সম্প্রতি বাঙলায় সংঘটিত নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নাম জড়িয়েছে বহিরাগত অবাঙালীদের৷ আর.জি.করের তরুণী চিকিৎসক-পড়ুয়ার নৃশংস হত্যাকাণ্ড হোক, ট্যাব কেলেঙ্কারিই হোক বা সুশান্তকাণ্ডই হোক বাঙলার মোটামুটি সমস্ত অপরাধেই দুষৃকতী তালিকায় জায়গা করে নিচ্ছে বহিরাগতরা৷ কারা এই বহিরাগত মূলত বিহার, উত্তর প্রদেশ,ঝাড়খণ্ডের মতন হিন্দী বলয়ের রাজ্য থেকে দিন মজুরের কাজের সন্ধানে বাঙলাতে আসছে এরা৷ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষজন অন্য রাজ্যে কাজের সন্ধানে গেলে সেই রাজ্যের আঞ্চলিক সংস্কৃতির সঙ্গে একীভূত হওয়ার চেষ্টা করে৷ এক্ষেত্রে এই সব হিন্দী বলয়ের বহিরাগতরা কিন্তু উল্টো৷ বাঙলাকে খোলা বাজার ও দূর্বৃত্তদের উন্মুক্ত পরিবেশ করার উদ্দেশ্যেই এদের আগমন হয়৷ বাঙলায় থেকে , বাঙালীর খেয়ে এরাই বাঙালীদের ওপর দাদাগিরি চালায়৷ এরা বাঙলাতে থেকেও বাংলা ভাষায় কথা বলে তো নাই বরঞ্চ বাংলায় কথা বলার অনুরোধ করলে হুমকির সুরে বলে এটা বাংলাদেশ নাকি, এটা ইন্ডিয়া!! তাই হিন্দী জানতেই হবে !! ভাবুন তো যে বাঙালী জাতির আত্মোৎসর্গিত রক্তের বিনিময়ে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পেল, সেই (পশ্চিমবঙ্গের) বাঙালীকে বাংলাদেশী হিসেবে তোপ দাগিয়ে বিদেশী বানিয়ে রাষ্ট্রহীন করতে চায় এরাই !! শাসক দল - বিরোধী দল ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে চক্ষু-কর্ণ বন্ধ করিয়া নীরব দর্শক ব্যতীত কোন ভূমিকাই পালন করতে উদ্যত নয়৷
‘এক ভারতীয়’ এই ভাবাবেগকে আশ্রয় করে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত এতগুলো বছর ধরে বাঙলা-বাঙালী নীরবে শোষণ, বঞ্চনা সহ্য করছে৷ স্বাধীনতা পরবর্তী কেন্দ্র সরকার ও তৎকালীন রাজ্য সরকারের বাঙালী বিদ্বেষী মনোভাব বাঙলার শিল্প,অর্থনীতি,চাকরী, ব্যবসা আস্তে আস্তে সবকিছুই বাঙালীর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে অবাঙালী বেনিয়াদের হাতে, কলকারখানা থেকে শপিং মল, ফুটপাত থেকে রাজপথ সবকিছুতেই বহিরাগতদের দখলদারিত্ব প্রতিস্থাপিত করেছে!! বর্তমান সরকার চাইলেও এই ট্রেডিশনের বাইরে যেতে পারে না৷ তাই তো দেখছি বাঙলার পি.এস.সির মতন চাকরীর প্রবেশিকা পরীক্ষায় বাংলা ছাড়াও হিন্দীভাষী,নেপালীভাষীর মতন বহিরাগতরা তাদের মাতৃভাষায় পরীক্ষা দিয়ে বাঙলায় চাকরীর সুযোগ করে দেওয়া হয়, কিন্তু চক্ষু মেলিয়া দেখলেই দেখা যায় গুজরাট, মহারাষ্ট্রের মতন রাজ্যের পি.এস.সি পরীক্ষায় সেই রাজ্যের আঞ্চলিক ভাষা গুজরাটের ক্ষেত্রে গুজরাটি, মহারাষ্ট্রের ক্ষেত্রে মারাঠা ভাষা না জানলে সেই রাজ্যের পি.এস.সি পরীক্ষা দেওয়া যায় না !! শুধু তাই নয়, অধিকাংশ রাজ্যের চাকরীক্ষেত্রে রাজ্যের ভূমিপুত্রদের ‘সংরক্ষণ আইন’ করে সেই রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে৷ বাঙলার ক্ষেত্রে এই নিয়ম চালুর কথা উঠলেই ‘এক ভারতীয়’ ভাবাবেগকে আশ্রয় করে প্রাদেশিক আখ্যা দেওয়া খুবই সহজ৷ অন্যদিকে বাঙালীরা বিহারে কেন্দ্রীয় সরকারী চাকরীর পরীক্ষা দিতে গেলে তাদের ওপর নির্মমভাবে প্রহার করে বাঙলায় ফেরৎ পাঠানো হলে সেই হিন্দীভাষী দুর্বৃত্তদের কেউ প্রাদেশিক বলেছে কী? উল্টে হয়ত বাহাদুরির খেতাবই মিলেছে হয়ত৷ সত্যিই সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ!! বাঙালীর রক্তে অর্জিত স্বাধীন ভারতবর্ষে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়,উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাঙালীদের ওপর রক্তক্ষয়ী আক্রমণ, খুন, ধর্ষণ সংঘটিত হলেও কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি!! মরতে হয়েছে হাজারো সাধারণ নিরীহ বাঙালীকে৷ হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা করবার মিথ্যা প্রয়াস চালিয়ে বাংলার মতন অতি উন্নত, মিষ্টি মধুর ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা (ক্লাসিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ) থেকে বিরত রাখা হয়৷ যদিও চারিদিক থেকে লাগাতার আন্দোলনের ফলে ও লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বিজেপির সরকার বাঙলায় আসন সংখ্যা ১৮ থেকে ১২ তে নেমে এসে ধাক্কা খাওয়ার পর বাঙালীর মন জয় করতে বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার তকমা দিল বটে কিন্তু বাঙলায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় দফতর গুলোতে বাংলা ভাষার ব্যবহার আবশ্যিক করা হল না!! বাঙলায় অবস্থানরত বহিরাগতদের লোকাচার, ছটপুজোর সংখ্যা বাড়তে থাকলেও ৬৫-৭০ ভূমিপুত্র বাঙালীর ঝাড়খণ্ডে যুগযুগ ধরে চলে আসা কালীপুজো বন্ধ করে দেওয়ার জন্যে কোর্টে মামলা চলছে!! ‘এক ভারতীয়’ ‘সবাই হিন্দু’ এর নমুনা৷ নানা জাতি, নানা ভাষার বিচিত্র সমাহার হয়েছে এই বাঙলাতেই, বাঙলা সবাইকে আপন করে নিয়েছে, ভালোবেসেছে ঠিকই, কিন্তু সবাই বাঙলাকে শোষণের মনোরম উপনিবেশ করতেই চেয়েছে যুগে যুগে৷
আজ গোটা বাঙালী জাতিকে এই চরম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তীব্র আন্দোলন সংঘটিত করতেই হবে৷ ‘বাঙালী’ জাতি মানবতার প্রতীক৷ মানবতাকে বাঁচাতে, মানব সমাজকে শোষণমুক্ত করতে যুগে যুগে যে মহান মণীষী, আত্মত্যাগী বিপ্লবীদের আবির্ভাব হয়েছে এই বাঙলাতেই , সেই মহান বাঙালীদের রক্তের ধারাপ্রবাহ বজায় রেখে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে শোষণ বিরোধী সংগ্রামের পথে৷ সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা করতে হবে বাংলা ভাষায় কথা বলা,পরিষেবা পাওয়ার সাংবিধানিক ও মানসিক অধিকার৷ বহিরাগতদের বেদখল করা বাঙলার শিল্প, অর্থনীতি, ব্যবসা, চাকরী সবকিছুই বাঙালীর হাতে পুনর্দখল নিতে হবে৷ যে সমস্ত অবাঙালীরা বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিকে সন্মান দিয়ে আপন করে নিয়ে,বাঙলায় রোজগার করে তা বাঙলাতেই ব্যয় করে বাঙলার আর্থিক উন্নতিতে অংশগ্রহণ করে বাঙলার ‘স্থানীয়’ হতে পারবে৷ শুধু তাদেরকেই বাঙলাতে থাকা ও কর্মসংস্থান সুযোগ দিতে হবে৷ হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করা, বাঙলার অর্থের বহিঃস্রোত ঘটানো বহিরাগতদের বাঙলায় উপনিবেশ গড়তে দেওয়া চলবে না৷ বাঙলাকে বাঁচাতে ভাষা-সংস্কৃতি-অর্থনীতি সবকিছুই বাঙালীর নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে৷ বাংলা-বাঙালী বাঁচলেই বিশ্বমানবতা নব্যমানবতাদে উত্তীর্ণ হয়ে সকল জীবের কল্যাণ সাধন করতে পারবে৷
- Log in to post comments