২০১৯ সালের জানুয়ারির শেষ৷ তুষারঝড়ে বিধবস্ত আমেরিকা৷ তীব্র শৈত্যপ্রবাহে যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যু হয়েছিল ২২ জনের৷ আমেরিকার বহু প্রদেশ বরফের চাদরে ঢাকা পড়েছিল৷ ডাকোটা, মিনেসোটা, ইলিনয়, আইয়োয়া, ইন্ডিয়ানা, মিশিগান, নিউ হ্যাম্পশায়ার, উইসকনসিন, নিউ ইয়র্ক এবং পেনসিলভ্যানিয়ায় তাপমাত্রা নেমেছিল হিমাঙ্কের অনেক নীচে৷ এমনকি উষ্ণ টেক্সাসেও ঠান্ডা হাওয়া বইছিল হু-হু করে৷ এর পর ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি৷ আমেরিকায় সতর্কতা জারি করে ন্যাশনাল ওশিয়ানিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ)৷ সতর্কতা ছিল সুমেরুর উচ্চ বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রায় হঠাৎ বদল নিয়ে৷ আর এর জন্য ২০২৩-এর শেষের দিকে সুমেরুর প্রচণ্ড ঠান্ডা বাতাস শৈত্যপ্রবাহ রূপে আমেরিকা, কানাডা এবং ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়ে যাবে৷ প্রবল ঠান্ডা পড়বে৷
এর নেপথ্যে রয়েছে ‘পোলার ভর্টেক্স’৷ বাংলায় যাতে বলে মেরু ঘুর্ণাবর্ত৷ এটি দুই মেরুকে ঘিরে থাকা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিম্নচাপ এবং ঠান্ডা হাওয়া৷ এটি গ্রীষ্মে দুর্বল এবং শীতে শক্তিশালী হয়৷ সুমেরুর হাড়কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া দক্ষিণমুখী হওয়ার ফলেই এই বিপজ্জনক পোলার ভর্টেক্স বা মেরু ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হয়৷ ‘ভর্টেক্স’ শব্দের অর্থ ঘড়ির কাঁটার বিপরীতমুখী বায়ুপ্রবাহ, যা মেরু অঞ্চলে ঠান্ডা হাওয়া চলাচল বজায় রাখতে সাহায্য করে৷ উত্তর গোলার্ধে শীতের সময় মেরু আবর্ত আরও প্রসারিত হয় এবং দক্ষিণের দিকে দ্রুত গতিতে ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত পাঠায়৷ শীতে এমনটা প্রায় রোজ হতে থাকলে আমেরিকায় মেরু বাতাসের প্রকোপ বাড়ে৷ ২০১৯ সালের আগে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ‘পোলার ভর্টেক্স’-এর প্রকোপ দেখা গিয়েছিল আমেরিকায়৷ তার আগে ১৯৭৭, ১৯৮২, ১৯৮৫ এবং ১৯৮৯ সালেও এমন হিমশীতল সময়ের সাক্ষী থেকেছে আমেরিকা৷ তবে খুব শিগগিরই শেষ হয় মেরু ঘূর্ণাবর্তের খেল৷ যে সব এলাকায় তাপমাত্রা হিমাঙ্কের অনেক নীচে নেমে গিয়েছিল, আচমকাই সে সব জায়গায় তাপমাত্রা অনেকটা বেড়ে যায়৷ শীতের কামড় যেতে না যেতেই গরম পড়ে৷
এর মধ্যে উত্তর-পূর্ব আমেরিকার আটলান্টিক উপকূলের রাজ্যগুলিতে ‘পোলার ভর্টেক্স’-এর প্রকোপ বেশি৷ এই ‘পোলার ভর্টেক্স’-এর প্রকোপ নাকি এ বার আরও ঘন ঘন টের পাওয়া যাবে৷ আর এ ভাবে যদি চলতে থাকে, তা হলে ভবিষ্যতে আবার তুষার যুগ ফিরতে পারে পৃথিবীর বুকে৷ বরফে ঢেকে যেতে পারে পৃথিবী৷ শেষ হতে পারে মনুষ্য প্রজাতি তেমনটাই আশঙ্কা করছেন অনেকে৷ আবহবিদেরা অবশ্য এর জন্য কাঠগড়ায় তুলেছেন বিশ্ব উষ্ণায়নকে৷ এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, পোলার ভর্টেক্সের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ এমনটা মোটেও নয় যে, পৃথিবী শীতল হচ্ছে৷ প্রকৃতপক্ষে এটি গ্রহের উষ্ণতা বৃদ্ধি করছে, যা ঠান্ডার তারতম্যে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে৷ একই সঙ্গে মেরুবায়ুকে স্থানচ্যুত করছে৷
দিনের পর দিন গরম বাড়ছে পৃথিবীতে৷ মেক্সিকান গরম হাওয়ার স্রোত কানাডিয়ান শীতল স্রোতের সঙ্গে মিলিত হয়ে উত্তর-দক্ষিণ ক্যারোলাইনা, ওয়াশিংটন ডিসি, পেনসিলভ্যানিয়া, নিউ জার্সি, নিউ ইয়র্ক ও মেইন-এর মতো রাজ্যগুলোতে প্রবল তুষারপাত ঘটাচ্ছে৷ সেই সঙ্গে উত্তর মেরুর ঠান্ডা বাতাসও ধেয়ে আসছে আমেরিকার ওই অংশগুলোতে৷ মেরু ঘূর্ণাবর্ত একটি নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে৷ নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে ঘোরাফেরা করে৷ কিন্তু গরম বৃদ্ধি পাওয়ায় গরম হাওয়ার স্রোতের কারণে তা নীচের দিকে নেমে আমেরিকা, কানাডা এবং ইউরোপের দিকে এগিয়ে আসছে৷
আর সেই কারণেই অনেকে মনে করছেন, উষ্ণায়নের কারণে তাপমাত্রার তারতম্যে ব্যাঘাত ঘটলে মেরু ঘূর্ণাবর্তের প্রকোপ বাড়বে৷ ধীরে ধীরে আমেরিকা এবং ইউরোপ ছাড়িয়ে তা আরও এগিয়ে আসবে এবং এক সময়ে আবার তুষারে ঢাকা পড়বে সারা পৃথিবী৷