বাংলা নববর্ষে সকলের শুভ হোক

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

দুরন্ত কালবৈশাখী চৈত্রের চিতাভস্ম উড়িয়ে বর্ষণেরঅঝোর ধারায় গ্রীষ্মের দাবদাহে জর্জরিত প্রকৃতিতে স্নিগ্দ পরশ ও শীতলতা আনে৷ একইভাবে নববর্ষও মানুষের মনের কোণে জমে থাকা পুরোনো বছরের গ্লানি, হতাশা, অশান্তিকে দূরে নিয়ে নবশক্তির সঞ্চার করে৷ ফেলে আসা বছরের সাফল্যগুলি মানুষকে দেয় নোতুন লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলার উদ্যম ও প্রেরণা আরভুল-ত্রুটি-অসাফল্যের লক্ষণ গুলোকে বিশ্লেষণ করে দুর্বলতার কারণগুলির সংশোধনের মাধ্যমে মানুষ গ্রহণ করেস ম্মুখ পানে অগ্রসরণের সংকল্প৷এই সংকল্পই রচনা করে নোতুন মাইল ফলকের ভিত্তিপ্রস্তর ৷ তাই নববর্ষের শুভ সূচনার দিনটিকে মানুষ বরণ করে মঙ্গলময়ের চরণে প্রার্থনা ও ভক্তিরসের পবিত্রতায়৷ বর্ষবরণে অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন সাংস্তৃতিক অনুষ্ঠান--- গান-কবিতা-নৃত্য ইত্যাদির সমাহারে৷ সর্বত্র এক আনন্দঘন পরিবেশ৷ সকলের আন্তরিক কামনা --- সকলের শুভ হোক,সকলে আনন্দে থাকুক, সুস্থ ও শান্তিময় জীবন নির্বাহ করুক৷

বর্তমান পৃথিবীতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার৷ প্রতিদিনের সংবাদ মাধ্যম গুলিতে খুনোখুনি, রক্তপাত, হিংসার বীভৎসতা, বিকৃত লালসারযে জঘন্য খবরাখবর পরিবেশিত হয়---তার প্রতিক্রিয়ায় মানুষের মনে সর্বদাইএকটা ভীতন্মন্যতা, বিপন্নতা ও অসহায়তার ছাপ পড়তে বাধ্য৷ একজন সুস্থ মানুষ বাড়ির বাইরে বেরিয়ে সুস্থ শরীরে ফিরে আসবে কি না তার নিশ্চয়তা নেই--- হয়তো কোন মদ্যপ ও বেপরোয়া যান চালকের দোষে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে৷ নারীদের সম্মান প্রায়শঃই ভূলুন্ঠিত, বরংঅসম্মান ও অশালীন আচরণের শিকার হওয়াটাই যেন ভবিতব্য৷অল্পবয়সীদের ক্ষেত্রে অবস্থা আরও ভয়াবহ --- ঘরে বা বাইরে কোথাও তাঁদের সুরক্ষার নিশ্চিততা নেই৷রাজনৈতিক রেষারেষির জেরে রক্তপাত ও জীবনহানি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা৷তার উপর নির্বাচন এলে তো আর কথাই নেই---তা স্থানীয় পঞ্চায়েত - পুরসভার নির্বাচন হোক, স্কুল-কলেজ-সমবায়ের পরিচালন সমিতির নির্বাচন হোক বা রাজ্য-কেন্দ্রের বিধানসভা লোকসভা নির্বাচন হোক৷সর্বক্ষেত্রেই পেশীশক্তি ও অর্থশক্তির আস্ফালন,হুমকি শাসানি আর বোমাবাজি গুলি বন্দুক অশান্তি - সন্ত্রাসের বীভৎসতা৷শাসক-বিরোধী সব দলেরই এক চিত্র---যেখানে যার শক্তি বেশী সেখানে সে রাজা৷ ফলে সাধারণ মানুষ ভীত, সন্ত্রস্ত্র ও নির্বাচনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ৷ বিভিন্ন কারণে পুলিশ প্রশাসন যথোচিত পদক্ষেপ না করার ফলে রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও সামাজিক সন্ত্রাস ক্রমশঃ লাগামহীন হয়ে শান্তিপ্রিয় সভ্য মানুষেরআতঙ্কে পরিণত৷

প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত লোকেরা বিভিন্নরকম অনৈতিক কাজ কর্মের দ্বারা বৃহত্তর সমাজের প্রভূত ক্ষতি করে চলেছে৷ টিভি-সিনেমা-ইন্টারনেটে অসংস্কৃতি, যৌনতাপূর্ণ হিংসা ও অপরাধমূলক ধারাবাহিক,ছবি ও ঘটনাক্রমের পরিবেশনায় আবেগপ্রবণ অল্পবয়সী ছাত্র-ছাত্রাও যুবসমাজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে বিপথে ও কুপথে পরিচালিত করছে৷স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রাদের মধ্যে রকমারি মাদক ও নেশার দ্রব্য মেশানো লজেন্স-চকোলেট-পুরিয়া ইত্যাদি সরবরাহ করেআগামী প্রজন্মের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেওয়ার এক সুপরিকল্পিত চক্রান্ত চলছে৷ শিক্ষা ব্যবস্থায় রাজনৈতিক অনুপ্রবেশের দ্বারা ছাত্রসমাজের স্বাধীন ও সুস্থ চিন্তাধারা বিকাশের পথ রুদ্ধ করা হচ্ছে৷ আজকের ছাত্র-যুবসমাজ ভবিষ্যতে দেশের সুনাগরিক হয়ে স্বচ্ছ ভাবনা ও নৈতিক দৃঢ়তার দ্বারা দেশ ও পৃথিবীকে সুনির্দিষ্ট উন্নতির লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাবে---এটাই কাম্য৷ কিন্তু সৌহার্দ্যমূলক,সামঞ্জস্যপূর্ণ সুন্দর পরিবেশ না পেলে তাদের পক্ষে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়বে ওদেশ-জাতি-পৃথিবীর ভবিষ্যতওঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে বাধ্য৷আর এই ধবংসাত্মক অবস্থার পরিবর্তন অতি আবশ্যক৷ এছাড়া মানব সমাজকে সামগ্রিক দৃষ্টিতে না দেখেজাত-পাত-ধর্মমত-গোষ্ঠী সম্প্রদায়-এর নিরিখে বিভাজন ও বিদ্বেষ ছড়ানোর এক সুচতুর চক্রান্তের দ্বারা শোষকের দল তাদের কায়েমীস্বার্থ চরিতার্থ করার চেষ্টায় সদা ব্যাপৃত৷

এই পরিস্থিতিতে আগামী প্রজন্ম ও মানবজাতির উজ্বল ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য রেখে পৃথিবীর সকল শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ কে নববর্ষের সূচনাকালে কঠিন শপথ গ্রহণ করতেই হবে৷অন্ধকারের পিশাচেরা যত শক্তিশালী হোক না কেন, শুভ শক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সেই দুবৃত্তদের পরাস্ত করে নোতুন সূর্যোদয়দীপ্ত প্রভাত আনতেই হবে আর এটিই চিরন্তন সত্য৷ন্যায়-ধর্ম-সেবা-সাধনা-প্রেম ও মৈত্রীর ভাবনাই পারে বিশ্বের সমস্ত সন্ত্রাস, হিংসা দুর্নীতি, অসহিষ্ণুতারঅশুভ শক্তিকে বিনাশ করে মানুষের সমাজে সাত্ত্বিকী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে৷ মুখে শান্তির কথা বলে পিছনে শাণিত ছুরিবা আগ্ণেয়াস্ত্রের ঝলকানি কোন দিন বিশ্বশান্তি আনতে পারে না৷ তাই প্রয়োজনে এইসব বেয়াদপ দুরাচারী ভন্ডদের বিরুদ্ধে শুভশক্তিকে প্রবল সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে মুখোশধারীদের স্বরূপ প্রকাশ্যে নিয়ে এসে নব্যমানবতাবাদের স্থাপনা করতেই হবে৷ শোষণহীন, দুর্নীতিমুক্ত ও সকলের বাসযোগ্য সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলাই হোক নববর্ষের পুণ্য দিনে সকল কল্যাণকামী মানুষের একমাত্র অঙ্গীকার ও সর্বশক্তিমান পরমেশ্বরের কাছে আন্তরিক প্রার্থনা৷