর্তীকালে বার্ধক্য জনিত সমস্যার জন্য সম্পাদনার কাজ স্বাধীনতা সংগ্রামী জামাতা অতুলচন্দ্র ঘোষের হাতে তুলে দিয়েছিলেন৷ ১৯৬৯ সালে অতুলচন্দ্রের মৃত্যুর পর লাবণ্যপ্রভা স্বয়ং সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেছিলেন এর আগেও তিনি মাঝে মধ্যে ঐ পত্রিকায় লেখালেখি করতেন৷
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে বর্তমান ঝাড়খণ্ড সংলগ্ণ পুরুলিয়া জেলার জন্মদাত্রী লাবণ্যপ্রভা দেবীর নাম অবশ্যই উল্লেখযোগ্য কিন্তু হিন্দিসাম্রাজ্যবাদীদের্ কুচক্রান্তে ইতিহাসের পাতা থেকে লুপ্ত৷ স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে তিনি কয়েকবার কারাবরণ করেছেন৷ ১৯৩০ সালে লবণ সত্যাগ্রহ, ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও ১৯৪৫ সালের পতাকা সত্যাগ্রহ আন্দোলনে লাবণ্য প্রভাদেবীর ভূমিকা অবশ্যই স্মরণীয়৷
১৯৪৭সালের ১৫ই অগাষ্ট ভারতবর্ষের মাটি থেকে বিদায় নিলো---দুই শত বৎসরের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ৷ শুরু হলো---হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ৷ মানভূমের সহজ সরল মানুষ হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের গুপ্ত ষড়যন্ত্র বুঝতে না পারলেও বিদ্বৎ সমাজের চোখ এড়াতে পারেনি৷ তাই বিহার সরকারের অন্যায়ে আদেশের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল মানভূমের বাঙালী বিদ্বৎ সমাজ৷ তাদেরই দলের একজন ছিলেন---মহীয়সী নারী লাবণ্য প্রভা৷
বাংলা ভাষা আন্দোলনে লাবণ্যপ্রভা দেবীর অনবদ্য অবদানের কথা মনে রেখেই ভাষা শহীদ স্মারক সমিতির পক্ষ থেকে ২০০৩ সালে আধুনিক কালের গণ্যমান্য লেখক শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয় কর্তৃক সমাদৃত হয়েছিলেন৷ কিন্তু মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনের বিপ্লবী যোদ্ধা লাবণ্য প্রভা দেবীর অসাধারণ জীবনকে কেন্দ্র করে পুরুলিয়া শহরে কোন স্মৃতি চিহ্ণ গড়ে ওঠেনি৷ তাঁর অমূল্য জীবনের একমাত্র স্মৃতি তাঁর পিতা শ্রী নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত নির্মিত ‘শিল্পাশ্রম’৷ আশ্রমটি পুরুলিয়া শহরের তেলকল পাড়ায় অবস্থিত৷ জীবনের শেষ দিনগুলি অতিকষ্টে তিনি এই আশ্রমটিতেই কাটিয়েছেন৷ জীবনের শেষ সম্বল ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য প্রদত্ত সরকারি পেনশন৷ বাস্তবিক অর্থে যাঁরা স্বতন্ত্রতা সেনানী তাঁদের স্থান সততই হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের বাইরে৷ কারণ হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের অন্যায় অত্যাচার তাঁরা সহ্য করতে পারেন নি৷ তাই তারা স্বাধীনোত্তর ভারতে ব্রাত্যই থেকে গেলেন৷
মানভূম জননী---লাবণ্যপ্রভা দেবী নিজের সমস্ত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে সাধারণ জনগণের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন৷ কোনদিন মিথ্যা কে প্রশ্রয় দেননি৷ অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি৷ তাই তিনি মানভূমের সহজ সরল মানুষের চোখে ‘‘মহীয়সী নারী’’৷
তৎকালীন বিহারের বাঙালী জনগোষ্ঠীর অমূর্ত প্রতীক৷ বাংলা ভাষা আন্দোলনের জ্বলন্ত ধূমকেতু ও পুরলিয়ার অগ্ণিকন্যা শ্রদ্ধেয় লাবণ্যপ্রভা দেবী ২০০৩ সালের এগারোই এপ্রিল সংসারের সমস্ত মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন জাগতিক বন্ধনের উধের্ব৷
বাংলা ভাষা আন্দোলনের লাবণ্য প্রভা দেবীর অবদান অবশ্যই প্রশংসনীয়৷ কিন্তু মানভূমের বিভাজন মেনে নেওয়া মোটেই উচিত হয়নি৷ মানভূম জেলার একাংশ আজ ধানবাদ জেলা নামে পরিচিত ও বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অন্তর্গত৷ বাংলা ভাষা আন্দোলনের পরিণাম থেকে বঞ্চিত৷ তাই এখানকার বাঙালী জনগোষ্ঠী হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের করতলগত৷ শুধু ধানবাদ বলা ভূল হবে৷ সম্পূর্ণ ঝাড়খণ্ডবাসী আজ হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের শিকার৷ এরাজ্যের ৬০ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা অবহেলিত ও অবদমিত৷ এই অবদমনের হাত থেকে রেহাই পেতে হলে গণ আন্দোলনের প্রয়োজন৷ অধিকার কেউ হাতে তুলে দেয় না, সামর্থ্যের বলে কেড়ে নিতে হয়৷ তাই প্রভাত সঙ্গীতের ভাষায় বলি---
‘‘বন্ধুরা সব এগিয়ে চলো, সময় হয়েছে আজ৷
পাপশক্তির হবে পরাভব,সরিবে দুর্নীতিরাজ৷’’
- Log in to post comments