বাংলাকে ঝাড়খণ্ডের প্রধান সরকারী ভাষা করার দাবীতে রাঁচীতে রাজভবনের সামনে আমরা বাঙালীর বিক্ষোভ অবস্থান
গত ৩রা এপ্রিল বাংলা ভাষাকে ঝাড়খণ্ডের প্রথম রাজভাষা (প্রধান সরকারী ভাষা করার দাবীতে ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন জেলা থেকে আমরা বাঙালীর প্রায় সহস্রাধিক সদস্য-সমর্থক রাঁচীতে রাজভবনের সামনে বিক্ষোভ অবস্থান করল৷ আমরা বাঙালীর পক্ষ থেকে রাজভবনে রাজ্যপালের কাছে এই দাবীতে স্মারকপত্রও পেশ করা হয় ৷
সকাল ১০টা থেকে এই অবস্থান বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়৷ এতে নেতৃত্ব দেন আমরা বাঙালীর কেন্দ্রীয় সচিব বকুল রায়, সহ সচিব তারাপদ বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় সাংঘটনিক সচিব অঙ্গদ মাহাত, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনোতোষ মণ্ডল, সমীর সিন্হা, রতন মাহাত, পশুপতি মাহাত, বিকাশ মণ্ডল, বিভূতি দত্ত, সুনীল মাহাত যুগল কিশোর মাহাত, অনুপমা মাহাত, কালীচরণ মাহাত, মিতনলাল মুণ্ডা, তুহিন বিশ্বাস, অনিল কুমার মাহাত, প্রমুখ৷ বিক্ষোভ সমাবেশে সবাই বক্তব্য রাখেন ৷
কেন্দ্রীয় সচিব মাননীয় বকুল চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে আমরা বাঙালীর পাঁচজনের এক প্রতিনিধি দল নির্ধারিত কর্মসূচী অনুসারে রাজ্যপালের নিকট আমরা বাঙালীর দাবী সম্বলিত এক স্মারকপত্র পেশ করেন এই স্মারকপত্রে রয়েছে---
আমরা বাঙালী সংঘটনের পক্ষ থেকে আমরা ঝাড়খণ্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা বাংলাকে প্রথম সরকারী ভাষার স্বীকৃতির দাবীতে আপনার সাংবিধানিক দৃষ্টি আকর্ষণ করছি৷ আমরা জানি, আপনিও অবগত আছেন যে সুপ্রাচীন রাঢ় অঞ্চল বাংলা-সভ্যতার সূতিকাগৃহ রাঢ় -বাঙলাতেই পৃথিবীর প্রথম মানুষের উদ্ভব হয়েছিল৷ বিরাট প্রাণপুরুষ সদাশিবের অভ্রান্ত নির্দেশনার সংস্পর্শে রাঢ়-বাঙলা শুধু সভ্যতারই আদিবিন্দু নয়, সাংসৃকতিক অগ্রগতির প্রথম পদবিক্ষেপ-ভূমি এ রাঢ়-বাঙলা৷
মাননীয় মহোদয়া আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, পরাধীন ভারতবর্ষে ১লা এপ্রিল ১৯১২ তারিখে, ব্রিটিশ শোষক-শাসকরা রাঢ়-বাঙলার পশ্চিমাংশ তথা শুশুনিয়া (পূর্বতন সমেত শিখর) পাহাড়ের ঠিক পূর্বাংশে নিম্নলিখিত এলাকা সমূহ বাঙলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিহার ও ওড়িশা-নামক সদ্যঘটিত প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল৷ পরে ১৯৩৬ সালের ১লা এপ্রিল তারিখে তাকে পুনর্বিভক্ত করে স্বতন্ত্র বিহার ও স্বতন্ত্র ওড়িশা প্রদেশ তৈরী করা হয়৷ অবশেষে ১৫ই নভেম্বর ২০০০-এ বিহার ভেঙ্গে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের জন্ম হয়৷ ঝাড়খণ্ডের অন্তর্গত রাঢ়-বাঙলার নিজস্ব এলাকা অর্থাৎ বাঙালীর জন্মস্থান বা মাতৃভূমির বর্তমান প্রশাসনিক নাম নিম্নরূপ৷ (১) পশ্চিম সিংভূম জেলা, (২) সরাইকেল্লা খরসোঁয়া জেলা, (৩) পূর্ব সিংভূম জেলা, (৪) রাঁচী জেলার সিল্লি ব্লক বুন্দু ব্লক সোনাহাতু ব্লক তামার-১ ব্লক আঙ্গারা ব্লকের ১৩টি ভাষাভাষী পঞ্চায়েত ও ডুংরী (৫) খুন্তী জেলার আর টি ব্লক, (৬) হাজারিবাগ জেলার পেটারওয়ার ব্লক জেরিডি কাসমা ব্লক দামোদরের অন্যান্য দক্ষিণাংশ, (৭) রামগড় জেলার গোলা ব্লক ও রামগড়, (৮) সমগ্র ধানবাদ জেলা, (৯) সমগ্র বোকারো জেলা, (১০) জামতারা জেলা, (১১) দুমকা জেলা, (১২) গোড্ডা জেলা, (১৩) দেওঘর জেলা, (১৪) পাকুড় জেলা, (১৫) সাহেবগঞ্জ টাউন বাদে রাজমহল৷
মাননীয় মহোদয়া, ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে উপরিউক্ত সমূহ প্রশাসনিক জেলা, ব্লক ও এলাকা বাঙলার অবিচ্ছেদ্য অংশ---বাঙলার নিজস্ব মাটি---বাঙালীর মাতৃভূমি আলোচ্য সমূহ এলাকার জনসংখ্যার সিংহভাগ বাঙালী ছিল, আর আজও আছে৷ স্বাধীন ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় বাঙালী বিদ্বেষী নীতির ফলে, খনিজ সম্পদ বহুল উপরিউক্ত বাঙালী অধ্যুষিত এলাকার জনসংখ্যা বিন্যাসের সামান্য তারতম্য ঘটে থাকলেও, ঝাড়খণ্ডে ৭০ শতাংশ বাঙালীর বসবাস৷ অর্থাৎ ঝাড়খণ্ডের ৭০ শতাংশ অধিবাসী বাঙালী, তাদের মাতৃভাষা বাংলা৷ তারা বাঙলার মধ্য রাঢ়ীয় উপভাষা তথা আর একাধিক মিশ্র বুলি ও খণ্ড উপভাষা যেমন, দক্ষিণী খোট্টা বাংলা, উত্তরীয় খোট্টা বাংলা, পাঁচ পরগণিয়া, চার দুমকা ইত্যাদিতে মনের ভাব প্রকাশ করে৷ মাননীয় মহাশয়া আপনি জানেন যে, ইংরেজ শাসনকালে সুদীর্ঘ সময় পর্যন্ত, বাংলা ভাষাই ছিল তামাম ভারতবর্ষের সরকারী কাজের ভাষা৷ অতীব দুঃখের বিষয় রাঢ় বাঙলার সাংস্কৃতিক গরিমা ভুলে, বাংলা ভাষার বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-চিত্রশিল্পী-আধ্যাত্মিক মহাপুরুষদের অবদান পদদলিত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী জনগোষ্ঠীকে মূক-কালা-বধির-স্থবির বানাবার চক্রান্ত চলছে৷ সেই জন্যই আজ ঝাড়খণ্ডের বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলিতে নিয়োগ হচ্ছে হিন্দীভাষী শিক্ষক৷ বিতরণ করা হচ্ছে হিন্দী ছাপা পাঠ্যপুস্তক---উধাও বাংলা পুস্তক৷ পরিকল্পিতভাবে বাংলার নিজস্ব মাটিতে বাঙালীর মুখের বুলি কেড়ে নিয়ে, জোর করে হিন্দী ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ ঝাড়খণ্ডে সংখ্যাগড়িষ্ঠ ভাষা বাংলা-কে রাজ্যের প্রথম সরকারী ভাষার স্বীকৃতি না দিয়ে, শুধুমাত্র বাঙালীদেরই নয়, অন্যান্য ভাষা-ভাষীদেরও চরম ক্ষতি করা হচ্ছে৷ বাংলা ভারতবর্ষের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ তথা ইয়ূনেস্কো স্বীকৃতি বিশ্বের সবচেয়ে সুষমামণ্ডিত-সুমধুর ভাষা৷ বাঙলা এশিয়ার একমাত্র নোবেল ও অস্কার জয়ী ভাষা---শব্দ সম্ভারের দিক থেকে বিশ্বের সংস্কৃত, লাতিন, ইংরেজী, ফরাসী ও জার্মান ভাষার পরেই বাংলার স্থান৷ এমতাবস্থায় আমাদের দাবী সমূহ নিম্নরূপ---
১ বাংলা ভাষাকে ঝাড়খণ্ডের প্রধান সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে হবে
২ সমস্ত সরকারী-বেসরকারী কাজে, অফিস-আদালতের কাজ পূর্বের মত বাংলা ভাষায় করতে হবে
৩ অবিলম্বে রাজ্যের প্রতিটি বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ে-মহাবিদ্যালয়ে বাংলা ভাষী শিক্ষক নিয়োগ ও বাংলা পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করতে হবে
৪ বিশ্ব সভ্যতা-সংস্কৃতির চক্রনাভি রাঢ় বাংলা-র ঐতিহ্যমণ্ডিত কৃষ্টি-সংস্কৃৃতিকে সুসংরক্ষিত করতে হবে