বিজনসেতু ৩০ এপ্রিল,১৯৮২–জড়বাদী মূঢ়তার উন্মত্ততম প্রকাশ

সংবাদদাতা
নিজস্ব সংবাদদাতা
সময়

১৯৮২ সালের ৩০শে এপ্রিল৷ তখন সবেমাত্র আকাশ আলো করে পূর্ব দিগন্তে উঁকি দিচ্ছে সূর্য, আনন্দমার্গের আসা–যাওয়ার পথের ধারে ওৎ পেতে বসেছিল সিপিএমের হিংস্র হার্মাদ বাহিনী, ঠিক যেন হিংস্র হায়নার দল৷ আনন্দমার্গের বেশ কিছু সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনী কয়েকটি ট্যাক্সিতে করে হাওড়া থেকে তিলজলা আশ্রমে যাচ্ছিলেন৷ বণ্ডেল গেট ও বালিগঞ্জের বিজন সেতু দিয়েই তিলজলা আশ্রমে যাওয়ার রাস্তা৷ ওই এলাকায় যেই ট্যাক্সিগুলো পৌঁছলো অমনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্যাক্সি থেকে এক এক করে সন্ন্যাসীদের টেনে হিঁচড়ে বের করে শাবল দিয়ে মাথায় আঘাত করে, ছোরা দিয়ে চোখ উপড়ে ফেলে, গায়ে এ্যাসিড ও পেট্রোল ঢ়েলে পুড়িয়ে মেরেছিল ১৭ জন সন্ন্যাসী–সন্ন্যাসিনীক্৷ ভয়ে শিশুরাও মুখ লুকিয়েছিল মায়ের কোলে, তরুণ–তরুণীদের মুখ হয়ে উঠেছিল বিবর্ণ পাংশুবর্ণ, বুদ্ধিজীবীরা হয়েছিলেন স্তম্ভিত হতবাক, আর সবার আড়ালে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছিল তিলোত্তমা কোলকাতা৷ পশ্চিমবঙ্গবাসীরা অনুভব করলেন ‘হাড়হিম’ করা সেই ঘটনা তাদের মুখে মাখিয়ে দিয়েছে চুণকালি৷ ভারতবাসীরা মনে করলেন, সমগ্র বিশ্বের কাছে ভারতের ভাবমূর্ত্তি ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল৷ এমনই পরিবেশে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ওই দিন দমদম বিমান বন্দরে বিবৃতি দিলেন–এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা৷ সিপিএম পার্টির রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত ২রা মে বিবৃতি দিলেন যে, জনগণ এই হত্যা করেছে৷

মারণযজ্ঞ বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, পূর্ব পরিকল্পিত ঃ

৩০শে এপ্রিলের দুপুর বেলা দমদম বিমানবন্দরে জ্যোতি বসু বলেছিলেন–এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা৷ বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে জ্যোতি বসু বোঝাতে চেয়েছিলেন যে এটি সম্পূর্ণভাবেই পরিকল্পনাহীন হঠাৎ করে’ হয়ে যাওয়া ঘটনা৷ কিন্তু রাজ্যের চীফ সেক্রেটারী অমিয় কুমার সেন সেদিন বিকালেই সাংবাদিকদের বলেন–‘‘ছকে বাঁধা ঘটনা, পরিকল্পিত ঘটনা৷ অনেক দিন ধরে ভেবেচিন্তে ঠাণ্ডা মাথায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে৷’’ আনন্দবাজার পত্রিকার ১লা মে’র সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল ‘‘শুক্রবার সকালে দক্ষিণ কোলকাতায় আনন্দমার্গী অবধূত এবং অনুগামীদের যেভাবে হত্যা করা হইয়াছে তাহা যে পূর্ব পরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত এই বিষয়ে সন্দেহ নাই৷ এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যে কয়েকদিন যাবৎ বৃহত্তর কোলকাতায় বিশেষ করিয়া দক্ষিণ কোলকাতার আশেপাশের অঞ্চলগুলিতে ছেলেধরা গুজব রটানো হইতেছিল৷’’ সম্পাদক মহাশয় ‘‘পূর্ব পরিকল্পিত’’ ও ‘‘রটানো হইতেছিল’’ লিখে হত্যাকাণ্ডের আনুপূর্বিক সূত্র ধরিয়ে দিয়েছেন৷ যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক ১লা মে’তে লিখেছেন–‘‘যেভাবে ঘটনাটা ঘটানো হয়েছে তাতে অন্ততঃ এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বেশ ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে আনন্দমার্গীদের হত্যা করা হয়েছে৷’’

বরুণ সেনগুপ্ত আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখেছেন– ‘‘ওই দিনের মারণযজ্ঞের পর কি মনে হয় না ছেলেধরা গুজব রটানোও একই পরিকল্পনার অঙ্গ? আনন্দমার্গীদের ওইদিন ওইভাবে খুন করার ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্যেই দীর্ঘদিন ধরে সর্বত্র বিশেষ করে ওই অঞ্চলে ছেলেধরা গুজব রটানো হয়েছিল, একথা কি এখন পরিষ্কার বোঝা যায় না?’’

হত্যার পরিকল্পনা ছিল সিপিএম নেতৃবৃন্দের ঃ

সিপিএমের রাজ্য নেতা প্রমোদ দাশগুপ্তর বিবৃতি ৩রা মে’র কাগজে প্রকাশিত হয়েছে৷ তিনি বলেছেন ‘‘জনগণ আনন্দমার্গের সন্ন্যাসীদের ছেলেধরা হিসাবে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল বলে ক্রুদ্ধ হয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল’’৷ অথচ ওই দিনই কোলকাতার পুলিশ কমিশনার নিরুপম সোম ও ২৪ পরগণার পুলিশ সুপারিনটেণ্ডেণ্ট সদানন্দ চক্রবর্ত্তী বিবৃতি দিয়ে বলেছেন–‘‘কোলকাতা এবং ২৪ পরগণার কোন থানায় ছেলেধরার কোন ডায়েরী নেই ও কোন স্কুল থেকে কোন ছেলেমেয়ে হারায়নি৷’’ এর দু’দিন বাদে আই জি সত্যব্রত বসু বলেন–‘‘পশ্চিমবঙ্গের কোথাও কোন ছেলেমেয়ে হারায়নি৷’’

সেদিনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের শিক্ষা বিভাগের সচিব আচার্য তন্ময়ানন্দ অবধূত বলেন– সেদিনের শাসকদলের নেতা–মন্ত্রীদের কথার সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনের কর্তাব্যষ্টিদের বিবৃতির পার্থক্যই বুঝিয়ে দেয় শাসকদল অপরাধ আড়াল করতে চেয়েছিল৷ যে স্থানে ঘটনা ঘটেছে সেদিন সেই স্থান ছিল সি.পি.এমের দুর্ভেদ্য অঞ্চল৷ শাসকদলের সহযোগিতা ছাড়া বাহিরে থেকে এসে কারো পক্ষে এই নারকীয় ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়৷ তাই একটা বিষয় পরিষ্কার বিজন সেতুর সেদিনের নারকীয় ঘটনা সিপিএমের পূর্ব–পরিকল্পিত৷

১৯৮২, ৩০শে এপ্রিল বিজনসেতু, বন্দেল গেটের নিধনযজ্ঞ কম্যুনিষ্ট পার্টির জড়বাদী মূঢ়তার উন্মত্ততম প্রকাশ৷ মূর্খ শাসক চেয়েছিল আনন্দমার্গকে শেষ করে দিতে৷ কিন্তু কালের গতিপ্রবাহে সেই সিপিএম আজ বিনাশের পথে৷ আনন্দমার্গের বিজয় রথ দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে৷