গত ৭ই জুন থেকে ৯ই জুন বাংলাদেশের বীরগঞ্জে (দিনাজপুর) আনন্দমার্গের ধর্মমহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ বীরগঞ্জের হরিবাসর প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ধর্মমহাসম্মেলনে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় দুই হাজার আনন্দমার্গের অনুগামী, তাঁদের সঙ্গে আনন্দমার্গের কর্মী, সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীবৃন্দ এই ধর্ম মহাসম্মেলনে যোগদান করেন৷ ধর্মমহাসম্মেলনে মার্গগুরু প্রতিনিধিরূপে কলকাতার আনন্দমার্গের প্রধান কার্র্যলয় থেকে এসেছিলেন আনন্দমার্গের প্রবীণ সন্ন্যাসী ও বেশিরভাগ সময়ে ইয়ূরোপে আনন্দমার্গের প্রচারে রত আচার্য ধ্যানেশানন্দ অবধূত৷
৬ই জুন মার্গগুরু প্রতিনিধি ধ্যানেশানন্দজী ও কলকাতা থেকে অন্যান্য আনন্দমার্গের সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীবৃন্দ ভারতের দিক থেকে (শিলিগুড়ির নিকট) ফুলবাড়ী সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাবান্ধাতে (বাংলাদেশ) পা রাখলেই এখান থেকে বাংলাদেশের আনন্দমার্গীরা তাঁদের পুষ্পমাল্য নিয়ে স্বাগত জানান ও মোটর গাড়ী ও মোটরকার সহযোগে বর্র্ণঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে বীরগঞ্জে ধর্মমহাচক্রস্থলে নিয়ে যান৷ ত্রিদিবসব্যাপী বীরগঞ্জ ধর্মমহাসম্মেলনের প্রতিদিনই ভোরে ‘পাঞ্চজন্য’ কর্মসূচী থেকে শুরু করে, সকালে ১ঘন্টাব্যাপী প্রভাতফেরী, মিলিত সাধনা, প্রতিদিনই দুবেলা মার্গগুরু প্রতিনিধির মনোজ্ঞ আধ্যাত্মিক প্রবচন, ধর্মসভা (যাঁরা মার্গী নয়,তাঁদের নিয়েও), দু-বেলা যোগ-প্রশিক্ষণ শিবির,প্রভাতসঙ্গীত অবলম্বনে সাংসৃকতিক অনুষ্ঠান, কীর্ত্তন-পরিক্রমা, বাবার ভিডিও প্রদর্শন প্রভৃতির মধ্যদিয়ে এক অপূর্ব স্বর্গীয় পরিমন্ডল সৃষ্টি হয়েছিল৷
ধর্মমহাসম্মেলনে সমবতে ভক্তমন্ডলীর সামনে আচার্য ধ্যানেশানন্দজী বলেন, মানুষ নানান্ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে তার সমাধান--- বিভিন্ন প্রশ্ণের উত্তর বিজ্ঞানের মধ্যে খোঁজে৷ বিজ্ঞানের মধ্যে যে সমস্ত সমস্যার সমাধান পায় না মানুষ তা খোঁজে দর্শনের মধ্যে৷ দর্শনের মধ্যেও মানুষ যে প্রশ্ণের উত্তর পায় না--- যে সমস্যার সমাধান পায় না মানুষ তা পাবার আশায় বিভিন্ন রিলিজিয়নের মধ্যে খোঁজে৷ বিভিন্ন রিলিজিয়ানের মধ্যেও যখন তার বহু সমস্যার সমাধান পায় না, সে হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে, ঈশ্বরের কাছে --- আকুতি জানায়, হে পরমপুরুষ, তুমি পথ দেখাও৷ আমি আর কোথাও জীবনের যথার্থ পথের সন্ধান পাচ্ছি না, তুমি আমাকে বলে দাও, আমার জীবনের সার্থকতা কোথায়! মানুষ যখন পরম আকুতি নিয়ে অন্তরের গভীর ভালবাসা নিয়ে পরমপুরুষকে আহ্বান করে তখনই পরমপুরুষ ধরাধামে অবতীর্ণ হন তারকব্রহ্মরূপে৷ মানুষের ভালবাসার টানে তিনি মানুষকে মানবজীবনের নানান্ সমস্যার--- ভৌতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, বৌদ্ধিক, আধ্যাত্মিক সমস্যা সমস্ত সমস্যারই পথ দেখান৷ আর, কিছু মানুষকে তাঁর অফুরন্ত ভালবাসা দিয়ে তাদের মধ্যে শক্তি সঞ্চারিত করেন, যাঁদের মাধ্যমে তিনি চান আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে৷
মার্গগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী তেমনি মানুষের আকুল আহ্বানে সাড়া দিয়ে এসেছিলেন৷ মানুষকে তিনি আজকের জটিল জীবনের পথে কীভাবে জীবনের সার্থকতা অর্জন করতে হবে, কীভাবে মানুষকে চলত হবে - সমস্ত কিছুরই পথ দেখিয়েছেন৷
আধ্যাত্মিক বিষয়ে ‘বাবা’ (শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী) অনেক কিছু বলে গেছেন, সেসব বিষয়ের আলোচনা করতে গিয়ে ধ্যানেশানন্দজী বলেন, মানুষ সাধারণতঃ স্থূল মন নিয়ে ব্যাপৃত থাকে৷ স্থূল মনে সহজে আধ্যাত্মিক ভাব আসে না৷ তার কারণ স্থূল মনের চারিদিকে একটা আরবণ থাকে,--- পাথরের দেওয়ালের মতো--- যা আধ্যাত্মিক ভাবকে আসতে বাধা দেয়৷ তাই মনকে স্থূল থেকে টেনে তুলতে হয়৷ সূক্ষ্ম মনের চারিদিকে কোনও পুরু আবরণ থাকে না---যা আধ্যাত্মিকভাবকে আসতে বাধা দিতে পারে৷
সেই কারণে, যাঁরা সাধনা করেন, তাঁদের বিভিন্ন শুদ্ধি করতে হয়৷ মনকে স্থূল জাগতিক ভাবনা থেকে তুলে এনে সূক্ষ্ম জগতে আনতে হয় ও সূক্ষ্ম মনে ঈশ্বরের প্রতি অন্তরের আকুতি জাগিয়ে তুলতে হয়৷
ধ্যানেশানন্দজী বলেন, মন স্বাভাবিক ভাবেই নানান্ চিন্তার দিকে ছুটে যায়৷ মনকে জোর করে থামিয়ে দিতে নেই৷ বরং এই মনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে হয়, ব্রহ্মভাব নিয়ে সূক্ষ্মাভিমূখী করতে হয়৷
এইভাবে ধ্যানেশানন্দজী আধ্যাত্মিক সাধনার অনেক গূঢ় তত্ত্ব প্রাঞ্জলভাবে ব্যাখা করেন ও সবাইকে আধ্যাত্মিক সাধনার পথে উৎসাহিত করেন৷
ধর্মমহাসম্মেলনে মার্গগুরু প্রতিনিধি আচার্য ধ্যানেশানন্দজীর প্রবচন সমবেত আনন্দমার্গীদের মনে গভীর ভক্তিভাব জাগিয়ে তোলে৷ অনেককে ভক্তিভাবের আতিশয্যে কাঁদতেও দেখা যায়৷