ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ, এ বড়াই দেশের নেতা মন্ত্রীরা করেই থাকেন৷ আম জনতার এসব চিন্তা করার সময় নেই৷ তাদের পেটের ভাত জোগাড় করতেই দিন ফুরিয়ে যায়৷ যাদের জন্যে এই বিল তাদেরও বিশেষ মাথা ব্যাথা নেই৷ তবে এই বিলকে কেন্দ্র করে ভারতীয় আইনসভার উচ্চ কক্ষে যা হয়ে গেল তা গণতন্ত্রের প্রহসন বলা চলে৷ সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী মতকে উপেক্ষা না করে সম্মান জানানই গণতান্ত্রিক রীতি৷ কিন্তু যেভাবে বিরোধী মতকে উপেক্ষা করে রাজ্যসভায় কৃষিবিল পাশ করানো হ’ল তাতে সেই রীতি মানার বালাই তো নেই বরং প্রধানমন্ত্রীর গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে জনগণের সন্দেহ আরও প্রকোট হল৷ মনে হতেই পারে মুষ্টিমেয় কয়েকজন গোষ্ঠীস্বার্থের প্রেরণায় রাষ্ট্রপরিচালনা করছে---ওলিগার্কি Oligarchy) শাসনতন্ত্র রাষ্ট্রে কায়েম হয়েছে৷ যদিও ভারতের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোয় জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন রাষ্ট্রপ্রধান৷ ছয় বছর আগে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী প্রথম সংসদভবনে প্রবেশের পূর্বে প্রবেশদ্বারে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম দিয়ে গণতন্ত্রকে সম্মান জানিয়েছিলেন৷ আজ মনে হয় সবটাই কপটাচারিতা৷
সংসদীয় গণতন্ত্রে সংখ্যাধিক্যের জোরে বিরোধীমতকে উপেক্ষা করা যায়, অবজ্ঞা করা যায়, তাতে ক্ষমতার স্পর্র্দ্ধ থাকলেও অগণতান্ত্রিক বলা যাবে না৷ কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রটাই এমন ---যেখানে ২৩৫ এর তোপে ৩৫ কে উড়িয়ে দেওয়া যায়৷
তবে রাজ্যসভায় ২০শে সেপ্ঢেম্বর যেভাবে চরম বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে সংখ্যাধিক্যের প্রমাণ ছাড়াই কৃষির মত গুরুত্বপূর্ণ বিল গাজোয়ারি করে অস্বচ্ছভাবে পাশ করিয়ে নেয় স্বচ্ছ ভারতের প্রণেতা প্রধানমন্ত্রী৷ ২০শে সেপ্ঢেম্বর ভারতের সংসদীয় ইতিহাসে কালো দিন হয়ে থেকে যাবে৷ লোকসভায় সংখ্যা গরিষ্ঠতার জোরে বিল পাশ হলেও রাজ্যসভায় সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল৷ প্রথমত শাসকদল নিজেই রাজ্যসভায় সংখ্যা লঘু৷ রাজ্যসভায় গরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে শরিক দলের ওপর নির্ভর করতে হয়৷ এক্ষেত্রে শরিক দলের অনেকেই বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর৷ শরিক দলের এক মন্ত্রীও কৃষি বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করেন৷ তাই কৃষি বিল নিয়ে রাজ্যসভায় ভোটাভুটি হলে শাসকদলের পরাজয়ের আশঙ্কা ছিলই৷ তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোয় সংসদীয় রীতি-নীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে একপ্রকার মস্তানি করেই রাজ্যসভায় কর্ষক স্বার্থের মুখোশে পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষার কর্ষক বিল পাশ হয়ে গেল৷
ভারতবর্ষের মত কৃষিপ্রধান দেশে কৃষির মত গুরুত্বপূর্ণ বিল নিয়ে যথেষ্ট আলোচনার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল, বিরোধীরা সেই দাবীই জানিয়েছিলেন৷ তাঁদের দাবী মোটেই অন্যায্য বা অন্যায় ছিল না৷ বরং গণতান্ত্রিক রীতি মেনে গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান জানিয়ে বিরোধীদের দাবী মেনে নিলে প্রধানমন্ত্রীর গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়তো বই কমতো না৷ ক্ষমতার জোরে নয়, আলোচনায় তথ্য ও যুক্তি দিয়ে বিলের গ্রহণ যোগ্যতা সর্বসাধারণের সামনে তুলে ধরার সুযোগ সরকারপক্ষও পেত৷ এমন নয় যে কৃষিবিল আইনে পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্ষকদের সব সমস্যা দুর হয়ে যাবে৷ যেভাবে পরিকল্পিতভাবে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরী করে বিল পাশ হল তাতে কৃষি আইন নিয়ে সরকারের মহৎ উদ্দেশ্যের পরিচয় পাওয়া যায়নি৷
সেই সঙ্গে একদিন পরেই বিরোধী শূন্য রাজ্যসভায় পাশ হলো অত্যাবশ্যক পণ্য আইন সংশোধন বিল৷ যার ফলে গরীব কর্ষক ও মধ্যবিত্ত নয়, মুনাফা লুটবে মজুতদার৷ এখন থেকে চাল,ডাল, আলু,পেঁয়াজ ভোজ্যতেল প্রভৃতি অত্যাবশ্যক পণ্যের মজুত করায় কোন বাধা থাকবে না৷ ২০শে সেপ্ঢেম্বর বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের মুখে কালী লেপে পাশ হলো কর্ষক-বিল৷ যাকে পুঁজিবাদী স্বার্থ-বিলও বলা যেতে পারে৷
বিলের ভালো মন্দ, কর্ষকের স্বার্থরক্ষা নাকি কর্র্পেরেট ইণ্ডিয়ার মুনাফা সেটা বিল আইন হওয়ার অনেক পরে বোঝা যাবে৷ কিন্তু যেভাবে ২০শে সেপ্ঢেম্বর সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়মনীতি উপেক্ষা করে, সম্পূর্ণ গাজোয়ারী করে পরিকল্পিতভাবে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে বোটে পরাজয়ের আশঙ্কায় গলার জোরে কৃষিবিল পাশ হলো রাজ্যসভায় তা ভারতের সংসদীয় ইতিহাসে একটি কালো দিন হয়ে চিহ্ণিত থাকবে৷
- Log in to post comments