বাসক ও রাম বাসক

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

বাসক ও রাম বাসক গাছ পূর্ব ভারতে ভালই জন্মায়৷ রাম বাসক উচ্চতায় তেমন ৰড় হয় না৷ অনেক সময় গাছ একটু ৰড় হলে শুয়ে পড়ে৷ রাম বাসকের সঙ্গে শেয়ালের ন্যাজের কেমন যেন একটা সুদূর সম্পর্ক রয়ে গেছে৷ তাই রাম বাসককে ক্ষলা হয় ক্রোষ্টুপুচ্ছী, ক্রোষ্টুপুচ্ছিকা, ক্রোষ্টুকপুচ্ছী, ক্রোষ্টুকপুচ্ছিকা৷

 বাসক গাছও উচ্চতায় তেমন ৰড় হয় না, কিন্তু ডালপালা শক্ত থাকে৷ এর পাতা ঘন সবুজ ও লম্বা৷ এর সবচেয়ে বেশী গুণ পাতায়৷

বাসক পাতার বা বাসক রসের গুণ কফ মুক্তিতে ও জ্বর প্রতিরোধে৷ সর্দির ক্ষাড়াক্ষাড়িতে ও পালাজ্বরের আক্রমণে বাসকের জুড়ি মেলা ভার৷

                ‘‘বাসি মুখে বাসকের রস খেও মধু সাথে

                বলতে পারি পালাজ্বরটি পালিয়ে যাবে এতে৷৷’’

বাসক পাতা ছেঁচে নিয়ে পাতার রস বের করে ব্যবহার করা ছাড়াও আর এক রকম ভাবে এর ব্যবহার হয়৷ বিশেষ করে সর্দির ৰাড়াৰাড়িতে ও কফমুক্তিতে–এক মুঠো বাসক পাতা দ্বিগুণ পরিমাণ জলে সিদ্ধ করে যে ক্কাথ তৈরী হয়, তা মধুসহ দু’চামচ দিনে কয়েকবার খেতে হয়৷

রামবাসকের মধ্যেও বাসক পাতার গুণগুলি কিছুটা রয়েছে৷ তাছাড়া অল্প বয়সে শুক্র সংক্রান্ত রোগে রামবাসকের রস অল্প পরিমাণে তালমিছরির সঙ্গে ভক্ষণ করলে দ্রুত রোগ নিরাময় হয়ে যায়৷ ব্যবহার করতে হয় প্রত্যুষে খালি পেটে৷ রামবাসকের পাতার রস না পাওয়া গেলে তুলসীর মূলে একাজ হয়ে থাকে৷ তবে রামবাসকের চেয়ে সে কম শক্তিশালী৷ এ ধরনের অসুখে (শুক্র সংক্রান্ত অসুখে) বাসক পাতাতেও কাজ দেয় না৷ আয়ুর্বেদের অনেকগুলি ঔষধই রামবাসক থেকে তৈরী হয়৷ এক বল্কা ছাগ দুগ্ধে, বাসক পাতার রস ও হরিতকী চূর্ণ মিলিয়ে–সব মিলিয়ে আধ পোয়া হবে–সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পরে খেলে ব্রঙ্কাইটিস রোগে ভাল ফল দেয়৷

আদা

পরিচয় ও প্রজাতি ঃ সংসৃক্ত ‘আর্দ্রক’ থেকে ৰাংলা ‘আদা’ শব্দটি এসেছে৷ আদা শরীরকে ভিজিয়ে দেয়, স্নিগ্ধ রাখে, নিজেও ভিজে ভিজে–স্যাঁৎসেতে৷ তাই সংস্কৃতে নাম আর্দ্রক৷ (আর্দ্রক>আদ্দঅ>আদ্দা>আদা)৷ বিহারে ও উত্তরপ্রদেশের পূর্বাংশে বলা হয় ‘আদী’৷ আদাকে উর্দূ–হিন্দী–হিন্দোস্তান্ ‘আদরক’ বলা হয় যা সংসৃক্ত আর্দ্রক শব্দ থেকে এসেছে৷

আদা পৃথিবীর অনেক দেশেই জন্মায়৷ তার মধ্যে জাপানের আদাই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয়৷ আমরা বলি, আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবরের কী দরকার? কিন্তু সত্যি সত্যিই আদার ব্যাপারীর এককালে জাহাজের খবরের দরকার পড়ত৷ কেননা জাপান থেকে জাহাজে করে আদা আমদানী করা হত৷ এ ছাড়া ফিলিপিন্স্, তাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায় আদা ভালই হয়৷ মালয়েশিয়ায় ‘কংকড়’ নামে যে আদাবর্গীয় মশলা পাওয়া যায় রন্ধনশিল্পে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে৷ ভারতেও আদা বন্য অবস্থায় জন্মায়৷ ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরামের ও ৰাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদা বেশ উচ্চমানের৷ ৰাংলায়, বিশেষ করে রাঢ়ের ক্ষীরভূম জেলার নদী–ববাহিকা এলাকায় আদা বেশ ভালই হয়৷

আদা নানান রঙের হয়–শাদাটে হলদে, ঘন হলদে, কৃষ্ণাভ হলদে ও কালো আদা৷

কফারি (কফ + অরি = কফের শত্রু) হিসেবে আদার ব্যবহার ঃ আয়ুর্বেদে আদার অজস্র গুণের উল্লেখ আছে৷ যে মূল ত্রি–ধাতুতে জীব–স্বাস্থ্য নির্দ্ধারিত হয় তার প্রথমটি হচ্ছে বায়ু, দ্বিতীয়টি হচ্ছে পিত্ত ও তৃতীয়টি কফ৷

বায়ু দুই প্রকার–১) পঞ্চ অন্তর্বায়ু (প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যানগ্গ ২) পঞ্চ বহির্বায়ু (নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত, ধনঞ্জয়)৷ এই পঞ্চ অন্তর্বায়ু ও পঞ্চ বহির্বায়ুর সমাহারগত নাম পঞ্চপ্রাণ বা দশপ্রাণ (যা মানব অস্তিত্বের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ)৷

পিত্তধাতু দেহের পরিপাক যন্ত্রের প্রধান সহায়ক৷ এর ফলে শরীর–সংঘটক সপ্তধাতুর উদ্ভব ঘটে৷ তৃতীয় স্বাস্থ্যগত ধাতু হচ্ছে কফ বা দেহের তরল থকথকে অংশ৷ কফের আধিক্য দেহাভ্যন্তরে অহেতুক উষ্ণতা সৃষ্টি করে যার বহিঃপ্রকাশ জ্বররূপে দেখা দেয়৷ ইয়ূনানি বা হেকিমী চিকিৎসায় অবশ্য রক্তকেও একটি স্বাস্থ্যগত মৌলিক ধাতু বলে গণ্য করা হয়৷ কফ–শব্দটি প্রাচীন বৈদিক৷ লাতিনের মাধ্যমে বর্ত্তমান ইংরেজীতেও আমরা কফ (Cough) শব্দটি পাচ্ছি৷ ত্রিফলার জল বায়ু–পিত্ত–কফ এই ত্রিদোষজাত রোগের ঔষধ৷

আর্দ্রক বা আদা কফের শত্রু–কফ বিনাশক৷ তাই আয়ুর্বেদে আদার একটি নাম কফারি৷ কফাশ্রিত বায়ুর প্রভাবে শ্বাসক্রিয়ার কষ্ট বা শ্বাসরোগ বা হাঁপানির সৃষ্টি হয়, তার জন্যে আদার রস, গব্য ঘৃত ও দুধ সহযোগে যে ঔষধ প্রস্তুত করা হয় তা খুবই কার্যকরী৷ পাঁচ তোলা গব্যঘৃত কাঁসার বাটিতে ফুটিয়ে নিতে হয়৷ অন্য একটি পাত্রে আড়াই তোলা আদার রস গরম করে ঘিয়ের পাত্রে ঢেলে দিয়ে কাঁসার থালা চাপা দিতে হয়৷ তা থেকে দু’তোলা ঘি আধ পোয়া গরম দুধের সঙ্গে রোগ যন্ত্রণার সময় একটানা পনর দিন ব্যবহার করলে রোগ সম্পূর্ণ সেরে যেতে পারে৷ এছাড়া মাতৃকুল জাত হাঁপানির ক্ষেত্রে আধ সের জলে ১০০ গ্রাম তাল মিছরি, কিছু পরিমাণ এলাইচী, লবঙ্গ, যষ্টি মধু ও গোলমরিচ গুঁড়ো একত্রে সেদ্ধ করে ২০০ গ্রাম থাকতে নামিয়ে দিনে তিনবার পান করলে সুফল পাওয়া যায়৷

কর্মে উৎসাহহীনতা দূর করতে আদা ঃ যাঁরা কোন কর্মে উৎসাহ পান না, যাঁরা দীর্ঘসূত্রী বা অলস, তাঁরা গুড়–ছোলাভিজে–আদা একসঙ্গে কিছুদিন খেলে কর্মোদ্যম ফিরে পাবেন৷ মুড়িতে যে পেট–ফাঁপার দোষ আছে, আদার সঙ্গে মুড়ি খেলে সে দোষটা থাকে না৷ তাই যেখানে জলখাবারে মুড়ির প্রচলন, সেখানে উচিত মুড়ির সঙ্গে দু’–চারটে আদা–কুচি খেয়ে নেওয়া৷

                ‘‘মুড়ির সঙ্গে নারকোল কুরো আর আদা কুচি

                গপাগপ খাবে দাদা ফেলে দিয়ে লুচি৷’’

পেট ভাল কিন্তু দুর্বল রোগীর পক্ষে আদার পাতার রস কিছুটা ভাল৷ আদার সিরাপও শীতল পেয়৷ মাটি থেকে আদা তোলার পর তাকে সেদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে নিলে যা তৈরী হয় তাকে সংস্কৃতে বলি ‘শুন্ঠিক’৷ ৰাংলায় শুঁঠ বা আদার শুঁঠ৷ শুঁঠের সংস্কৃতে আর একটি নাম ‘ইক্ষবাকু’৷ শুঁঠ আদা আয়ুর্বেদীয় ঔষধ তৈরীতে কাজে লাগে৷ আদার যে অল্প–স্বল্প দোষ আছে শুঁঠের সে দোষ নেই৷ তবে খাদ্য হিসেবে শুঁঠ তেমন জুৎসই নয়৷ আদা ও শুঁঠ দুই থেকেই উত্তম মানের সিরাপ তৈরী হতে পারে–তৈরী হতে পারে বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক ও স্বাস্থ্যপ্রদ শীতল পেয় (Cold drink) ৷ তোমরা ইচ্ছে করলে বাড়ীতে ginger syrup বা আদার শর্করা–পান তৈরী করে দেখতে পার, খেতে ভালই লাগবে৷ বাড়ীতে শরক্ষৎ তৈরী করবার সময় দু’–তিন চামচ আদার সিরাপ ঢেলে দিলে তাতে স্বাদ ও গন্ধ তো ক্ষাড়বেই, হজমেও সুবিধা হবে৷ শুকনো বা মাখো মাখো তরিতরকারী উনুন থেকে নাবিয়েই গরম গরম থাকতে থাকতে দু’–চামচ আদার সিরাপ ঢেলে দিলে, পরিবেশন করবার সময় স্বাদে–গন্ধে তা অপূর্ব হয়ে উঠবে৷ পায়েসও নাবাবার পরে তাতে আদার সিরাপ খুব অল্প পরিমাণে ঢেলে দিতে পার, তবে বেশী দিও না৷

আদার ব্যবহারে বিধিনিষেধ ঃ আদা উষ্ণবীর্য অর্থাৎ শরীরকে একটু টেনে নেয় যার জন্যে গর্ভবতী নারীর পক্ষে আদা বেশী না খাওয়া উচিত৷ যাদের পেটে কোন ক্ষত থাকে, আমাশয় বা রক্ত–আমাশয় রোগ রয়েছে, তাদের সে সময় আদা না খাওয়া উচিত৷ যার যে বয়সই হোক না কেন, যে পুরুষের শরীরে শুক্রাভাব রয়েছে তারও আদা বেশী না খাওয়াই উচিত৷ সদ্যপ্রসূতা নারীও আদা না খেলেই ভাল৷